গতকাল ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলা। একদিকে ইউরোপের ফ্রান্স অন্যদিকে ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা। একদিকে শক্তির ঘরানা। অন্যদিকে শিল্পের জাদুকরী মনন শীল ছন্দময় কবিতা। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং এর নতুন নাটকের ফাইনাল রিহার্সালের মুখোমুখি হবার জন্য। গত এক বছরে সোশ্যাল মিডিয়াতে বিজ্ঞাপনের ভিড়ে থিয়েটারের খোঁজ করতে করতে এক রকম হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। খালেদ চৌধুরীর কথাগুলো বারবার মনে পড়ছিল। গন্ডায় গন্ডায় নাটক হচ্ছে, শিল্প হচ্ছে কি? পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয়েছিল গ্রুপ থিয়েটারের শিল্পের সন্ধান। ৫ দশক ধরে কলকাতা ও তার বাইরে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের থিয়েটার দেখতে দেখতে আমার থিয়েটারি জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, শেখর চট্টোপাধ্যায়, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, আরো অনেকের মাস্টার ওয়ার্ক স আমাকে শিক্ষিত করে তুলেছিল। থিয়েটার দেখার চোখ খুজে পেয়েছিলাম। বলতে দ্বিধা করি না যে, হীরা চিনে নেবার জহুরীর চোখ অন্যদিকে আমাকে বারবার বিপন্ন করেছে। উৎকট নাটকীয় বিজ্ঞাপনের ভিড়ে ভাঙাচোরা কাচ দেখতে দেখতে বহুবার হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এইরকম মন নিয়ে কাল এবং এর নতুন নাটক নিখোঁজ শুভ্র আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করল, শিল্পের শুভ্রতা, শিল্পের গরিমা, শিল্পের প্রতি বিশ্বাস ও প্যাশন হারিয়ে যায়নি।
কাল রাতে মারাদোনা ও মেসির আর্জেন্টিনা রুদ্ধশ্বাস নাটকের মধ্য দিয়ে শিল্পের বিজয় রথ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এবং এর নতুন নাটক ও আশির দশকের মারাদোনা থেকে আজকের মেসি হয়ে ওঠা অনবদ্য কাহিনীর উন্মেষ প্রত্যক্ষ কারা গেল অন্য আরেক আখ্যানের মধ্যে দিয়ে। জন্ম লগ্ন থেকে এই দলটি শিল্পের প্রতি, ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধ। চোখ, বেদিনি, অন্ধ গলির রাজা, শ্মশান চাপা, আর এক হরবোলা, অমাবস্যায় চাঁদের আলো এমন অসংখ্য নাটক এরা পরিবেশন করেছে যা থেকে এই দলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রমাণিত হয়। সস্তা হাততালি, সস্তা জনপ্রিয়তা, অগভীর বিষয় কিংবা প্রতিযোগিতা স্পেশাল নাটকের প্রতি এরা কোনদিন আত্মসমর্পণ করেনি। কেন জানিনা আমার মনে হচ্ছে, নিখোঁজ শুভ্র নাটকটি এই দলের শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা হতে চলেছে। এক ঘন্টার পরিসরে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ডিটেইলিং এর প্রয়োগ সম্ভবত আমি আগে কখনো দেখিনি। এই নাটকের চরিত্রগুলো অভিনয় করে না। সংলাপ মুখস্ত করে আবৃত্তি করে না। সিনেমার অসংখ্য শট এর মত এই নাটকে এক একটি দৃশ্য আসে পরবর্তী দৃশ্যকে ধাক্কা মেরে অতিক্রম করে যায়। তারপর সৃষ্টি হয় এক একটি মনতাজ। চোখের সামনে আমি যেন সিনেমা দেখছিলাম। এক যুবকের যার নাম শুভ্র তার যৌবন থেকে যে কবিতা জন্ম নিচ্ছিল তার প্রেমিকা করুনাকে ঘিরে সেই যৌবন সেই জীবন যৌথ সংসারের মানবিক ব্যবস্থা থেকে কিভাবে বাজার অর্থনীতির চোরাবালিতে মুখ থুবড়ে পড়ে, এই মহাকাব্যিক আলেখ্য রচিত হয়েছে সমিত দাসের সুচারু প্রয়োগ ভাবনায়। এই নাটকে কোন পরিচালক নেই। যিনি রয়েছেন তাকে আমরা স্রষ্টা আখ্যা দিতে পারি। ঋত্বিক ঘটক এই ভাবেই তো বলতেন। আমরা কেউ পরিচালক নই। আমরা স্রষ্টা। তিনি আরো বলতেন, সিনেমা থিয়েটার মেকিং করা যায় না। সৃষ্টি হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপনের ভিড়ে আমরা স্রষ্টা এবং সৃষ্টিকে খুঁজে পাই না। কারখানা জআত বাজারের পণ্য নিয়ে আহ্লাদ করে—-
বিকৃত সংস্কৃতির দল। একদিকে স্লোগান সর্বস্বতা। অন্যদিকে আমাকে দেখুন অশ্লীলতা। এবং বরানগর এই বিকৃতির পথে পা রাখতে চায় না। এই নাটকের শুভ্র মারাদনা ও মেসির মতো স্বপ্ন দেখে।কবিতাময় জীবনের স্বপ্ন। সে চেয়েছিল প্রেমিকা করুণার ছবি আঁকতে। যে মেয়েটা নৃত্যের তালে তালে একটা সময় ছন্দময় হয়ে উঠেছিল। তার শরীর মনে শিল্পের ফুল ফুটতে চেয়েছিল। তাইতো বাজারি সমাজের বেমানান শুভ্র কে বরমাল্য দিয়েছিল। তারপর সংসারের যাঁতাকলে পড়ে মেয়েটা বদলে গেল। দাদুর কাছ থেকে পাওয়া শুভ্রর ভিন্টেজ দুই চাকার সাইকেল তার চোখে হয়ে উঠলো অশান্তির প্রতীক। অথচ সেই সাইকেল একটা সময় ছিল তাদের প্রেমের রোমান্টিক যানবাহন।
দাদুর দেওয়া সাইকেল এখানে ঐতিহ্যের প্রতীক। মানুষের শিকড়ের সন্ধান। যেখান থেকে মানুষকে উৎখাত করা চলছে। জীবন হয়ে পড়ছে এক ধরনের উদ্বাস্তু। স্ক্রাব মালের দোকান। নাটকের অন্তিম দৃশ্য সম্ভবত অন্য সমস্ত দৃশ্যকে অতিক্রম করে গেছে। ঋত্বিক ঘটকের অজান্ত্রিক ছবিটা মনে করিয়ে দেয়। যন্ত্র তখন আর যন্ত্র হয়ে থাকে না। যন্ত্র তখন জীবন যন্ত্রণা নয়। উন্নত জীবনের দিশা হয়ে ওঠে শুভ্রর ভাঙাচোরা সাইকেল। শুভ্রর নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটা মর্মান্তিক হলেও, আমাদের নষ্ট হয়ে যাওয়া অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে তোলে। আমার বিশ্বাস, এই নাটক বাংলা থিয়েটারের মাইলস্টোন হয়ে থাকবে। এই নাটক প্রমাণ করবে বাংলা থিয়েটারের ঐতিহ্য বিলীন হয়ে পড়েনি। এখানে যা লিখলাম এটা শুধুমাত্র আমার অনুভূতির প্রকাশ নয়। এই নাটক লক্ষ লক্ষ দর্শকের কাছে হয়ে উঠবে জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি।