নাটক, লোকসংস্কৃতি ও আমার অভিজ্ঞতা | মলয় ঘোষ

লোক সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে নাট্যচর্চার সূত্রপাত বহুকাল আগে থেকেই। এটা প্রকৃতার্থেই একটি ভালো দিক। ভাদু, গম্ভীরা, লেটো, কবিগান ইত্যাদি নানা লোক সংস্কৃতির নানা বিষয় নিয়ে অনেক নাটক তৈরি হয়েছে, হচ্ছেও। বলা বাহুল্য এ সব নিয়ে তৈরি নাটকগুলি সর্বার্থেই কিন্তু সফল হয়ে উঠছে না। কারণ এই সব ক্ষেত্রে নাটক নির্মাণের কিছু সুবিধা, অসুবিধা দুই-ই দেখা যায়।
সুবিধা এই যে ক্রমহ্রাসমান লোক সংস্কৃতির নানা বিষয় সাধারণ মানুষের কাছে নাটকের মাধ্যমে প্রকাশ করলে তা বেশ খানিকটা চমক সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। লোক সংস্কৃতি নিয়ে খুব আগ্রহী না হলেও এক শ্রেণির দর্শক লোক সংস্কৃতি আশ্রিত নাটক দেখতে খুব আগ্রহ প্রকাশ করে। তাই অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে ওঠে নাটকের বিস্তার ও সহজ- জনপ্রিয়তা লাভের পথ। আর এ ক্ষেত্রে প্রধান অসুবিধা হলো, লোক সংস্কৃতির যে বিষয়টি নিয়ে নাটকটি গড়ে ওঠে সেই বিষয়টিতে দক্ষ ও বিশেষ পরিচিত না হয়েই নাটকের নির্মাণ সম্পূর্ণ করার দিকে তড়িঘড়ি এগোতে গিয়ে বিপত্তি তৈরি হওয়া। এর থেকে বেড়িয়ে যাবার সহজ রাস্তাও আছে, রাস্তাটি হলো, এক জন লোকসংস্কৃতি শিল্পীকে নাটকের অভিনয়ে ঢুকিয়ে নিয়ে কাজটিকে চালিয়ে নেওয়া। ব্যাস তাহলেই কেল্লাফতে। লোকসংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা ও সংযুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে নাটক নির্মাণ এবং নাট্যদলের কুশীলবদের নাট্যবিষয় (লোক সংস্কৃতির যে বিষয়ে নাটক হচ্ছে) নিয়ে সদার্থক ধারণা ও প্রশিক্ষণের সঠিক আয়োজন না হলে গোটা বিষয়টি যে হালকা হয়ে যায়, তা অনেকেই কিন্তু বুঝেও বুঝতে চান না। দ্রুত নাটককে জনপ্রিয় করতে গেলে এই বুঝেও না বোঝার ভানটা বড় প্রয়োজন। ফলত, লোক সংস্কৃতির উপর সুবিচার তো হয়ই না, বরং সস্তা চটক-কে প্রশ্রয় দেওয়া হয় সুকৌশলে। এই ধারার লোকো-নাটকই সব থেকে বেশি সুলভ বাংলা নাট্যক্ষেত্রে।

এ প্রসঙ্গে অনধিকার চর্চা না করে নিজেদের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, অর্থাৎ নিজের অভিজ্ঞতার ঢাক কিঞ্চিৎ বাজিয়ে নিই, তাহলে লোকসংস্কৃতি ও নাটকের পারস্পরিক সম্পর্কের নির্মাণ বিষয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে।
বহুকাল থেকে কবিগান শোনার এবং কবিয়ালদের সঙ্গে সংস্পর্শের অনেক দুর্লভ মুহূর্ত সঞ্চয়ে থাকার পর হঠাৎ এক কবিয়ালের সঙ্গে আলোচনায় কবিগান নিয়ে নাটক লেখার ইচ্ছা হল। কবিগান নিয়ে নাটক মানেই এন্টনী ফিরিঙ্গী, ভোলা ময়রা-র মত কবিয়ালদের জীবনী নিয়ে নাটক নয়। বিখ্যাত কবিয়ালদের জীবনের পাশে সাধারণ কবিয়ালদের জীবনী নিয়ে সাধারণ একটি নাটক। বিভিন্ন কবিয়ালের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চলতে থাকল, বুঝতে থাকলাম কবিগানের নাটকে কনফ্লিক্টটা কীভাবে তৈরি হবে…। আসলে লোকসংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিকতার যে সংঘাত, আধুনিকতা যেভাবে লোকো আঙ্গিককে গিলে খেয়ে নিজের পুষ্টি বৃদ্ধি করছে আর ক্রমশ লোকসংস্কৃতির শুদ্ধতাকে বিনিষ্ট করছে, তার স্বরূপ উন্মোচন করতে গেলেই তো নাটকের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। আজ কত আধুনিক গানের সুর যে লোকো সুর থেকে আধারিত তার ইয়ত্তা নেই। তাতে অসুবিধা নেই, কিন্তু মূল সুরের উৎস যখন ক্রমশ হারিয়ে যায়, আর আধারিত সুরটি যখন ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে তখন কোথায় একটা বেদনার উৎসমুখ খুলে যায় নীরবে।

আমি নাটকের অনুসরণীয় চরিত্র হিসেবে সামনে রাখলাম চাঁদ মহম্মদকে। কবিগানের পালা বাঁধা আমার কাছে কঠিন ছিল না। মূলত পাঁচালির একটা দুটো সুরকে ভিত্তি করে গান লিখলাম। মোটেও অনিল বাগচির সুরের ধারায় নির্ভর করলাম না। আসলে অনিল বাগচি লোকো আঙ্গিক আর আধুনিক সঙ্গীতের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন তাঁর সুরে, যা এন্টনী ফিরিঙ্গী ও ভোলা ময়রা ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। বোল-কাটাকাটি বিষয়টি কে আমরা অন্যভাবে নিয়ে এলাম পালায়। এরপর এল বাজনার বিষয়। আমাদের নাট্যদলের প্রলয়, যে বাজনায় বেশ ভালো, তাকে কবিগানের বিশেষ ভঙ্গীতে বাজানোর জন্য তালিম নিতে পাঠানো হলো। সাধারণ দাদরা, কাহারবাকেই কীভাবে কবিগানে ব্যবহার করা হয়, সেবিষয়ে সে অনুশীলন শুরু করল। কাঠির ব্যবহারও শিখল। এরপর আমরা কবিগানের ধরনধারণ ও ইতিহাস নিয়ে শুরু করলাম আলোচনা। বেশ কিছু দিন এই আলোচনা চলার পর নাটকের মহড়া শুরু করলাম।

নাটকের স্ক্রিপ্টটা সুন্দরম আয়োজিত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল ২০১৬ সালে। সে কারণে কিছুটা মানসিক জোর ছিল। কিন্তু তাই বলে বলব না, আমাদের এই লোকসংস্কৃতি মূলক নাটকটি খুব ভালো একটি প্রযোজনা। অথচ এ নাটকটি উপস্থাপিত করতে পেরে আমরা খুশি ও তৃপ্ত সেকথা আমরা স্বীকার করি নির্দ্বিধায়। বীরভূমের লাভপুরের ‘দিশারী সাংস্কৃতিক চক্রে’ ‘ডাকহরকরা’ নাটকে ভাঁজো গানের একটি দৃশ্য আছে অসাধারণ। এত সুন্দর উপস্থাপন এবং এত দক্ষতায় তাকে প্রাণবন্ত করা… এককথায় অনন্য।

আসলে নাটকে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিককে ব্যবহার, এবং তাকে আরোপিত না মনে করানোটাও খুব সহজ নয়। রামীচণ্ডীদাস গীতিনাট্যে যেভাবে খেউরের প্রয়োগ আছে, ঠিক সেইভাবে কোনও কোনও নাটকে অনবদ্যভাবে লোকসংস্কৃতির নানা বিষয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থাপিত হয়, যা প্রকৃতার্থেই লোকসংস্কৃতির জাগরণ বা অনুশীলনের পথকে প্রসারিত করে স্বাভাবিক ও সহজ বিশ্বাসে। সেই রকম নাটকের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়, তার বিস্তারিত আলোচনা অন্য এক প্রসঙ্গে করার ইচ্ছা রইল।

34 thoughts on “নাটক, লোকসংস্কৃতি ও আমার অভিজ্ঞতা | মলয় ঘোষ

  1. দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় মাননীয় মলয় ঘোষ মহাশয়ের প্রবন্ধখানি পাঠকদের সমৃদ্ধ করবে।
    আগামী সংখ্যার লেখা পড়ার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

    1. খুবই ভালো লাগল। এমন সোজা কথা বলার মানুষ কম। এখন লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা নাটকের মানুষ নিয়েছে ঠিকই কিন্তু আপনার মূল‍্যায়ণ সঠিক। ভালো থাকুন। আমাদের ডাকহরকরা নাটকে ভাঁজোর প্রয়োগ আপনার ভালো লেগেছে জেনে আপ্লুত

    1. খুব সুন্দর লাগল। তবে লোকসংস্কৃতি বিষয়ে নাটক করার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রশিক্ষণ বিষয়ে আলোচনা থাকলে ভাল লাগত।

  2. লোকসংস্কৃতি নিয়ে নাটক করতে গিয়ে অনেকেই যেমন ব্যর্থ হয়েছে, তেমনই সফলও হয়েছে অনেকে।অনেক আগে বহরমপুর প্রান্তিক প্রযোজিত “নানাহে”নাটকের কথা মনে পড়ে।চমকে উঠেছিলাম এ নাটক দেখে।অনবদ্য মনে হয়েছিল।বছর চারেক আগে বাংলাদেশে শিল্পকলা আকাদেমিতে বাংলাদেশের একটি দলের লেটোগানের ওপর একটা নাটকও বিস্মিত করেছিল।সে নাটকে অন্যতম চরিত্র
    হিসাবে ছিল নজরুল ইসলামের চরিত্র।পরে শুনলাম, নাটকটা করার আগে তাঁরা দীর্ঘ সময় চুরুলিয়া এসে বিভিন্ন লেটোদলের সঙ্গে যোগাযোগ করে লেটো গান শিখেছিলেন।তবে লোকসংস্কৃতিকে নাটকে আনার প্রবণতাটা প্রশংসাযোগ্য।কিন্তু তার আগে সেই বিষয়ে ধারণাটা গড়ে নিতে পারলে যে কোন দলেরই এমন কাজ করার সুবিধা।মলয় তার প্রবন্ধে সেরকম কিছু জরুরি কথা বলেছে।যা আমাদের সবার কথা।

  3. খুব ভালো লাগলো, লোকসংস্কৃতি নিয়ে নাটক এই ব্যাপারটা সম্পর্কে অনেকটা জানলাম। লাভপুর দিশারী সংস্কৃতিক চক্রে থাকার সময় পার্থ দার নির্দেশেনায় ডাকহারকরা নাটকে অভিনয় করার সুযোগে প্রথম ভাঁজো গানের সম্পর্কে জানতে পারি। আপনার লেখা আমাদের সবাইকে রিদ্ধ করবে।

  4. মলয় দা ধন্যবাদ। অমল আলো জার্নালের জন্য কলম ধরেছো বলে। দারুণ শুরু।

Comments are closed.