গ্যালিলিও, নির্মাণ প্রসঙ্গে – শরণ্য দে

কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার মুখবন্ধতে বলেছিলেন— কবিতার কাজ সত্যি কথা বলা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমিও সে ভাবনা ধার করেই বলি— থিয়েটারের কাজ আমাদের সময়ের কথা বলা ছাড়া আর কিছুই নয়।

থিয়েটারের মূল শর্ত হল থিয়েটারকে প্রাসঙ্গিক হতে হবে, কালজয়ী হওয়ার প্রত্যাশা আমার নেই। আমাদের কাজটা এই মুহূর্তের লোকগুলোর কাছে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে কিনা সেটাই মূল কথা। যেমন ধরা যাক, Shakespeare-এর কথা। বলা হয়, ‘Gunpowder plot’, যেটা কিনা রাজহত্যার একটা ব্যর্থ ষড়যন্ত্র ছিল। এ ঘটনা সারা England-এ তোলপাড় ফেলে দেয়। রাজা, যে কিনা ঈশ্বরের প্রতিভূ, তাকেও হত্যা করা যায়? আমরা কিন্তু সেইসময়ের এই দ্বন্দ্ব, রাজহত্যা নিয়ে মানুষের চেতনাতে বেড়ে ওঠা ঘাত-প্রতিঘাত— এই সব কিছু পাচ্ছি Macbeth-এর ভিতর। আসলে Shakespeare তো তাঁর contemporary truth-কেই বোঝার চেষ্টা করেছেন। ঠিক একইভাবে Tempest-এর ভিতর দিয়ে সেই সময়ে সারা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদকে বোঝার চেষ্টা করেছেন Shakespeare।

আরও অনেক নাট্যকারেরই নাম নেওয়া যায় কিন্তু Shakespeare-এর উদাহরণটি দিলাম তার কারণ হল— এটা বোঝা দরকারি, কারণ উনি কিন্তু ফরাসি বিপ্লবেরও প্রায় দুশো বছর আগেকার মানুষ। তখনও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ কিংবা গণতান্ত্রিক চেতনার জন্ম হয়নি ইউরোপের মাটিতে। Political লেখা বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা হওয়া সম্ভব নয় তখন। কিন্তু Shakespeare সেই কাজটি করছেন এবং তা পারদর্শিতার সঙ্গেই করছেন। কারণ তিনি নিজের সময়কে ধরতে চেয়েছিলেন। এবং এই জন্যই চারশো বছর পরেও ওঁর নাটক নিয়ে কাজ হচ্ছে, কথা হচ্ছে, আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

কিন্তু আমাদের এই সময়টার মূল সুর কী? আমি জানি না। আমি কার্ল মার্কস নই যে আমার সময়টাকে একটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে পারব। আমি একজন মানুষ, তাই সময়ের ঘাত-প্রতিঘাত, দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্ব আমাকে ভাবায় আর থিয়েটার এই সময়ের প্রতি আমার রি-অ্যাকশনমাত্র।

মৌলবাদ বনাম মুক্তচেতনা— এই বাইনারি আমাকে ভাবায়। সারা পৃথিবী জুড়ে মৌলবাদের উত্থান; ধর্মীয় মৌলবাদ, রাজনৈতিক মৌলবাদ এবং সামাজিক মৌলবাদ, তাহলে মুক্তচেতনার জায়গা কোথায়? মুক্তচেতনা যেন ওই বেচারা সংখ্যালঘুর মত, যাকে reservation দেওয়ারও কেউ নেই, তোষামোদ করারও কেউ নেই। আমার দেশে নরেন্দ্র অচ্যুত দাভোলকরকে হত্যা করা হয় এক দিকে, অন্য দিকে আজও তসলিমা নাসরিনকে কলকাতায় আসতে দেওয়া হয় না। মুক্তমনাদের জায়গা কোথায়? আমাদের পাশের দেশেই অভিজিৎকে কুপিয়ে মারা হয়েছে, ফ্রান্সে Charlie Hebdo, কিংবা আমাদেরই দেশে গৌরী লঙ্কেশকে!

‘এই অন্ধকার সময়তে আমরা কীসের গান গাইব?
এই অন্ধকার সময়তে আমরা অন্ধকারের গান গাইব…’

তাই Bertolt Brecht-এর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই। Brecht-এর গ্যালিলিও আমার কাছে কোনও মহান ব্যক্তি নয়, সে খুব সাধারণ মানুষ। যে খেতে ভালবাসে, দুধওয়ালার টাকাটা ইচ্ছা করে মেটায় না। খুব ভাল বাবা নয়, আবার অন্যের আবিষ্কার নিজের নামে চালিয়ে দেয় কিছু টাকার জন্য। কিন্তু এইগুলো সত্ত্বেও সে একটি সত্যি কথা বলতে চায়। একটি খুব সাধারণ সত্যি, কিন্তু সে বলতে পারে না। কারণ সে সাধারণ। Brecht চাইলে Bruno কিংবা কোপারনিকাসকে নিয়ে নাটক লিখতে পারতেন, যাঁরা রাষ্ট্রের ক্ষমতার কাছে হার মানেননি। কিন্তু Brecht ইচ্ছা করেই একটি সাধারণ মানুষের কথা বললেন। যে রাষ্ট্রের অস্ত্রকে ভয় পায়, যে কোনও বিপ্লব করতে চায় না, সে শুধু নিজের সত্যটা বলতে চায়। সে আমাদেরই এক সহনাগরিক, যেন ভয় পাওয়া এক মানুষ। যে ভয় পায়, সত্য গোপন করতেও রাজি, মুক্তচেতনাকে হত্যা করতেও রাজি— কারণ সে জানে সত্য বললে রাষ্ট্র তাকে বিদেশি গুপ্তচর কিংবা মাওবাদী বলে জেলে রেখে দেবে সারা জীবন।

Brecht যখন Leben Des Galilei লিখছেন তখন সারা ইউরোপ জুড়ে উগ্র রাষ্ট্রবাদের ছায়া। আমাদের সময়টাও প্রায় এক। রাজারা ঘিরে আছে তোষামোদকারী দল নিয়ে। শিল্পীরা গা বাঁচিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাহলে মুক্তচেতনার কথা বলবেন কে? ধর্ম এবং মৌলবাদ এই দুটোরই কি কোনও প্রয়োজন আছে পৃথিবীর? এই উত্তরটা খোঁজারই চেষ্টা আমরা করেছি নাটকটা জুড়ে।

ভারতীয় উপমহাদেশে Brecht করার একটা সুবিধা আছে। ওঁর ‘estrangement effect’ আমাদের ভারতীয় থিয়েটারের একটা অবিচ্ছিন্ন অংশ। আমাদের folk theatre হোক বা Classical, ‘estrangement effect’-এর ব্যবহার বরাবরই চমৎকারভাবে হয়েছে। আমরা ইচ্ছে করেই minimal design রেখেছি। তার মূল কারণ দুটো, এক রবীন্দ্রনাথ রিয়ালিস্টিক set design-কে বলেছিলেন ‘পশ্চিমী বর্বরতা’। আমি অনেকটাই একমত এই কথাটির সঙ্গে এবং দ্বিতীয় কারণ হল রাজনৈতিক— পুঁজিবাদ আর ধনতন্ত্র বেঁচে আছে মৌলবাদকে আধার করে, তাহলে সেই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ‘চমকে দেওয়া’ সেট তৈরি করা তো পুঁজিবাদেরই দাসত্ব স্বীকার করা! আমাদের এই গরিব দেশে থিয়েটারের design কেমন হবে? মঞ্চের ওপর সংলাপে শুধু গরিব মানুষের দুঃখ উঠে আসাটা একটা পোশাকি রাজনৈতিক থিয়েটার, যতক্ষণ না সেই ভাবনা নাটকের ফর্মেও প্রতিফলিত হচ্ছে সে নাটক রাজনৈতিকভাবে ভণ্ড ও ব্যর্থ।

এই নাটকটা দিয়ে আমি শুধু এই সময়টাকে বোঝার চেষ্টা করছি। Second wave-এ যখন অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না, লোকে দিব্বি স্টেটাস দিচ্ছে IPL নিয়ে। আমাদের দেশের মজদুররা যখন হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছে আমরা তখন ডালগোনা কফি খাচ্ছি আর থালা বাজাচ্ছি। আমাদেরই এক সহনাগরিক— এক সাংবাদিক যখন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য মাঝরাতে arrest হচ্ছেন, আমরা তখন meme বানাচ্ছি। এই callous নিস্পৃহভাব এটাও কি মৌলবাদকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে না? দুর্ভাগ্য যে, এই হেরে যাওয়া জাতির বীরের প্রয়োজন কিন্তু নেই। আমরা তবু রাগি না। আমরা ভাবি না। আমরা শুধু চেয়ে আছি, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি কই?