এই মহামারির মতোই অতর্কিতে গত ৮ ডিসেম্বর, ২০২১ আঘাত এনেছিল আমাদের সকলের প্রিয় অভিনেতা, নিদের্শক, থিয়েটারের অন্যতম সংগঠক ‘ইছাপুর আলেয়া’-র প্রাণপুরুষ প্রিয় শুভেন্দু মজুমদারের হৃদযন্ত্র। তারপর ১৪ দিনের প্রাণপণ লড়াই করেও তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসতে পারেননি, কিন্তু শুভেন্দু জড়িয়ে আছে আজও, থাকবেন বাংলা থিয়েটারের নিরন্তর চর্চায় আগ্রহী ‘ইছাপুর আলেয়া’-র ও অন্যান্য দলের একাধিক প্রযোজনার স্মৃতিনির্ভর উজ্জ্বল নাট্যমুহূর্তের বন্ধনে সমস্ত নাট্যমোদীর হৃদয়ে।
ফুটবল খেলা চলছে। মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছেন একজন মাঝবয়সি।লক্ষ্য রাখছেন একদলের গোলকিপারের দিকে। তার গোলরক্ষায় মুগ্ধ মানুষটি অপেক্ষা করছেন কখন খেলা শেষ হবে। শেষ হওয়া মাত্র তিনি গোলকিপারের হাত চেপে ধরে ছুট লাগালেন। না, কোনো বড়ো দলে খেলানোর জন্য নয়, তাঁর নাট্যদলে অভিনয় করানোর জন্য। ফুটবল খেলার পাশাপাশি এ ছেলে যে বেশ অভিনয় করতে পারে, গলা ছেড়ে গান গাইতে পারে। আর ফুটবল মাঠে গোলকিপার হওয়ার দরুন মাঠ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো নিজ দলের খেলোয়াড়দের নির্দেশ দিতে পারে — পজিশান, পজিশান। মাঝবয়সির হাতের টানে সঠিক সময়ে সঠিক পজিশন নিতে পেরেছিলেন বলেই বাংলা থিয়েটার পেয়েছিল নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা সংগঠক শুভেন্দু মজুমদারকে।
ইছাপুরের ভূমিপুত্র শুভেন্দুর প্রাথমিক শিক্ষা নবাবগঞ্জ ব্রজমোহন বঙ্গ বিদ্যালয়ে। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় ‘অবাক জলপান’ নাটকে তাঁর অভিনয়ের হাতে খড়ি ১৯৭৪ সালে। পাড়ায় প্রতিবছর বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে নাট্যাভিনয় হতো। বাবা সুধাংশু নারায়ণ মজুমদার সেসব নাটকের উদ্যোগী ও নির্দেশক। বাবাই তাঁর অভিনয়ের দীক্ষাগুরু।
শৈশব থেকেই ফুটবল অন্তপ্রাণ প্রত্যেকটি বিকেলের দখল নিয়েছিল সবুজ মাঠ। খেলতে খেলতে কবেই যেন বারপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে দলকে বিপদন্মুক্ত করার দায়িত্ব নিয়ে ফেললেন। ১৯৮০ তে মাধ্যমিক পাশ করার পর ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। যুক্ত হলেন ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের সাথে। তখনও নিয়মিত খেলা ও মাঝে মধ্যে নাটক চলছে। ১৯৮২ তে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর অর্থ রোজগারের কারণে মাত্র সতের বছর বয়সে পড়াশুনায় ইতি টেনে উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদে Moradabad Development Authority-তে কর্মজীবন শুরু করেন। নাটক করতে না পারার যন্ত্রণা কুরে- কুরে খাচ্ছে তখন তাঁকে। হাতছানি দিচ্ছে সবুজ মাঠ। ছেলেবেলা থেকেই গান ছিল তার সঙ্গী। মোরাদাবাদের দিনগুলো ভরিয়ে দিত তাঁর জাদুকড়ি কন্ঠের গান। বছর দুই যেতেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হল মোরাদাবাদে। দাঙ্গার আবহ সহ্য করতে না পেরে তরুণ শুভেন্দু চাকরি ছেড়ে চলে এলেন ১৯৮৪ তে। কিন্তু জীবনের চাপে পুনরায় চাকরি নেন কলকাতায় Bhatra Group of Industries এ। ভেবেছিলেন দিনে চাকরি সামলে রাতে থিয়েটার করবেন। কিন্তু বিধি বাম। চাকরির স্বার্থে Draftsmanship (Civil) কোর্সে সান্ধ্যবিভাগ ভর্তি হতে হল Royal Engineering কলেজে। চাকরির প্রচণ্ড চাপ সামলে ৮৭তে কৃতিত্বের সঙ্গে শেষ করেন এই কোর্স। চাকরিতে উন্নতি ঘটে। এত চাপ সত্ত্বেও হৃদয়ের তাগিদকে উপেক্ষা করতে পারলেন না। ১৯৮৬ তে আবার শুরু করলেন অভিনয়। বাবা সুধাংশু নারায়ণ মজুমদারের নির্দেশনায় ইছাপুর অরবিন্দ গ্রন্থাগারের আহ্বানে অভিনয় করতে থাকলেন — ফাঁস, দমকল, দিনান্তে, খ্যাতির বিড়ম্বনা, ভীমবধ, এদের রাখব কোথায়? ইত্যাদি নাটকে।
পাড়ায় তরুণ শুভেন্দুর অভিনয়ে মুগ্ধ সন্তোষবাবু প্রায় জোর করেই শুভেন্দুকে আলেয়াতে নিয়ে এলেন। আততায়ী, সংবতি, কিরাত নাটকে অভিনয় করলেন। ইছাপুর নবাবগঞ্জ সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে একাঙ্ক নাট্য প্রতিযোগিতায় ‘আততায়ী’ নাটকে শুভেন্দুর অভিনয় দেখে আপ্লুত বিচারক অসীম ত্রিবেদী পরদিনই সাইকেল চালিয়ে খুঁজতে খুঁজতে চলে এলেন তাঁর প্রিয় অভিনেতার বাড়ি। অভিনয়ের খুঁটিনাটি নিয়ে উৎসাহিত করলেন তাঁকে। আরও বেশি অভিনয় করার তাগিদে ১৯৮৮ সালে যোগ দিলেন ‘ক্যালকাটা কোরাস’ নাট্যদলে। সঞ্জয় গুহ ঠাকুরতার নির্দেশনায় — তিমিঙ্গিল,অন্তিগোনে, যুধিষ্ঠির নাটকে অভিনয় করলেন।
দেখতে দেখতে এসে গেল ১৯৯০। আলেয়ার নাট্যচর্চার বেগ তেমন গতি পাচ্ছে না দেখে মূলত সন্তোষ ব্যানার্জীর উদ্যোগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল নবীন প্রজন্ম শুভেন্দু মজুমদার এবার থেকে যাবতীয় নাটকের নির্দেশনা দেবেন। এরই মধ্যে পুত্রের অনুসৃত পথে পিতা সুধাংশু নারায়ণও যোগ দিলেন এই কর্মকাণ্ডে। সঙ্গে এক ঝাঁক তরুণ-যুব-নাট্যপ্রেমী। এই পর্বের প্রথম নাটক সমর চট্টোপাধ্যায়-এর নেপথ্যে। পিতা-পুত্রের যুগলবন্দী এ নাটক। পরবর্তীতে শুভেন্দু একে একে নির্দেশনা দিলেন ও অভিনয় করলেন — রবীন্দ্রনাথ, পাঁচিল, হে অশ্বারোহী, কল্পলোকের গল্প, নৈকষ্য নিশুতে, এসো সকাল, সুচেতনার জন্য, পাগল, গ্রন্থি, রুদ্রপ্রবাহ, জলরঙে দুর্গা, প্রদোষকাল, ইচ্ছেডানা, নিজস্ব দু’চোখ, শূল, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, কন্ডিশনস্ অ্যাপ্লাই, অবরোধ, নন্দলাল, অবিচ্ছেদ্য, e-মানবিক, তমসা সহসা, 6:1, স্পর্শ, পাসওয়ার্ড নাটকে। সঙ্গীতা চৌধুরীর নির্দেশনায় অভিনয় করলেন — আপনঘরে পরের আমি, তানিয়া ও জাতক। সমর চট্টোপাধ্যায়, অসীম ত্রিবেদী, সন্তোষ ব্যানার্জী, সোমনাথ খাঁ, শ্যামল ভট্টাচার্য, সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়, বিজয় ভট্টাচার্য, মৈনাক সেনগুপ্ত, তীর্থঙ্কর চন্দ, ঝিলম ত্রিবেদী ও সঙ্গীতা চৌধুরীর নাটকের সফল নির্দেশনা দিয়েছেন, অভিনয় করেছেন। আলেয়ার শিশুদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন — টিট ফর ট্যাট ও ভীম বধ।
আলেয়াতে নির্দেশনা-অভিনয়ের পাশাপাশি ১৯৯৩ সালে হাওড়ার ‘শপথ’ নাট্যদলে যুক্ত হন শ্যামল ভট্টাচার্য-র কাছে নাটকের শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে। শ্যামলবাবু অসীম ত্রিবেদীর জ্বেলে দেওয়া আগুনকে উস্কে দিয়ে আরও শক্তিশালী করেন তাঁর নবীন ছাত্রকে। শ্যামল ভট্টাচার্য-র নির্দেশনায় এখানে অভিনয় করলেন — ভাঙন , রাজভূত ও পথনাটক জাগতে রহো-তে। ‘চোখ’ নাট্যদলে অভিজিৎ করগুপ্ত-র নির্দেশনায় অভিনয় করলেন অন্তঃসলিল। কিন্তু আলেয়া ছেড়ে বাইরে গিয়ে অভিনয় করে তাঁর সৃষ্টি-সত্ত্বার বিকাশ ঘটছিল না। বুঝতে পারছিলেন নিজের দলের ক্ষতি হচ্ছে যেমন, তেমন অনেক ক্ষেত্রে তাঁর ঊর্যাকে দলগুলি সঠিক ব্যবহার করতে পারছে না। মনস্থির করলেন আর নয়, এবার ঘরে ফেরার পালা, আলেয়াকে গড়েপিঠে থিয়েটারক্ষেত্র গড়ে তোলাই তাঁর কাজ।
২০০৪ সালে ‘নটধা’ নাট্যদল , সারা বাংলা শিল্পী সমন্বয়ে আয়োজন করল শিব মুখোপাধ্যায়-এর নির্দেশনায় ‘মহাভারত’ প্রযোজনা। বিভাস চক্রবর্তী, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, সীমা মুখোপাধ্যায়, সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম মুখোপাধ্যায়, কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, দেবাশিস সরকারদের সাথে শুভেন্দু মজুমদারও আমন্ত্রণ পেলেন সেই প্রযোজনায় অভিনয় করার। সে সময়ে এই উদ্যোগ ভারতীয় থিয়েটারে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
সর্বক্ষণ থিয়েটারকর্মে যুক্ত থাকার উদ্দেশ্যে ২০১২ সালে চাকরি ছেড়ে প্রায় অনিশ্চিত জীবনে ঝাঁপ দিয়েছেন। থিয়েটারকেই পেশা করেছেন বলে নিজের দলের পাশাপাশি নির্দেশনা দিচ্ছেন ‘শ্যামনগর নাট্যবিতান’ দলে নিজের লেখা নাটক — ইনসানিয়াত ও বহ্নিমান ছাড়াও বনজোছনা, 6:1, প্রতিসরণ ও সামলে ধরুন এবং বর্ধমান বৈদ্যপুরের ‘নাট্যকর্মী’ দলে নতুন শ্রাবণ নাটকে।
সংগঠনের অধিকারে বিশ্বাসী মানুষটি স্থানীয় নাট্যদল নিয়ে গড়ে ওঠা ‘নাট্য মৈত্রী বন্ধন’-এর অন্যতম উদ্যোক্তা। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নাট্যদল নিয়ে সমন্বয় সমিতি করেছেন বহুবার। অন্যান্য নাট্যবন্ধুদের সহযোগিতায় সম্প্রতি গড়ে ওঠা ‘সমস্বর’ নাট্য সমন্বয়-এর ও অন্যতম কারিগর তিনি। ফুটবল মাঠের শেষ প্রহরী মানুষটি থিয়েটার ক্ষেত্রেও অতন্দ্র প্রহরায় থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিপন্মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়েছেন নিজদল সহ অন্যান্য নাট্যদলকেও।
নানাবিধ পু্রস্কারে ভূষিত মানুষটির সাংগঠনিক শক্তিকে সম্মান জানাতে বহরমপুর ঋত্বিক ইছাপুর আলেয়াকে ২০১৮ সালে সেরা সংগঠনের সম্মানে ভূষিত করে। এরই মাঝে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সদস্য পদ অর্জন করেন। সারা বাংলা জুড়ে তাঁর অভিনয়ে মাতোয়ারা অসংখ্য দর্শকের প্রশংসাকেই তিনি সর্বোচ্চ সম্মান বলে মনে করতেন। এখন পর্যন্ত আটত্রিশটি নাটকে তিনহাজারেরও বেশি অভিনয়ে অভিজ্ঞ, আজন্ম বামপন্থী, থিয়েটারে আপসহীন, পরোপকারী, বন্ধুবৎসল, নির্লোভ, আপাদমস্তক নাটুকে মানুষটি জীবনের খেলায় ইতি টানলেন ২১ ডিসেম্বর, ২০২১ মাত্র ৫৬ বছর বয়সে। জীবনযুদ্ধের অগ্রণী যোদ্ধা শুভেন্দু মজুমদার বাংলার থিয়েটারমোদীদের হৃদয়ে থাকবেন চিরদিন।
এক অতি প্রিয় মানুষের বিদায়, এক ঘন কুয়াশায় নিয়ে যায় আমাদের। চারপাশকে দেখা যায় না একদম।