দীপা ব্রহ্ম
‘নৃত্যের তালে তালে হে নটরাজ ‘
রবি ঠাকুর তাঁর সংগীতে যে তাল-লয়-ছন্দের গ্রন্থনা করেছেন তাঁর আবেদন চিরন্তন। যুগান্তরের পিয়াসী। নৃত্যে তাঁর ‘মুক্তির রূপ’, নৃত্যে তাঁর “মায়া”। নটশ্রেষ্ঠ নটবর শিব-এর এই পদ চালনা মানবজীবনে নানা রূপে, নানা অনুষঙ্গে বার বার এসেছে। প্রান্তিক থেকে নাগরিক প্রত্যেক জীবনের আখ্যানে বন্দি করেছে অজানা সব বক্তব্য। এমনই এক নাচ-নাটুয়া। বলা যেতে পারে, এ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলাতেই এ নামের প্রদর্শন বেশি হয়। অনেকে বলেন ছৌ-এর অভিভাবক নাটুয়া ছৌ-এর শরীরী কসরতের ছায়া মেলে নাটুয়ায়। তবে ছৌ-এর মতো মুখোশ এ নাচে নেই। পরনে মালেকোচা ধুতি, গায়ে উলকি নকশা, হাতে নানা রঙের কাপড়ের টুকরো বেঁধে এ নাচে অংশ নেন এ অঞ্চলের মানুষজন। এ নাচে বহু কসরত লক্ষ করার মতো। আছে নানান ভয়াবহ কর্মকাণ্ড। আগুন খাওয়া, আগুনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া, গরুরচাকা গলায় দিয়ে নানা ভঙ্গি, পায়ের দ্রুত-ধীর ও দীপ্ত চালনা করতে করতে এগিয়ে যান নাটুয়া শিল্পীরা। ধামসার গুরুগম্ভীর বাদ্যের সঙ্গে মাদল থাকে, থাকে সানাই-এর তীক্ষ্ণ সুর, থাকে ঢাকের বজ্র নিনাদ আর থাকে এক ধরনের মুখে বাজানোর মতো যন্ত্র, যার নাম ‘মদন ভেরি’।
নাটুয়ার ইতিহাস ৬০০ থেকে ৭০০ বছর আগের। বীর রসাত্মক এই নাচে প্রায় ৯ থেকে ১১ জন অংশ নেন। বাজনাদাররাও এর মধ্যেই সামিল। মূলত চড়ক পুজোকে ধরে এ নাচ হয়ে থাকে। তবে এখন নানা উৎসব, মেলা, বিয়ে, পুজোতেও এ নাচ করতে দেখা যায় শিল্পীদের। নাটুয়ার সঙ্গে যে মানুষটির নাম জড়িয়ে তিনি হাঁড়িরাম কালিন্দী। পুরুলিয়ার বলরামপুরের পাড়দ্দা গ্রামে তাঁর বাস। তাঁর জীবনের সঙ্গে তাঁর গ্রামে পৌঁছানোর নকশা একই রেখায় রেখায় চলে। সাড্ডোল চেহারার খাঁজে খাঁজে অভিজ্ঞতার শক্ত বুনট। লেডু ঝালিন্দীর ছেলে, বুধু কালিন্দীর নাতি তিনি। বরাবর এ নাচকে ভালোবেসে ভালো আছেন। এই নাচই তাঁর ধ্যান। সংসারে টানটোন এসেছে। তবু ছাড়েননি। তাঁর বিশ্বাস আমাদের এ শরীরের মাধ্যমে যেটুকু প্রকাশ পাবে নাটুয়ার নাচের মাধ্যমে সে ভঙ্গীর প্রকাশ ঘটান ঈশ্বর। চাকরির নিরাপত্তা তাঁকে বাঁধতে পারেনি। শিশুর মতো অবুঝ মনে আনন্দ পেয়েছেন নাচ করে। হাল আমলের আর এক শিল্পী অভিমন্যু কালিন্দী। তাঁর বাড়ি আরশা কদমপুরে। তাঁর দলের নাম শিবশক্তি নাটুয়া নাচ সম্প্রদায়। তিনি এই দলের ওস্তাদ বটে। ৯ জন সদস্য নিয়ে নাটুয়া দেখিয়ে বেড়ান পুরুলিয়া ও আরো দুরের গ্রামে, শহরে। বছর ৩৫-এর অভিমন্যু শুধু এ নাচ করেই দিন গুজরান করেন। মাসে প্রায় ৪-৫টা নাটুয়ার আসরে তিনি নাচেন। তাঁর নাচে আছে সেইসব ভয়াবহ খেলা। আগুনের শিখা নিজের মুখে নেওয়া, দাঁত দিয়ে তালে তাল রেখে ঘড়া তোলা, রিং-এর মধ্যে দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত। শরীর দুমড়ে মুচড়ে নানা ভঙ্গিতে বীরদর্পে চলে তাঁর আসর। অভিমন্যু কালিন্দী এখনকার সরকারের অনুদানের আওতায়। অনেক সরকারি প্রোগ্রাম করেন তিনি।
রাঙামাটির এক অখ্যাত নাটুয়া শিল্পীর কাছ থেকে নাটুয়া শিখেছেন তিনি। কথায় কথায় জানালেন তাঁর ইচ্ছের কথা। পুরুলিয়ার এই লোকনির্মাণটিকে তিনি আরো বেশি করে ছড়িয়ে দিতে চান নানান জনপদে। তিনি তাঁর দুই ছেলেকেও এ নাচে যুক্ত করেছেন। চড়িদাতে তাঁর নাচের বহরে অনেক নামজাদা শিল্পীও পরাজিত হয়েছেন তাঁর কাছে। শিল্পী হিসেবে এ জয় কোথাও যেন খানিক যুদ্ধ জয়েরই নামান্তর। আরশা এমনই একটা জায়গা, যেখান থেকে একদিকে অযোধ্যা পাহাড়, অন্যদিকে গড়জাপুর, কোটশিলা এমন সব জনপদ। সদ্য পুরুলিয়া থেকে এসে বারবারই চোখের সামনে ভেসে উঠছে আরশার ওই মেঠো, ধুলো উড়োনো পথ, হেঁটে যাওয়া মানুষগুলো, তাঁদের বিশ্বাস, প্রেম-প্রণয়, পাওয়া-না পাওয়ার কাল্পনিক সিনেমাটিক ফ্রেম। বাকি জীবনটায় পরমাত্মাকে ছুঁতে ওই গ্রাম-প্রকৃতির মধ্যে বারবার থাকতে মন চাইছে। প্রকৃতি দেবীর মধ্যে দিনযাপনের ইচ্ছায় ‘শান পড়ছে’ বারবার।
এই মুহূর্তে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে ওই সরল মানুষগুলির সরল হাসি ধুসর হয়ে গেছে। ভৌগোলিক দূরত্ব ব্যবধান গড়েছে ঠিকই, তবে মনের ব্যবধান ঘুচোবে এ কার সাধ্যি। সে যে আপন বেগে চলে নদীর মতোই। শাল সেগুনের ভেসে আসা গন্ধ, আরশার পাথর ঘেঁষা জলস্রোতের অদ্ভুত আওয়াজে, তার হারিয়ে যাওয়া। কেউ যেন নিঃসীম অন্ধকারে। কানে কানে এসে বলে যায়, মন চল নিজ নিকেতনে।