দীপা ব্রহ্ম
সতীপতি, ব্যোমকেশ, আদিদেব, ভূপতি, মহানট, ত্রিনেত্র, শম্ভু, হর, দুর্গাপতি এ হেন শিব ঠাকুরের যেমন নানা নামের অন্ত নেই, তেমনই আমাদের বাংলা লোকসমাজে শিবকেন্দ্রিক উৎসবই প্রতুল। চৈত্র মাসের এই উৎসবগুলিতে বাঙালির জীবনচর্চা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। কার্য-কারণ ব্যাখ্যাসমন্বিত লোক দীধিতিগুলির প্রদর্শনেও বিস্মিত হতে হয়। মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান, নদিয়া জেলাগুলির অন্যতম একটি লোকপ্রকাশ ‘বোলান’।
যেভাবে এই জেলাগুলি সীমান্ত সংযুক্ত, বোলানও এই জেলাগুলির মধ্যেকার অদৃশ্য সীমা লঙ্ঘন করে বহু যুগ ধরে বাংলার আম মানুষকে ছুঁয়ে রয়েছে। বোলান প্রথমে গান তার পর পালা, বহুকাল আগের গানের পরে নাচ, অঙ্গ-ভঙ্গি, চরিত্র-সংলাপ, গল্পের যোগ রয়েছে। তবে শুধু চৈত্র নয়, বৈশাখ -জ্যৈষ্ঠ মাসেও বোলান চলে। চলে আষাঢ়েও।
বোলান শিল্পী গণপতি ঘোষ জানান, বছরের অন্য মাসগুলিতে ধর্মরাজ পুজো অর্থাৎ যমপুজো উপলক্ষেও বোলান হয়। ছিয়াত্তর বছর বয়স্ক গণপতিবাবু থাকেন বীরভূম জেলার ব্রাহ্মণডিহি গ্রামে। গুরু অহিভূষণ মণ্ডলের কাছে শিখেছেন বোলানের খুঁটিনাটি। তাঁর কথায় শিব-দুর্গার বিবাহমাস অর্থাৎ চৈত্র মাসে এই বোলান অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এখন বোলানে রামায়ণের ঘটনা, মহাভারতের যুদ্ধ, রাধাকৃষ্ণের গল্পগাথাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি জানান ডাক বোলান, দাঁড় বোলান, সখীনাচ বোলান, পোড়ো বা শ্মশান বোলান, মুর্শিদাবাদ সংলগ্ন এলাকাতে বোলান রয়েছে। তবে দলের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। তাঁর কথায় বলানো গানই হলো বোলান। সেই অতীত রীতি অনুযায়ী ছেলেরা মেয়ে সেজেই এই পালায় অংশ নেয়।
দলপতি উত্তম পালের এমনই একটি সখী নাচের বোলান দল রয়েছে বর্ধমানের পাণ্ডুগ্রামের খাটুন্দিতে। বোলানকে উৎকৃষ্ট রূপ দেওয়ার জন্য অবসর সময়ে ভাগবত, মহাভারত, চণ্ডী, গীতা, রামায়ণ নিয়ে পড়াশোনা করেন গণপতি ঘোষ। তাঁর এখন কোনো দল নেই। তিনি পালা রচনা করেন। ভিন গ্রামের বোলান দলগুলি তাঁর থেকে পালা নিয়ে যায়। পাবনী হিসেবে খুবই সামান্য অর্থ মেলে। তিনি ভাদু, বাউল গানও রচনা করেন। তাঁর সুর দেওয়া গান আকাশবাণী, বিশ্বভারতীতে প্রচারিত হয়। তবে নিজের গানের সিডি বের করার সংগতি নেই তাঁর। মূল গায়ক দোহারিদের নিয়ে বোলান জমে ওঠে। বাজনায় সংগত করে তবলা, ঢোল, হারমোনিয়াম। প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো চলে বোলান। শেষে থাকে পাঁচালি। বোলান এখন পালাবন্দি হয়েছে। পাঁচালি বা রঙ্গ পাঁচালি দিয়ে পালা সমাপ্ত হয়।
গণপতিবাবু মজাদার দু-এক কলি শোনালেন, ‘বর্ষাকালে ভেচাকিচি ভারি গো’। ‘ভেচাকিটি’ মানে ঝামেলা। ‘এঁটেল কাদায় পা পিছলে ধপাস করে পড়ি গো’ গানের প্রতিটি কথায় মাটির ঘ্রাণ। বাংলা ১৩৭২ সাল থেকে তাঁর বোলান রচনা শুরু হয়, হাজার খানেক পালা লিখেছেন। তাঁর কথায় উঠে এল শিল্পী মনের চিরন্তন সেই খেদ। সংসার প্রতিপালনে অন্য পেশায় যুক্ত তিনি। তিনি বললেন, ‘মানুষের দু’রকম দিসে। একটা পেটের, একটা মনের। পেটের খিদে মেটাতে দোকানে হিসেব লেখার কাজ করতে হয়। আর মনের খিদে মেটে বোলান রচনা করে। তবে সময় যত পালটেছে, শাস্ত্রীয় পালার পাশাপাশি সামাজিক সমস্যার বিষয়গুলি বোলানে এসেছে। মাঘ থেকে বোশেখ পর্যন্ত তাঁর লেখার সময়। তারপর বিভিন্ন দল তাঁর থেকে পালা নিয়ে যায়। গণপতিবাবুর কোন চাহিদা নেই। তাঁর শিল্পী মনের পরিচয় পেলাম আবার। তিনি জানালেন যাঁরা পালা করবে তাদেরও তো পয়সা নেই। তাই পালা নিয়ে যে যেটুকু দিতে পারে তাই নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট।
এ বোধহয় মাটির উদারতা, মাটির শিক্ষা, মাটির সহমর্মিতা। তাঁর সমসাময়িক কালিকাপুরের চন্দ্রশেখর মণ্ডলও বোলান পালাকার। রয়েছে কীর্ণাহারের পাঁচু দাস। সবাই তাঁদের মতো করে জীবন অতিবাহিত করছেন। গণপতিবাবু মনে করেন বোলান গুরুমুখী বিদ্যা। তিনি যেভাবে গুরু অহিভূষণ মণ্ডলের কাছে গুরুকরণ করেছিলেন তাঁরও এক ছাত্র অলিক মহলদার-এর লেখনীতে ভবিষ্যতে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
প্রকারভেদে আদিতে বোলান চার ধরনের। ডাক বোলান, পোড়ো বোলান, সাঁওতাল বোলান, পালাবন্দি বোলান। ডাক বোলান গান, পোড়ো ও সাঁওতাল বোলানে নাচ ও পালাবন্দি বোলানে অভিনয়ের প্রাধান্য রয়েছে। পালায় একজন প্রম্পটার থাকেন। পালার কাহিনি অনুযায়ী কোন চরিত্রের অর্থের প্রয়োজন হলে সে যখন ভিক্ষায় বের হয়, দর্শক অবলীলায় তার হাতে পয়সা দিয়ে যায়। অর্থাৎ এই মানুষগুলি বিশ্বাস করে পালার চরিত্রগুলিকে নিজের আত্মীয়ের মতো করে।
নাগরিক ভাষায় যাকে আমরা ইনটিমেট থিয়েটার বলি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রান্তিক মানুষগুলি তাই করে যান। আর এক বোলান শিল্পী হলেন সাধন ধীবর। দাদা বাবলু ধীবরদের থেকে বোলান শিখেছেন। লাভপুরের নিকটে ভালকুঠী গ্রামে থাকেন। মন মানে না, পরদেশী নানা চটুল গানের সুর বোলানে আসছে ঠিকই, পাশাপাশি আদি সুরগুলিও বোলানে রয়েছে, জানালেন তিনি। প্রায় আঠারো জন মিলে তাঁর দল কালীমাতা বোলান দল। এখনও সরকারি ভাতার ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি। বোলান তাঁর নেশা। পেশা চাষবাস আর মাছ ধরা। বছরে প্রায় ৮-১০টি পালায় অভিনয় করেন তিনি। বোলান গানও করেন। পালা থেকে অর্থ দিয়ে হারমোনিয়াম, তবলা সারানোর কাজ করেন। দলের ছেলেদের নিয়ে আনন্দ করেন। এখন বর্ষায় তাঁর দলের ছেলেরাও নানা কাজে যুক্ত রয়েছে উপার্জনের জন্য। সাধনবাবুর একান্ত ইচ্ছা নতুন বোলান শিল্পীরা যেন বোলানকে ভালোবেসে কাজ করেন। তাঁর আশা সঠিক পথ ও ভালো গুরুর সংস্পর্শে বোলান নতুন কলেবরে সেজেও শেকড়-বিচ্ছিন্ন হতে পারবে না কখনোই।
অসাধারণ এই উদ্যোগ। অভিকে অনেক ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।