সুকৃতি লহরী
১৯৪৮ সাল। প্রবাদপ্রতিম শম্ভু মিত্রের মানস ইচ্ছায় জন্ম নিল ‘ বহুরূপী নাট্য সংস্থা’। ১৯৪৮ সাল জন্ম হল শাঁওলী মিত্রের। শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রের একমাত্র কন্যা। জন্মসূত্রেই নাট্যের বীজ রোপিত হল। শাঁওলী মিত্রের পরবর্তী জীবনে তাই অনায়াসেই স্বাভাবিকভাবেই নাট্যচর্চা তাঁর জীবনে জড়িয়ে গেল, ছড়িয়ে গেল। কত শারীরিক অসুস্থতা সেই ছোট্টবেলা থেকে কিন্তু নাটকের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ হল না। শম্ভু মিত্র – তৃপ্তি মিত্রের উত্তরসূরী বলে নয় নিজস্ব ভাবনা আর শ্রমের মিশেলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন স্বতন্ত্রভাবে। অথচ কত গভীর যত্ন করে লালন করে গেলেন তাঁদেরই ঐতিহ্য, পরম্পরাকে। থিয়েটার তাঁর কাছে ‘ মাতৃঋণ ‘ – ‘ পিতৃতর্পণ ‘ ।
কত বিচিত্র পথে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন শাঁওলী মিত্র। কেন্দ্রবিন্দুতে থিয়েটাকে রেখে । প্রথমত তিনি অভিনেত্রী। দ্বিতীয়ত-তৃতীয়ত… তিনি নাট্য নির্দেশক, নাটককার, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, আবৃত্তিকার, বেতার নাট্যের রূপকার। জীবনের একটা বিশেষ পর্বে ডুবে ছিলেন বাচিক শিল্পের গহীনে। কত কত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গেছেন নিরন্তর শুধুমাত্র কণ্ঠস্বরকে অবলম্বন করে। শ্রাবন্তী মজুমদারের – লিভিং সাউন্ড, আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র প্রযোজিত নাটক তার সাক্ষ্য বহন করেছে।
‘ বহুরূপী ‘ থেকে চলে আসবার পর যখন শুধু বাচিক শিল্প নিয়ে কাজ করছেন তাঁর মনে হল যে তিনি তাঁর কণ্ঠস্বর নিয়ে কাজ করছেন অথচ ইচ্ছা করলে তিনি তাঁর চোখ হাত পা সমস্ত শরীরটাকে অভিনয়ের কাজে লাগাতে পারেন। এই মানসিক অবস্থার সময় তাঁর হাতে এসে পৌঁছল ‘ যুগান্ত ‘। শুরু হবে একটা যুগের । শম্ভু মিত্র তাঁকে ইরাবতী কার্ভের লেখা ‘যুগান্ত’ ( Irawati Karve : Yuganta the end of an epoch ) বইটি পড়তে দেন। এই বইটি পড়বার পর শাঁওলী মিত্রকে দ্রৌপদীর চরিত্র সবথেকে বেশি আলোড়িত করে।
দ্রৌপদীকে কেন্দ্রে রেখে লিখলেন ‘ নাথবতী অনাথবৎ’। এ নাটকে কথকতার ভঙ্গিতে একক অভিনয়ের প্রথম পদক্ষেপ নাট্যসমাজে অভিনব প্রয়াসের দৃষ্টান্ত শুধু তৈরি করল তা নয়, জনপ্রিয়তা ও সাফল্য শাঁওলী মিত্রকে আনল নাট্যের বৃত্তের মধ্যিখানে। ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে ‘নাথবতী অনাথবৎ’ মঞ্চস্থ হয় শিশির মঞ্চে । তখনও তৈরি হয়নি ‘পঞ্চম বৈদিক’। এরপর এই দলেই একটির পর একটি প্রযোজনায় নির্দেশনার দায়িত্ব নিলেন শাঁওলী মিত্র। শুরু হয়ে গেল একটি যুগ – নির্দেশনার নতুন ভাষ্য।
১৯৮৩ – ২০০৫ এই সময় পর্বে মঞ্চস্থ হল তাঁরই নির্দেশনায় ‘নাথবতী অনাথবৎ’, ‘রাজা’, ‘কথা অমৃতসমান’, হিন্দিতে ‘নাথবতী অনাথবৎ, ‘বিতত বিতংস’, ‘পুতুল খেলা’, ‘রাজনৈতিক হত্যা ‘,’চন্ডালী’। অভিনেত্রী হিসেবে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন বহুরূপী থেকেই । কিন্তু নির্দেশনা ! নির্দেশনারও পাঠ শুরু হয়ে গিয়েছিল বহুরূপী পর্বেই । হয়ত প্রত্যক্ষভাবে নয় কিন্তু পরোক্ষে, অগোচরে তৈরি হয়ে উঠলেন।
আমরা চোখ ফেরাব ১৯৬৯ – ১৯৭৭ এর কালপর্বে। শাঁওলী মিত্র তখন ২০/২১ বছরের তরুণী। কাজ দেখবার, বোঝাবার , আত্মীকরণের জন্য প্রস্তুত। শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় বহুরূপীর বৃহৎ ও মহৎ প্রযোজনাগুলি – ( ছেঁড়াতার , চার অধ্যায় , দশচক্র , রক্তকরবী, পুতুল খেলা, রাজা , রাজা ওয়দিপাউস ইত্যাদি ) প্রস্তুত হয়েছে পাঁচের বা ছয়ের দশকে তখন তিনি অতটা বড় নন। ফলে শম্ভু মিত্রের প্রযোজনা প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ বা অংশগ্রহণের সুযোগ তেমন ঘটেনি তাঁর। পরবর্তী সময়ে সম্ভবত ১৯৭২ সাল থেকে ‘রাজা’ ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) , প্রযোজনায় শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় সুরঙ্গনার চরিত্রে শাঁওলী মিত্র অভিনয় করেন ( এই চরিত্রে আগে অভিনয় করেছেন লতিকা বসু ও আরতি মৈত্র )। আর ১৯৭১ – এ ‘পাগলা ঘোড়া ‘ ( বাদল সরকার ) নাটকে – এটিই বহুরূপীর প্রযোজনায় শম্ভু মিত্রের শেষ নির্দেশিত নাটক।
‘ পঞ্চম বৈদিক’ এর রাজা – তে শাঁওলী মিত্র ছিলেন রাণী সুদর্শনার ভূমিকায়, পাশাপাশি অভিনয়ের সুবাদে তৃপ্তি মিত্রের সুদর্শনার চরিত্রায়ণ প্রত্যক্ষ করেছেন নিবিড়ভাবে । মূলত তৃপ্তি মিত্র নির্দেশিত নাটকগুলি প্রযোজনার সময় শাঁওলী মিত্র মুখ্য চরিত্র গুলিতে অভিনয় করলেন এবং হাতে কলমে কাজ শেখার একটা অবকাশ তৈরি হল ।
শুরুটা হয়েছিল ছোটবেলায় ‘ছেঁড়াতার’ নাটকে বসিরের ভূমিকায় অভিনয় দিয়ে। প্রথম সংলাপ বললেন ‘ দশচক্র ‘ নাটকে প্রতিবেশীর একটি ছোট বাচ্চার ভূমিকায় , একটিই সংলাপ – ” মাসিমা, মা আমাকে অরুণ , বরুণের সঙ্গে খেলা করতে মানা করে দিয়েছে ” । তখন চার বছর বয়স। আর তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় ১৯৫৭ সালে ‘ ডাকঘর ‘ নাটকে অমলের চরিত্রে অভিনয় করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়পর্বে পরিণত নারী চরিত্রে অভিনয়ের সূচনা হল ‘ ত্রিংশ শতাব্দী (পরিচালনায় হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়) নাটকে মিসেস ইথারলির ভূমিকায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। এই সময়ে তৃপ্তি মিত্র নির্দেশিত প্রায় ছটি নাটকে মুখ্য ভূমিকায় শাঁওলী অভিনয় করেছিলেন। সেখানে কখনও তিনি ‘কিংবদন্তি ‘( নাটককার. কুমার রায় )- র সুলভা , কখনও ‘ ঘরে বাইরে ‘ তে বিমলা, কখনও ‘ গন্ডার ‘( অনুবাদ. শাঁওলী মিত্র) এর দেইজি , ‘ পাখি ‘ ( মনোজ মিত্র ) – র শ্যামা – এইরকম । মায়ের কাছ থেকে শিখলেন কীভাবে কণ্ঠস্বর ব্যবহার করতে হয় , চিৎকার করাটাও একটা টেকনিক। এছাড়াও হাঁটাচলা, দাঁড়ানো, মুভমেন্ট, কেমন করে দাঁড়ালে মেয়েদের ভালো লাগে ইত্যাদি বিষয়গুলো।
আবার দ্বিতীয়বার যখন ডাকঘর মঞ্চস্থ হল নবপর্যায়ে তখন মায়ের সহযোগী হয়ে উঠলেন। অমলের ভূমিকায় অভিনয়ে ছিলেন
চৈতি ঘোষাল । দূরদর্শনে সংরক্ষিত এই নাটকটির রেকর্ডিং আমরা দেখতে পাই মাঝে মাঝেই । বিভিন্ন ইন্টারভিউতে চৈতি বলেন যে কীভাবে শাঁওলীদি তাঁকে তৈরি করেছিলেন – শিখিয়েছিলেন। এক তিনি নিজে এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন আর দুই শেখানোর দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষমতা তিনি অর্জন করেছেন। এটি মনে হয় যেন তাঁর নির্দেশনার পাঠ – প্রস্তুতির পর্ব । ভিত্তিটা তো তৈরি হয়ে গেল।
১৯৭১- এ যখন সরাসরি কাজ করলেন শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায়, তখন যথেষ্ট পরিণত। ১৯৮০ সালে ফ্রিংস বেনেভিৎস – জার্মান পরিচালকের সঙ্গে কাজ করলেন ‘গ্যালিলিওর জীবন ‘ – এ । গ্যালিলিও শম্ভু মিত্র আর তাঁরই কন্যা ভার্জিনিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য ক্যালকাটা রেপার্টরি থিয়েটার শাঁওলী মিত্রকে অনুরোধ করল । অসুস্থতা ছিল। সবে তখন জন্ডিস থেকে উঠেছেন এবং ভার্জিনিয়া চরিত্রটি তত পছন্দ ছিল না বলে শাঁওলী মিত্র অভিনয়ে গররাজি ছিলেন। কিন্তু দুটি কারণে সম্মত হলেন , তার একটি কারণ ফ্রিৎস বেনেভিৎজ তাঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় এবং শম্ভু মিত্র কেমন করে কোনও বড় চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তুতি নেন তা দেখার অদম্য আগ্রহ । শাঁওলী মিত্রের নির্দেশনা সংক্রান্ত কাজে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র ও ফ্রিৎস বেনেভিৎজ – এই ব্যক্তিদের প্রভাব রয়ে গেল। ‘পঞ্চম বৈদিক’ – এর প্রযোজনার সময় বাবাকে আরও কাছে পেলেন, তত্বাবধায়ক হয়ে শম্ভু মিত্র রইলেন ছত্রছায়ার মত।
‘ নাথবতী অনাথবৎ ‘ – এর সাফল্য ও জনপ্রিয়তাকে হয়ত অন্যান্য প্রযোজনাগুলি ছাপিয়ে যেতে না পারলেও আমরা যদি একটু বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব যে ধাপে ধাপে ভাবনাকে – সমাজ বিশ্লেষণের মননকে তিনি ক্রমশ উর্ধায়িত করেছেন। দ্রৌপদীর ব্যক্তিজীবনের অসহায়তা , দুঃখ, কষ্ট, লাঞ্ছনা , মহাভারতীয় যুগের নারীর অবস্থানের আখ্যান উপস্থাপিত করে ‘ কথা অমৃতসমান’ এ তিনি একটা যুগের অবক্ষয়ের মুখোমুখি পৌঁছে গেছেন। এই পৃথিবীতে ন্যায় ,নীতি, সত্য ,মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠায় আকুলতায় ,আগামী প্রজন্মের পৃথিবীটাকে ভালো করার ব্যাকুল প্রার্থনায় ‘ সর্ব পাপ দূর হোক / আকাশ নির্মল হোক / বায়ু পবিত্র হোক / এই পৃথিবী গ্লানি মুক্ত হোক’ পৌঁছে গেছেন। ‘ রাজা ‘ র রানী সুদর্শনার আত্মোপলব্ধির তীর্থযাত্রা থেকে ‘বিতত বিতংস ‘ – র তিস্তার লড়াই, সমাজ ও পরিবেশের দূষণ মুক্তির দৃঢ়তায় , ‘পুতুলখেলার ‘ র নারীর আত্মমর্যাদার প্রতিষ্ঠাকে সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে তোলা , ‘ চন্ডালী ‘ – র আত্ম আবিস্কার ,’ রাজনৈতিক হত্যা ‘র কূট ও গূঢ় রাজনৈতিকতায় অবিরত রেখেছেন তাঁর ভাবনা। বিস্তৃত সময় কাল পটভূমিকে বার বার ধরতে চেয়েছেন শাঁওলী মিত্র মননে ও প্রযোজনায় । শাঁওলী মিত্রের নাট্যনির্মাণের মূল লক্ষ্যই হল সমাজ ও ব্যক্তিমানুষের উত্তরণের পথ খোঁজা ।
অসামান্য লেখা।