নাটক: ভাঙা সম্পর্কের জাদুঘর – দেবাশিস দত্ত

(গান, বন্ধু তোমার চোখের মাঝে…)

দৃশ্য-১

ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কির এক ভ্যলেনটাইন্স ডে পার্টিতে আলাপ, আর প্রথম দেখাতেই প্রেম। ছেলেটির অবস্থা তখন ভাল নয়, নিজের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, গলা অবধি ধারদেনা। সকাল-বিকেল দুটো আলাদা চাকরি করতে হচ্ছে দেনা শোধ করতে। মেয়েটির তাতে কিছু এসে যায় না। সে চলে এল ছেলেটির সঙ্গে থাকতে। একদিন একসঙ্গে রাতের মেট্রোয় ফিরছে, অচেনা এক ভদ্রলোক একটুকরো কাগজ বাড়িয়ে দিলেন। ওদের দুজনের একটা স্কেচ করেছেন তিনি। পরের স্টেশনে নেমে গেলেন, তার নামটাও জানা হয়নি ওই জুটির। মেয়েটি অসম্ভব ভালবাসত ছেলেটিকে, তার জন্য সব কিছু ছাড়তে প্রস্তুত সে। আর গোল বাধল সেখানেই। মেয়েটি বিদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বৃত্তি পেল, স্কলারশিপ। অনেকগুলো টাকা, ভাল সুযোগ। কিন্তু প্রেমিককে ছেড়ে সে যাবে না।

মেয়েটি— না, আমি যাব না, যাব না তোকে ছেড়ে, নেভার নেভার নেভার!
ছেলেটি— তুই বোঝার চেষ্টা কর, এত ভাল সুযোগ, নষ্ট করিস না, সময় তো আছে, আবার আমরা একসঙ্গে থাকব, তুই দেখিস…
মেয়েটি— না, আমি যাব না…

ছেলেটি অনেক বোঝাল, কিন্তু কোনও লাভ হল না। শেষমেশ ভয়ংকর কঠিন একটা রাস্তা নিল ছেলেটি। তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে জানিয়ে দিল যে তাদের সম্পর্ক শেষ, ব্রেকআপ। চোখের জল মুছে সেই মেয়ে চলে গেল বিদেশে। এর চার মাস পরে ছেলেটি তার কারখানায় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হল। প্রাণে বাঁচল বটে, কিন্তু মারাত্মক জখম হল। বুঝতে পারল প্রিয় মানুষকে পাশে না পাওয়ার যন্ত্রণা। সে মেয়েটিকে জানাল, সেরে উঠলেই আমি তোর কাছে যাবে, ওখানেই কাজ করবে, একসঙ্গে থাকবে আমরা।

মেয়েটির উত্তর এল, অনেক দেরি হয়ে গেছে, অন্য এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি আমি, তোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কোনও ইচ্ছে, আমার আর নেই।

নাহ্, ছেলেটিও আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। হয়তো খুঁজে চলেছে সেই মেয়েটিরই মত অন্য কাউকে। আর মেট্রোরেলে সেই আগন্তুকের আঁকা তাদের দুজনের সেই স্কেচ জমা আছে এই জাদুঘরে।

ভাঙা সম্পর্কের জাদুঘর…
মিউজিয়াম অব ব্রোকেন রিলেশনশিপস…
চলচ্চিত্র প্রযোজক ওলিঙ্কা ভিসটিকা ও ভাস্কর দ্রাজেন গ্রুবিসিক-এর চার বছরের সম্পর্ক ভেঙে যায় ২০০৩ সালে। বিচ্ছেদের বেদনার মধ্যেই তাঁরা মজা করে বলেছিলেন, তাঁদের সম্পর্কের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা জিনিসপত্র নিয়ে একটা সংগ্রহশালা করলে কেমন হয়! গোড়ায় সেটা ছিল নেহাতই কথার কথা, কিন্তু বছর তিনেক পরে সত্যিই নড়েচড়ে বসেন দুজনেই। বন্ধুদের কাছে চাইতে থাকেন এমন কোনও জিনিস, যার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বেশ কিছু জিনিস জুটেও গেল, আর তা প্রদর্শিত হল জাগ্রেবের এক আর্ট গ্যালারিতে।
এরপর এই সংগ্রহ চলল বিশ্বভ্রমণে। জার্মানি, বসনিয়া, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, আমেরিকা, আরও বহু দেশ গেল। সমব্যথী মানুষের দানে বাড়তে লাগল সংগ্রহ সম্ভার। এক বার্লিনেই পাওয়া গেল তিরিশটি নতুন জিনিস, সবই বিচ্ছেদের বেদনামাখা।

(গান, এক আকেলা ইস শহর মে…)

ওলিঙ্কা ও দ্রাজেন ক্রোয়েশিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রকে বেশ কয়েকবার আবেদনও করেছিলেন এই সংগ্রহের একটা স্থায়ী ঠিকানার জন্য। প্রতিবারই আবেদন ব্যর্থ হতে দেখে জেদ চেপে গেল ওদের। নিজেরাই ভাড়া করলেন জাগ্রেব শহরের ৩২০০ বর্গফুট জায়গা। ২০১০-এর অক্টোবরে সেখানেই তৈরি হয় ক্রোয়েশিয়ার প্রথম ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জাদুঘর।
কী আছে এই জাদুঘরে? মেয়েদের এক পাটি স্টিলেটো জুতো, একপাতা গ্যাস্ট্রাইটিসের ট্যাবলেট, একটা ভাঙা হাতঘড়ি, কফিমেকার, মেট্রোয় আঁকা কোনও দম্পত্তির স্কেচ, বটল ওপেনার, ঘরে বানানো বর-বউ পুতুল, মা আর ছানা ব্যাঙ পুতুল, ছেঁড়া দস্তানা, আরও অসংখ্য জিনিস। বলা বাহুল্য, প্রতিটি জিনিসের সঙ্গেই জোড়া আছে এক একটি গল্প। ভাঙা সম্পর্কের গল্প।

দৃশ্য-২

মেয়েটি অনেকদিন মনের মধ্যে দরজা ছিল খোলা
অনেকদিন বুকের মধ্যে জানলা ছিল খোলা
দরজা দিয়ে বাতাস এবং জানলা দিয়ে হাওয়া
মনের মধ্যে, বুকের মধ্যে করল আসা যাওয়া

বাতাস ছিল নদীর পাড়ের, বাতাস ছিল ভেজা
বাতাস ছিল পাহাড়চূড়ার, ছিল বরফ সাদা
বাতাস ছিল সমুদ্র নীল, চোখে লবণ বালি
বাতাস ছিল আলোছালো, বুক করেছে খালি

ছেলেটি— স্লোভেনিয়ার ছেলেটি মেয়েটিকে খুবই ভালবাসত, কিন্তু কখনও তাকে বিয়ের কথা বলেনি। শারীরিক সম্পর্কও হয়নি তাদের মধ্যে।

মেয়েটি— হাওয়ায় ছিল মৃদুমন্দ গন্ধভরা ফুল
হাওয়ায় ছিল উড়ন্ত তার রেশম-কালো চুল
হাওয়ায় ছিল দূর অতীতের নষ্ট স্মৃতির বিষ
হাওয়ায় ছিল জ্যোৎস্না রাতে কালকেউটের শিস

হাওয়া বাতাস বুকের মধ্যে করল অনেক খেলা
দু-হাত তবু শূন্য আজও ফুরিয়ে যাচ্ছে বেলা

রোজই সে মেয়েটিকে কোনও না কোনও উপহার দিত, ছোটখাটো কিছু। যেমন একটা চাবি, একটা বটল ওপেনার। দুটোই মিনিয়েচার, ব্রোঞ্জের তৈরি। মেয়েটির আজ মনে হয়, সেই চাবিটা তার হৃদয়ের দরজা খোলার চাবি, আর বটল ওপেনারটা তার মাথা ঘুরে যাওয়ার প্রতীক। ছেলেটি যে তাকে কত ভালবাসত, মেয়েটি বুঝতে পারে অনেক পরে। খবর এসেছিল, ছেলেটি মারা গিয়েছে এইডস-এ৷ অনেক অনুরোধ উপরোধ, অভিমান সত্ত্বেও মেয়েটির সঙ্গে সে কারণে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি সে। আর ভাঙা সম্পর্কের জাদুঘরে রয়ে গেছে তার সেই বটল ওপেনার আর চাবিটি…

(গান, যদি আকাশের গায়ে কান না…)

ইউরোপিয়ান মিউজিয়াম ফোরাম ২০১১ সালে এই জাদুঘরকে দিয়েছে ‘কেনেথ হাডসন’ পুরস্কার। এই পুরস্কার দেওয়া হয় সেই সমস্ত সংগ্রহশালা বা প্রকল্পকে, প্রচলিত চিন্তাভাবনার বিপরীতে গিয়ে যারা নতুনভাবে ভাবতে চেষ্টা করেছে। ২০১৬ সালে এই জাদুঘরের একটি শাখা তৈরি হয়েছে লস অ্যাঞ্জেলসে। এই জাদুঘর সম্পর্কে ইউরোপিয়ান মিউজিয়াম ফোরামের বিচারকরা বলেছেন, এই জাদুঘর শুধু মানুষের সম্পর্কের ভঙ্গুরতার কথাই বলে না, সম্পর্ক ভাঙার পেছনে যে রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত, তাকেও চিহ্নিত করে। একান্ত ব্যক্তিগত এক একটা জিনিসের মধ্যে দিয়ে আমরা চিনে নিচ্ছি সময়বিশেষে এক একটা দেশ বা সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলোকে।

দৃশ্য-৩

ছেলেটি— সরি!
মেয়েটি— হোয়াট!
সব কিছু ঠিকঠাক যাচ্ছিল না। মেয়েটি ভেবেছিল হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু হল না। এক সকালে ছেলেটি হঠাৎ জানাল…

ছেলেটি— আই অ্যাম ফল ইন লাভ উইথ সামওয়ান এলস, আমি অন্য কাউকে ভালবাসি।
চলে গেল ছেলেটি ব্যাগপত্র গুছিয়ে, অন্য মেয়েটির সঙ্গে থাকবে বলে। বাড়িটা ছেলেটারই, আসবাবগুলো ওদের একসঙ্গে একটু একটু করে কেনা। ছেলেটি বলে গিয়েছিল ইচ্ছে করলে মেয়েটি সেখানে থাকতে পারে।

(মেয়েটির চিৎকার)

হাতের কাছে থাকা কুড়ুল দিয়ে সেই সব আসবাব ফালাফালা করে দিয়েছিল মেয়েটি।

(নীরবতা)

কয়েকদিন পর নাকি ছেলেটি এসেছিল, আর সমস্ত ভাঙা কাঠ সযত্নে গুছিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে।

(গান, সে চলে গেলেও থেকে যাবে তার…)

সম্পর্কের অনেক রূপ, অনেক নাম। সম্পর্ক ভাঙার কারণ ও দর্শনও বিচিত্র। সব মিলিয়ে এই জাদুঘর হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবনের এক পাঠশালা। সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞানের অনেক বইয়ের প্রায়োগিক পাঠ পাওয়া যাবে এখানে। তত্ত্ব আর তথ্যে ভরা বই অনেক সময়ই রসকষহীন, কিন্তু এই সংগ্রহশালায় পাওয়া যাবে প্রাণের পরশ।

দৃশ্য-৪

১৯৬০, বার্লিন। ওরা দুজন দুজনকে ভালবাসত, দুজনের রাজনীতি ছিল ভিন্ন, দুজনের মত, পথ ছিল ভিন্ন, কিন্তু ভালবাসায় কোনও ফাঁকি ছিল না। ওরা একসঙ্গে থাকতে চেয়েছিলে। ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি আর ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব জার্মানি, মানে, পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্যে উঠল পাঁচিল। ওরা আলাদা হয়ে গেল। মেয়েটির সঙ্গে রয়ে গেল ছেলেটির কোট, ডায়েরি, জলের বোতল, চশমা। আর ছেলেটির কাছে রয়ে গেল মেয়েটির স্কার্ফ, পেন, পারফিউম আর কয়েকটা গয়না। আর অনেক অনেক স্মৃতি। শুধু ওরা নয়, বার্লিনের এই প্রাচীর বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল বহু পরিবারকে। ২৮ বছরের বার্লিন প্রাচীরের ইতিহাসে এপার থেকে ওপারে যাওয়ার পাঁচ হাজারের ওপর ঘটনা ঘটে, আর সে চেষ্টা করতে গিয়ে মারাও গিয়েছিলেন বহু মানুষ। প্রথম মৃত্যু ১৯৬২ সালের ১৭ আগস্ট। পিটার ফ্লেচার নামে আঠারো বছর বয়সী এক তরুণ পাঁচিল টপকে এপার থেকে ওপারে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে গুলি খেয়ে পড়ে থাকেন নো ম্যানস ল্যান্ডে, মিডিয়ার সাংবাদিকদের সামনেই অত্যাধিক রক্তক্ষরণের ফলে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। আর সবশেষ মৃত্যু ১৯৮৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। নাহ্ ওরা অবশ্য পাঁচিল টপকানোর চেষ্টা করেনি, কিন্তু ২৮ বছর পরে ১৯৮৯-এ হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ প্রতিবাদ আর বিদ্রোহে যেদিন প্রাচীরের পতন হয়, সেদিনের সেই উৎসবমুখর বার্লিনে যখন তাদের দেখা হয় তখন তারা দুজনেই অ্যালঝাইমার রোগাক্রান্ত, কেউই কাউকে চিনতে পারছে না আর…

মেয়েটি— তারপর?
তারপর শেষ হল তিন দশকের অজ্ঞাতবাস।
সে আমাকে দেখে ডুকরে উঠল
আমি তাকে দেখে চমকে উঠলাম
তার চোখে উপুড় হয়ে আছে দুটো মরা ভ্রমর।
আমি ভিজে বাতাসের মত জিজ্ঞেস করলাম,
তোমাকে কাঙাল সাজাল কে?
সে পাতা ঝরার শব্দে জানাল

ছেলেটি— স্বপ্নের দরজা খুলে দিয়েছিলাম যাকে—

(গান, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা…)

আদর্শ সম্পর্কের সংজ্ঞা কী? কেউই বোধহয় সেকথা ঠিক করে গুছিয়ে বলতে পারবেন না। কারণ সংজ্ঞার গণ্ডিতে তাকে বাঁধা যায় না। আদর্শ সম্পর্কের কথা বলতে গেলে অনেকেই হয়তো বলবেন সম্পর্কের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা দরকার, দুজন দুজনের সম্পর্কে সবটুকু জানা দরকার। একেবারে জলের মতো স্বচ্ছ। টোকিওর এক জুটির মত কিন্তু ভিন্ন—

দৃশ্য-৫

ছেলেটি ছিল মুখচোরা, মেয়েটিকে ভাল লাগা সত্ত্বেও বলতে পারেনি। এক বড়দিনের ভোরে সে দেখে তার বালিশের নিচে একটা চিঠি, যা লেখা হয়েছে একটা ছবির বইয়ের প্রথম পাতায়।

(কানামাছি)

তারা প্রতিবেশী। মেয়েটি তখন একমুখ দুষ্টু হাসি নিয়ে এসে উপস্থিত। ছেলেটি ভীষণ খুশি।
কত কিছু বলার আছে, কিন্তু বলতে পারিনি। আজ তুমি সেই বরফ গলিয়েছে।

মেয়েটি— আমরা কতদিন নদীর জলে হাঁস হয়ে সাঁতার কেটেছি—
আমি কষ্ট পেলে তুমি দুঃখ পেয়েছ
তুমি কষ্ট পেলে আমি দুঃখ পেয়েছি
তবু—

হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়
একথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়!

তুমি আমায় সুখ দেবে তা সহজ নয়
তুমি আমায় দুঃখ দেবে সহজ নয়

দারুণ জমে উঠেছিল সেই প্রেম।
প্রচুর গল্প, বিস্তর আড্ডা। কিন্তু রংমশাল যেমন দারুণ আলো ছড়িয়ে বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়, সেই প্রেমও তেমনই নিভে এল। দুজনেই দুজনের কাছে কোনও দেওয়াল রাখেনি, একে অন্যকে বড় বেশি জেনে ফেলেছিল। আগ্রহও উবে গিয়েছিল তাই। বিচ্ছেদের অনেক পরে সেই চিঠি আর সেই ছবির বই এখন এই জাদুঘরে। এই স্মৃতি নিশ্চয়ই আজও তাদের ভাবায়, কারণ ওই বইয়ের এক কোণে লেখা আছে—

মেয়েটি— বিদায় প্রথম প্রেম, স্বাগত মহাপৃথিবী—

(গান, তোমায় পাচ্ছি কই…)

সম্পর্কের অনেক নাম, অনেক রূপ। এখানে শুধু প্রণয় সম্পর্কের কথাই বলা নেই। একটা সুন্দর পুতুল রয়েছে, মা ব্যাঙ ছানা ব্যাঙ-কে কোলে নিয়ে বসে আছে। তার তলায় লেখা, এই পুতুলটা মা আমাকে দিয়েছিল বড়দিনে। আমার তিন বছর বয়সে মা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল—

দৃশ্য-৬

আমস্টারডাম, ১৯৫৯। ওরা দুজন ছিল খুব কাছের বন্ধু। একসঙ্গে একটা খালে স্নান করতে গিয়ে কানমলা খেয়েছে। কখনও ঝগড়া মারামারি করে মেয়েটি পেনের খোঁচায় গভীর ক্ষত করে দিয়েছে ছেলেটির পিঠে, ছেলেটিও কামড়ে দাগ করে দিয়েছে মেয়েটির কাঁধে। শাস্তি হিসেবে স্কুলের পুরো ছুটিটা মেয়েটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল খিটখিটে এক পিসির সঙ্গে থাকতে। ওদের দুজনের বয়স যখন পনেরো, তখন ছেলেটি তার বাবা-মায়ের সঙ্গে জার্মানি চলে গেল। অনেক চোখের জল ফেলে দুজন দুজনকে কথা দিয়েছিল, প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখবে। পরে, কোনও একদিন বিয়ে করবে ওরা। তা আর হয়নি। জীবন দুজনকে নিয়ে গিয়েছে পরস্পরের থেকে বহু দূরে। জীবনের নানা বাঁকে ঘা খেয়ে মেয়েটি তখন পেশা করেছে দেহব্যবসাকে। একদিন এক অন্যরকম খদ্দের এল তার কাছে— সে পীড়িত হতে, চাবুক খেতে চায়।
ছোটবেলায় আমার মা আমাকে জুতো দিয়ে পিষত, আর বাবা মারত চাবুক। সেই অনুভূতি আমি ফিরে পেতে চাই।

(মিউজিক)

মেয়েটি— এ কীসের দাগ?
ছেলেটি— ছোটবেলায় বন্ধুর সঙ্গে খেলতে গিয়ে—
মেয়েটি— মনে পড়ে তাকে? চিনতে পারো? তোমার সেই ছোট্টবেলার খেলার সঙ্গীকে?
ছেলেটি— আমার প্রথম বিয়ে ভেঙে গেছে, দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছি। আমি চাই না সেই বিয়েও ভেঙে যাক।
মেয়েটি— যোগাযোগ রেখো না, ভুলে যেয়ো—
ছেলেটি— পারবে না যে। তোমার ওই এক পাটি জুতো দেবে? আমি রেখে দেব আমার কাছে!

মেয়েটি— ভাঙা সম্পর্কের এমনও কিছু চিহ্ন থাকে যা কোথাও সংগ্রহ করে রাখা যায় না, যা আমরা বয়ে বেড়াই আমাদের শরীরে, আমাদের মনে—

(গান, এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধু, সায়ান)