১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর। পূর্ব পাকিস্তানের নাম মুছে গেল ইতিহাসের বই থেকে। আত্মপ্রকাশ করল বাংলাদেশ। কীভাবে এই ইতিহাস তৈরি হল তা অনেকেই জানেন, অনেকেই জানবেন। এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত কীভাবে বাংলাদেশের থিয়েটারকে বদলে দিল তার কিছু সূত্র এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা তুলে ধরতে চাইছি।
গোড়াতেই রাখা ভালো যে ‘থিয়েটার’ কথাটা সাহেবদের থেকে আমরা শিখেছি। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের ওপর এই বিলিতি ধাঁচার থিয়েটারের খবরদারি বেশিই ছিল। ঐতিহাসিক কারণেই ছিল। এই খবরদারি আজও মোটের ওপর কায়েম আছে। বাংলাদেশ বা আগেকার পূর্ববঙ্গ ওই সাহেবিয়ানা খপ্পরে বেশি পড়েনি। ঢাকা বা অন্য কোনো কোনো শহরে ঔপনিবেশিক আমলে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের চল হয়েছিল একথা ঠিক। কোনো কোনো জমিদারের দৌলতে ছোটোবড়ো মহল্লাতেও নানান মাপের রঙ্গালয় গড়ে উঠেছিল। এটাকেই মানুষ ‘থিয়েটার’ বলে চিনেছিল। এখনও চেনে। এটাও মনে রাখতে হবে যে এখন বাংলাদেশে ‘নাটক’ বলতে টেলিভিশনের পর্দায় বা ইদানীংকার ডিজিট্যাল মাধ্যমে সম্প্রচারিত ছোটো দৈর্ঘ্যের ছায়াছবিকে বোঝায়। তা আদতে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের নকল করেই পথ চলেছিল বলেই হয়তো এমন নাম চালু থেকেছে। এই নাম কখনও টিভি সিরিয়ালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই ব্যাপারটা আমাদের বিবেচনায় আসবে না। যা আমাদের প্রধান বিবেচ্য তাকে বাংলাদেশ ‘মঞ্চনাটক’ বলে। এই ধরনের নাটক সাধারণত প্রসেনিয়াম থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়। কখনও তা পথ থেকে তার পাথেয় সংগ্রহ করে। আজকাল নানান রকমের বিকল্প পরিসরেও নাট্যানুষ্ঠান হচ্ছে। তবে থিয়েটার কথাটার ব্যাপ্তি আরও বেশি। গত পঞ্চাশ বছরে এই ব্যাপ্তিকে ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে বাংলাদেশ। কেন আর কীভাবে এটা ঘটল সেটাই আমাদের আলোচনার অভিমুখ।
১৯৭১তে রাজধানী ঢাকায় বা চট্টগ্রামের মতো বড়ো শহরে কি প্রসেনিয়াম থিয়েটার ছিল না? ছিল। কলকাতার মতো জমজমাট পাবলিক থিয়েটার না থাকলেও নাগরিক নাট্যচর্চার পক্ষে মোটের ওপর অনুকূল একটি বাতাবরণ ছিলই। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে নাটক হত। মূলত তারই সুবাদে কিছু শৌখিন নাট্যচর্চার সুযোগ খুঁজে নিত ঢাকার মতো বর্ধিষ্ণু নগর। সেই ১৯৫০এর দশকেই ভারতের অগ্রণী নাট্যদল বহুরূপী ঢাকায় গেছেন। সেখানকার প্রাগাধুনিক নাট্যশালায় ছেঁড়া তার, রক্তকরবী মঞ্চস্থ হয়েছে। ঢাকা জুড়ে সাড়া পড়ে গেছে। পক্ষে-বিপক্ষে মতামত তৈরি হয়েছে। খবরের কাগজের পাতায় তার ফলাও স্বীকৃতি আছে। তা বলে বহুরূপী ঘরানার গ্রুপ থিয়েটারের চর্চা শুরু হয়নি। সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোনো সংগঠিত চর্চার পক্ষে অনুকূল ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের বুকে বাম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অনুসারী হিসেবে গ্রুপ থিয়েটারের বিকাশ। পূর্ব পাকিস্তানে সেই আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি।
তা বলে কি নাটক ছিল না? ছিল। কলকাতায় যা হয় বা হয়ে আসছে তাকে অনুসরণ করে এক ধরনের নাট্যচর্চা হত। আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত শুক্রবার সন্ধ্যার বেতার নাটক কিংবা নানান যাত্রানুষ্ঠানের শ্রোতা ছড়িয়ে ছিল বাংলাদেশ জুড়ে। গ্রামোফোন রেকর্ডে সিরাজদ্দৌলা ইত্যাদি নাটকের একটি অনুরাগী গোষ্ঠী ছিল। তাছাড়া ইয়োরোপের সমকালীন নাটকের বাংলা অনুবাদ করে মঞ্চায়নের একটি ধারা বইছিল। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরতে চাইছিলেন কেউ কেউ। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনকে সামনে রেখে মুনীর চৌধুরীর নাটক কবর বেশ নাম করেছিল। কল্যাণ মিত্রের মতো কেউ কেউ মৌলিক নাটক লিখে নাম করেছিলেন। এখন বুঝতে পারি যে খুলনা যশোরের মতো কল্যাণের বড়োসড়ো প্রভাব ছিল। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে এমন নাটক সহায়ক ছিল।
আর ছিল লোকায়ত নানান নাট্যরীতি। লোকসংস্কৃতি বলে সেসবকে আলাদা করে রাখার ঔপনিবেশিক রেওয়াজ তখনও নাগরিক মনে কায়েম থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র যাত্রার উপভোক্তা শ্রেণি ছিল। সাতচল্লিশের দেশভাগের দরুন যাত্রা বড়সড় ধাক্কা খেলেও তা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিপুল সংখ্যক মানুষের মনোরঞ্জনের খোরাকি জোগাত। পালাগান কিসসাগানের নানান রকমফের সাড়া দেশ জুড়েই চালু ছিল। ছিল গম্ভীরা আলকাপের মতো শত শত আঙ্গিক যা সংস্কৃতির উঁচু মহল উপেক্ষা করলেও নিচের মহল বাঁচিয়ে রেখেছিল।
সংস্কৃতির উচু-নিচু ভাগাভাগির এই ঔপনিবেশিক অভ্যেসকে পাল্টে দেবার জন্যে একটি বিপ্লবের দরকার ছিল। কালচারাল রিভোলিউশনের গতের একটি ঘটনা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এর পথ প্রশস্ত করে দিল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপকে বুকে নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে তোড়জোড় শুরু হল তাতে সামিল হলেন নাট্যকর্মীরা। নাগরিক নামে একটি দল ১৯৬৮ থেকেই সক্রিয় ছিলেন। তাদের কাজকর্মের পরিধি বাড়ল। একে একে তৈরি হল থিয়েটার, আরণ্যক, ঢাকা থিয়েটারের মতো দল। নবীন রাষ্ট্রনির্মাণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে তারা সামিল হলেন। ঢাকাকে ঘিরে যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হল তাদের কাছে থিয়েটারের একটি আকর্ষণ তৈরি হল। বেইলি রোড এলাকা হয়ে উঠল থিয়েটার পাড়া। গাইড হাউস, মহিলা সমিতির মতো প্রেক্ষাগৃহে (বাংলাদেশে অবিশ্যি ‘অডিটোরিয়ামে’র প্রতিশব্দ হিসেবে ‘মিলনায়তন’ কথাটি চালু) মঞ্চনাটকের ঢল নামল। এক ধরনের নাটক নয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বাদল সরকারের নাটক নিয়ে আত্মপ্রকাশের পর নাগরিকের খ্যাতি হল ইয়োরোপিয়ান ক্ল্যাসিকের বঙ্গীকরণের জন্য। থিয়েটারের জন্য নতুন ধারার নাটক লিখে নির্দেশনা দিতে লাগলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। রামেন্দু মজুমদারের সম্পাদনায় ‘থিয়েটার’ নাট্যপত্র হয়ে উঠল বাংলাদেশের নাট্যচর্চার অবিসংবাদিত মুখপত্র। আরণ্যকের মতাদর্শগত ভিত গড়ে দিল বামপন্থী চেতনা। তাঁদের নেতা মামুনুর রশীদের ‘নাটক শুধু বিনোদন নয়, শ্রেণী সংগ্রামের সুতীক্ষ্ণ হাতিয়ার’ হতে চাইল। মুক্তনাটক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গ্রামবাংলার মনে দাগ কাটতে উদ্যোগী হলেন তারা। ঢাকা থিয়েটার পথ চলা শুরু করেছিলেন আবসার্ড ড্রামা দিয়ে। দশ বছরের মধ্যে প্রায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে তারা মন দিলেন বাংলাদেশের হাটেমাঠেবাটে যেসব নাট্যরীতি আছে তার সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে। আম আদমির জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকা নানান ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্যেকার নাট্যগুণকে আহরণ করে আধুনিক মঞ্চভাষে জারিয়ে নিতে। তাদের নাটককার সেলিম আল দীন আর নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফের যুগলবন্দিতে গ্রাম থিয়েটার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল পল্লী বাংলার কিনার থেকে কিনারে।
এঁদের বাইরেও কেউ কেউ নাটক লিখছিলেন। যেমন সৈয়দ শামসুল হক। তাঁর পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (প্রযোজনা: থিয়েটার) সম্ভবত বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসের সব চাইতে নন্দিত নাটক। তাঁর নূরলদীনের সারাজীবন (প্রযোজনা: নাগরিক) আজও সমাদৃত।
শুধু ঢাকা নয়। চট্টগ্রাম, বরিশাল, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুরের মতো নাগরিক কেন্দ্রেও এর প্রভাব পড়ল। বছর দশেকের মধ্যেই সারা দেশ জুড়ে এত নাট্যদল উঠে এল যে নাট্যকর্মীদের নিজস্ব সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গড়ে তুলতে কোনো বেগ পেতে হল না। এমন কোনো সংগঠন আমাদের দেশে বা আমাদের রাজ্যে নেই। অথচ এমন একটি সংগঠন থাকলে রাষ্ট্রের সঙ্গে নাট্যকর্মীদের আদানপ্রদানের জায়গাটা অনেক সহজ হয়। দাবিদাওয়া আদায় করতে সুবিধে হয়। গত চার দশকে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন বাংলাদেশের বুকে সচল থাকা প্রসেনিয়াম থিয়েটারের অনুগামী সব নাট্যদলের প্রতিনিধি হতে পেরেছে এমন নয়। কিন্তু বৃহত্তর অংশের কাছে ছত্রছায়া হয়ে উঠেছে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে চালু থাকা নানাবিধ আইনকানুনের গেরো কাটাতে, নাট্যাভিনয়কে বিনোদন করের আওতার বাইরে আনতে, নাট্যকর্মীদের জন্য যৎসামান্য হলেও প্রণোদনা চালুর ব্যাপারে মধ্যস্থতা করাতে এই সংগঠনের ভূমিকা ঐতিহাসিক। এই মুহূর্তে কোভিড-১৯ অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়ছেন বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা। ফেডারেশন এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের মতো অন্যান্য সহযোগী সংগঠন দল বেঁধে সরকারের কাছে গেছেন ত্রাণের দাবিতে। কতক আদায় করেছেন। এই লেখা তৈরি করার ছ’দিন আগে, ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জুড়ে আবার মঞ্চনাটক ফিরে এসেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সহ দেশ জুড়ে যত সরকারি মিলনায়তনে এক বছরের হল ভাড়া যাতে মকুব করা হয় তার জন্যে এক জোট হয়ে জমায়েত করেছেন নাট্যকর্মীরা। তাঁরা চাইছেন সরকার দলগুলিকে নাটক করার জন্য প্রণোদনা দিক। ভারতের মতো স্যালারি গ্রান্ট বাংলাদেশে চালু নেই। প্রোডাকশন গ্রান্ট ব্যাপারটাও না-থাকার মতো। তার মধ্যেও স্রোতের উজানে এই যাত্রা যে চলেছে তার মূলে আছে এই নাট্য সংহতির জোর। রাষ্ট্র নাট্যকর্মীদের ডরায় না বটে, এড়িয়ে চলে না। বছর তিরিশ আগে দেশের রাষ্ট্রপতির উৎখাত চেয়ে যে গণ আন্দোলন হয়েছিল তাতে নাট্যকর্মীদের জোরদার অবদান ছিল। বছর দশেক আগে ঢাকার শাহবাগ চত্বরে যে বিস্ময়কর গণ আন্দোলন দানা বাঁধে তাতেও নাট্যকর্মীরা সামনের সারিতে ছিলেন।
এই সংহতির জোরেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ওপর নাট্যকর্মীদের প্রভাব এত বেশি। কতক সংগীত নাটক একাডেমির ধাঁচায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শাখা আছে বাংলাদেশের সব জেলাতেই। স্বয়ংসম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ দেখভাল ও ভাড়া দেওয়া ছাড়াও সরকারি পোষণায় হরেক রকম কার্যক্রম চালানো এদের কাজ। এদের সদর ঘাঁটি রাজধানী ঢাকার একেবারে বুকের খাঁচায় – সেগুনবাগিচা চত্বরে। বলতে দ্বিধা নেই যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে ওঠা এত বড়ো আর্ট কমপ্লেক্স আমাদের দেশে নেই। বিপুলায়তন এই চত্বরের প্রধান আকর্ষণ জাতীয় নাট্যশালা। বছর কুড়ি আগে গড়ে ওঠা এই নাট্যশালার ভেতরে আসলে তিনটে রঙ্গমঞ্চ। বড়ো রঙ্গমঞ্চটি সাবেক ধাঁচার প্রসেনিয়াম আর্চের। বহরে বেশ বড়ো। কলকাতার সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামের মতো। ছোটোটি স্টুডিও থিয়েটার। এটি মাঝারি মাপের ব্ল্যাকবক্স। আর মাঝের রঙ্গমঞ্চটি আমাদের চোখে বিস্ময়কর ঠাহর হতে পারে। এর পোশাকি নাম এক্সপিরিমেন্টাল থিয়েটার। যথার্থ নামকরণ। এটিকে ইচ্ছেমতো গড়েপিটে নেওয়া যায়। প্রসেনিয়ামের মতো করে সাজানো যায়। যাত্রার মতো থার্স্ট স্টেজ করে নেওয়া যায়। আবার এরেনা থিয়েটার – যাতে দর্শক বসেন চারদিকে আর মাঝখানে একটু নিচে নাট্যানুষ্ঠান হয় – তার স্থাপত্যরীতি মেনেও সাজানো যায়। শুধু গ্যালারির অবস্থানের হেরফের নয়, এর আলোক ও ধ্বনিপ্রক্ষেপণ-নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও লা-জবাব। এই একটি মঞ্চ গড়ে ভারতকে টেক্কা দিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
তা বলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের থিয়েটারের দেওয়া-নেওয়া কখনও থেমে থাকেনি। বস্তুত ১৯৭০এর দশক থেকেই বাংলাদেশ থেকে আসা তরুণ নাট্যশিক্ষার্থীরা দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাতে ভর্তি হয়েছেন। আধুনিক নাট্যকলার পাঠ নিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে প্রয়োগ করেছেন। এঁদের মধ্যে গোলাম সারোয়ার, সৈয়দ জামিল আহমেদ, নায়লা আজাদ নূপুর, কামালউদ্দিন নীলু, তারিক আনাম খানের নাম চট করে মনে আসছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের নাট্ট্যকার- নির্দেশকদের মধ্যে এঁরা বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। এঁদের সঙ্গে জুড়ে থাকা দল যেমন নাট্যকেন্দ্র, ঢাকা থিয়েটার, নাট্যচক্র, সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের সুনাম আজও অক্ষুণ্ণ আছে। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাতে এখন আর বিদেশি ছাত্ররা ভর্তি হতে পারে না। তবে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও বাংলাদেশী নাট্যার্থীদের আনাগোনা লেগেই আছে। নানান ধরনের বৃত্তি এতে সহায়ক হয়েছে।
ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার বার্ষিক উৎসব ভারত রঙ্গ মহোৎসবে বাংলাদেশ এক অনিবার্য উপস্থিতি। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের নানান নাট্যমেলাতেও এখন বাংলাদেশের নাটক দেখার অঢেল সুযোগ। নান্দীকারের জাতীয় নাট্যমেলার সুবাদে ১৯৮৫ নাগাদ যে সম্পর্কের সূচনা তা এখনও শতগুণে শক্তপোক্ত হয়েছে। কলকাতার দল অনীকের গঙ্গা-যমুনা নাট্য উৎসব আড়াই দশক ধরে লাগাতার চলছে। তাতে বাংলাদেশের বাছাই করা নাটক আসে। এই উৎসবের ঢাকা সংস্করণে পশ্চিমবঙ্গের দল অভিনয় করে আসেন। ক’বছর আগে নবদ্বীপের মাটিতেও পৌরসভার প্রেক্ষাগৃহে বাংলাদেশের দুটি নাট্যদল সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তাদের একটি আরণ্যক, অপরটি যশোরের বিবর্তন। চাইলে এমন আয়োজন আরও হতে পারে। কলকাতার বুকে ঢাকার দল থিয়েটার একবার নাট্য উৎসব করেছিলেন। ক’বছর আগে নাগরিক, প্রাঙ্গণে মোর, শব্দ নাট্যকেন্দ্র একইভাবে উৎসব করেছেন। বরিশালের দল শব্দাবলীও করেছেন।
তবে বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চের যোগসাজশ ঘটানোয় সবচাইতে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনসটিটিউটের বাংলাদেশ সেন্টার। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে রামেন্দু মজুমদারের পৌরোহিত্যে যা শুরু হয়েছিল তা ইয়োরোপ-এশিয়ার নানান দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের থিয়েটারের আদানপ্রদানে স্মরণীয় ভূমিকা নিয়েছে। রামেন্দুর সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁকে দু’দফার জন্য ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনসটিটিউটের সভাপতির পদে বৃত করেছিল। এ এক অতুলনীয় প্রাপ্তি।
এইসব আদানপ্রদানের ফলে বাংলাদেশের মঞ্চনাটকে এক আন্তর্জাতিকতা এসেছে যা একই সঙ্গে স্থানিক ও বৈশ্বিক। এমন এক নন্দনতত্ত্বের জন্ম দিচ্ছে যা ঐতিহ্যবাহী নাট্য বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নাট্য পরম্পরাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারে। আবার রতন থিয়াম বা সুমন মুখোপাধ্যায়ের আধুনিক নাট্যপ্রয়োগকেও চিনে নিতে পারে। ছ’দিন আগের সেই সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার দুটি রঙ্গমঞ্চে দু ধরনের দুটি নাটক মঞ্চস্থ হয় – আরণ্যকের কহে ফেসবুক, ঢাকা থিয়েটারের একটি লৌকিক অথবা অলৌকিক স্টিমার। দুটি নাটকের চলনে নিশ্চিতভাবেই আশমান-জমিন ফারাক ছিল। অদূরে বেইলি রোডের মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে আনকোরা নতুন দল আপস্টেজ সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাসের আধারে স্বপ্নভুক মঞ্চস্থ করেন। সেটিও ছিল স্বতন্ত্র চলনের কাজ। এতরকমের নাট্যক্রিয়াকে একই সঙ্গে ধারণ করার জন্য যে উদারতা লাগে সেটি ঢাকায় তো আছেই, চট্টগ্রামের মতো কোনো কোনো শহরেও আছে।
বাইরে থেকে দেখলে কারোর কারোর মনে হতে পারে বাংলাদেশের থিয়েটার মানেই মুক্তিযুদ্ধের কথা ও কাহিনি, রাজাকারদের ষড়যন্ত্রের লড়াকু জনতার নাছোড় লড়াই। কিংবা নাচে-গানে জমজমাট প্রযোজনা যা আমাদের এদিকে বড়ো একটা হয় না। এই লেখকের পক্ষে এই স্বল্প পরিসরে বাংলাদেশের নাট্যসংস্কৃতির সামগ্রিক চিত্র পেশ করা সম্ভব নয়। তাঁর যে যোগ্যতাও নেই। কিন্তু এটুকু সে বলতেই পারে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাংলাদেশের থিয়েটারের অন্যতম চালিকা শক্তি। আর দেশজ নাট্যরীতির কলাপ্রকরণ আত্তীকরণ করে তার আধুনিক নাট্যপ্রয়োগ বাংলাদেশের থিয়েটারকে যে স্বকীয়তা দিয়েছে তার কদর না করে উপায় নেই। আর যাই হোক, বাংলাদেশের বেশির ভাগ থিয়েটারের মধ্যে বাংলাদেশকে চেনা যায়। জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নিয়ে তত্ত্বতালাশ মুলতুবি থাকলেও বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্বোধন হয়। নেশন বিল্ডিঙের প্রকল্পের সঙ্গে তা এখনও অঙ্গাঙ্গী।
এর পেছনে শিক্ষাব্যবস্থার অবদান মনে রাখতেই হয়। প্রাথমিক স্তর থেকে নাট্যকলা শেখানোর সুরাহা হয়নি এ এক বাস্তবতা। মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে লড়াইতে নাট্যকলাকে হাতিয়ার করা হয়নি এও ঠিক। আবার ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জগন্নাথ সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ (নামের উনিশ-বিশ আছে নানান জায়গায়) চালু হয়েছে। কোনোটা অনেক দিন ধরেই নাট্যশিক্ষার নিত্যনতুন দিগন্ত আবিষ্কার করছে। সেলিম আল দীনের গবেষণা বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসকে নতুন করে পড়বার উপায় বাতলেছে। ধর্মীয় কিংবা কৃষিভিত্তিক নানান কৃত্যের মধ্যে নিহিত নাট্যক্রিয়ার উপাদানকে আলাদা চোখে চিনতে শিখিয়েছে। পশ্চিম থেকে পাওয়া নাট্যরীতির উল্টোমুখে চলে ঐতিহ্যবাহী নাট্যের একটি ধরনকে মান্যতা দিতে চেয়েছে। ‘বর্ণনাত্মক নাট্যরীতি’ নামে চালু হয়ে যাওয়া এই নাটকের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশের মাটির রস চিনছেন। দেশবিদেশের নাট্যচর্চার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী পঠনপাঠনের মধ্যে ক্ষেত্রসমীক্ষাকে জুড়ে দিয়ে লোকায়ত নাট্যক্রিয়াকে গভীরভাবে চিনতে চেয়েছে, তার কৃৎকৌশল রপ্ত করেছে। সেসবকে আধুনিক নাট্যভাষে জারিয়ে নিয়ে মঞ্চনাটকে প্রয়োগ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের এসব প্রযোজনার বেশির ভাগের মধ্যে ছেলেমানুষির ছিটেফোঁটা দেখিনি। বরং পেশাদারিত্বের সম্ভাবনা দেখেছি।
তা বলে পেশাদারিত্ব আসেনি বাংলাদেশের থিয়েটারে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনো নাট্যকলার ছাত্রছাত্রীদের বেশির ভাগই থিয়েটারে না এসে সরে গেছেন অর্থকরী নানান পেশায়। এর মধ্যে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর প্রাচীন প্রবাদের অনুবর্তন থাকলেও নিখাদ শিল্পপ্রেম ও সমাজচেতনার দিকটি অবহেলিত থাকে না। এখনও নবীন কিশোরের দল নাট্যাঙ্গনে ভিড় জমান। এখনও কোনো কোনো নাটক নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায়। নানান এনজিও-র হয়ে কাজ করার প্রলোভন ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছাকাছি থাকতে চাইবার বাস্তব প্রয়োজনের পাশাপাশি বাংলাদেশের মঞ্চনাটক যে আজও সংবাদ শিরোনাম হতে পারে এ কম পাওনা নয়।
এভাবে গত পঞ্চাশ বছরে নিজের মতো করে নিজেদের থিয়েটারের অভিজ্ঞান চিনে নিয়েছে বাংলাদেশ। পালার মাটির আঙিনা থেকে এসে পড়েছে সারস্বত চর্চার শানবাঁধানো উঠোনে। আমরা পারিনি। আমাদের থিয়েটারের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমতে-কমতে এখন যৎসামান্য। তা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিসেবে এ নিয়ে আমরা একটুআধটু গর্ব করতেই পারি।
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় লেখা। দেশের বাইরের থিয়েটার নিয়ে এমন জানান দেওয়া লেখা আমাদের সমৃদ্ধ করবে।