নাটক: ভারতবর্ষ – বসন্ত পাথ্রডকর

কাহিনি: রমাপদ চৌধুরী
নাট্যরূপ: বসন্ত পাথ্রডকর

[মঞ্চে তিনটি জোন ব্যবহৃত হয়। চায়ের দোকান জোন, আন্ডা হল্ট জোন আর কাঁটাতার জোন। কোনও একটি জোনে একটি ছোট চায়ের দোকান। তিনজন যুবক চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছে। দোকানদার বয়স্ক মানুষ।]

দোকানদার— তারও আগে যখন আপনেরা মায়ের প্যাটে, মানে আমাদের যুবক বেলা আর কী, তখন এটা টেশন (স্টেশন) ছিল না। এর নাম ছিল বি এফ ৩৩২। ফৌজি সংকেতে নাম ছিল বি এফ থ্রি থার্টি টু (BF 332)। সেটাকে কোনওভাবেই টেশন বলা চলে না। না প্ল্যাটফর্ম, না টিকিটঘর।

প্রথম যুবক— তারপর?

দোকানদার— তারপর আর কী! একদিন দেখা গেল ঝকঝকে নতুন কাঁটাতার দিয়ে রেললাইনের ধারটুকু ঘিরে দেওয়া হয়েছে। ব্যস, ওইটুকুই।

দ্বিতীয় যুবক— ট্রেন চলত তখন?

দোকানদার— ট্রেন বলতে, ওই আর কী। সারা দিনে আপ-ডাউনের একটা ট্রেনও থামত না। থামত শুধু একটি বিশেষ ট্রেন।

তৃতীয় যুবক— সেই ট্রেনটা রোজ এসে দাঁড়াত এখানে?

দোকানদার— আরে না না। রোজ কোথায়! হঠাৎ এক-একদিন সকালবেলায় এসে থামত। কবে কখন সেটা থামবে, তা শুধু আমরাই আগে থেকে জানতে পেতাম।

প্রথম যুবক— আমরা মানে, এলাকার লোকেরা?

দোকানদার— আমরা মানে, আমাদের ঠিকাদার আর বেহারি রাঁধুনি ভগোতীলালকে নিয়ে আমরা পাঁচজন।

দ্বিতীয় যুবক— ট্রেন দাঁড়াতেই সেই বি এফ… কী একটা বললে, সেটা একটা নামও পেয়ে গেল?

তৃতীয় যুবক— আন্ডা হল্ট।

দোকানদার— টেশন ছিল না, ট্রেন থামত না, তবু রেলের লোকদের মুখে মুখে একটা নতুন নাম চালু হয়ে গিয়েছিল। তা থেকে আমরাও বলতাম ‘আন্ডা হল্ট’।

প্রথম যুবক— আন্ডা মানে তো ডিম?

দ্বিতীয় যুবক— শুনেছি এই আন্ডা হল্টের কাছ ঘেঁষে ওই বেঁটেখাটো পাহাড়ি টিলার পায়ের নিচে একটা মাহাতোদের গ্রাম ছিল। তাদের গ্রামে-ঘরে মুর্গি চরে বেড়াত। অনেক দূরে ভুরকুণ্ডার শনিচারি হাটে সেই মুর্গি কিংবা মুর্গির ডিম বেচতে যেত মাহাতোরা।

প্রথম যুবক— আর সেই থেকেই আন্ডা হল্ট?

দোকানদার— না, সে থেকে নামটা হয়নি। তবে যে কথাগুলো শুনেছ, সেগুলো সত্যি। কিন্তু সেজন্য বি এফ থ্রি থার্টি টু-র নাম আন্ডা হল্ট হয়ে যায়নি। মাহাতো-গাঁয়ের ডিমের ওপর আমাদের কোনও লোভই ছিল না। (দীর্ঘ পজ। যুবকরা যেন কোনও একটা উত্তরের অপেক্ষায় আছে) আমি তখন এক ঠিকাদারের অধীনে কাজ করি।

তৃতীয় যুবক— তার মানে, তখন তুমি এখানেই ছিলে?

দোকানদার— আমাদের ঠিকাদারের সঙ্গে রেলওয়ের একটা ব্যবস্থা ছিল। একটা ঠেলা-ট্রলিও ছিল আমাদের ঠিকাদারের। লাল শালু উড়িয়ে সেটা রেলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে এসে মালপত্র নামিয়ে দিয়ে যেত।

দ্বিতীয় যুবক— কী কী মালপত্র নামিয়ে দিয়ে যেত?

দোকানদার— নামিয়ে দিয়ে যেত রাশি রাশি আন্ডা।

প্রথম যুবক— আন্ডা, মানে ডিম!

দোকানদার— বেহারি কুক ভগোতীলাল আগের রাত্রে সেগুলো সেদ্ধ করে রাখত।

তৃতীয় যুবক— আর সেই থেকে এই জায়গাটার নাম হল ‘আন্ডা হল্ট’।

দোকানদার— না। সেজন্যেও আন্ডা হল্ট নাম হয়নি। হয়েছিল ফুল-বয়েলড ডিমের খোসা কাঁটাতারের ওপারে ক্রমশ স্তূপীকৃত হয়ে জমেছিল বলে।

দ্বিতীয় যুবক— ডিমের খোসা দিনে দিনে পাহাড় হচ্ছিল বলে…

প্রথম যুবক— বি এফ ৩৩২ হয়ে গেল আন্ডা হল্ট!

তৃতীয় যুবক— শুনেছি ফৌজি ভাষার বি এফ থ্রি থার্টি টু-র প্রথমেই যে দুটো অ্যালফাবেট, সেটা নাকি কোনও সংকেত নয়, ব্রেকফাস্ট কথাটার সংক্ষিপ্ত রূপ।

দ্বিতীয় যুবক— রামগড়ের দিকে নাকি তখন পি ও ডবলু ক্যাম্প ছিল, ইটালীয় যুদ্ধবন্দিরা সেখানে বন্দি হয়ে থাকত। বেয়নেটে আর কাঁটাতারে ঘেরা থাকত তাদের ক্যাম্প।

দোকানদার— ওই তাদেরই মাঝে মাঝে একটা ট্রেনে বোঝাই করে এ পথ দিয়ে কোথায় যেন চালান করে দিত। কেন এবং কোথায় চালান করত, আমরা কেউ জানতাম না। শুধু আমরা খবর পেতাম…

[চায়ের দোকানের আলো হালকা হয়। অন্য একটি জোনে দেখা যায় একজন ঠিকাদার নির্দেশ দিচ্ছে, (এটাকে আন্ডা হল্ট জোন বলা যায়) —কাল ভোরবেলায় ট্রেন এসে থামবে। ঠিকাদার চিঠি পড়ে ‘তিন সো তিশ ব্রেকফাস্ট ফর টুমরো’। ডিমের ঝুড়িগুলো দেখিয়ে ভগোতীলালকে বলে, তিন সো তিশ ব্রেকফাস্ট। ভগোতীলাল গুনে গুনে ডিম বের করতে থাকে। মাঝেমধ্যে কিছু পচা ডিম বেরোয়। কিছু ডিম বের করার পরই ভগোতীলাল চেঁচিয়ে বলে, ‘আরে, এগুলো নিয়ে যা সেদ্ধ কর’। একজন কুলি ডিম তুলে নিয়ে যায়। দুই জন কুলি পাশেই বসে সিদ্ধ ডিম ছাড়ায়। এভাবে একসময় ভগোতীলাল চেঁচিয়ে বলে, ‘ছ’শো ষাট পিস ডিম আর গোটা পঁচিশ ফাউ’। ডিমের ছাড়ানো খোসা একজন উইংয়ের ওপারে নিয়ে গিয়ে ফেলে, তার আওয়াজ পাওয়া যায়। ওই জায়গাটাই কাঁটাতারের জোন হিসেবে ব্যবহৃত হবে।]

ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। বোঝা যায় একটা ট্রেন এসে থেমেছে। আওয়াজ পাওয়া যায় মিলিটারি জুতো পরা সৈন্যরা কামরা থেকে ট্রেনের দুপাশে ঝুপঝাপ নেমে পড়ছে। দেখা যায় কিছু সৈন্য মঞ্চে এসে ঢোকে এবং কয়েকজন মিলিটারি গার্ড উঁচু করা রাইফেল নিয়ে যুদ্ধবন্দিদের পাহারা দেয়। ডোরাকাটা পোশাকের বিদেশি বন্দিরা একে একে কামরা থেকে নেমে আসে বড়সড় মগ আর এনামেলের থালা হাতে। দুটো বক্স বা কিউবকেই টেবিল বানিয়ে সার্ভার কুলি তিনজন দাঁড়ায় আর বন্দিরা লাইন দিয়ে একে একে এগিয়ে এসে ব্রেকফাস্ট নেয়। একজন কফি ঢেলে দেয় মগে, একজন দু-পিস করে পাউরুটি দেয়, আরেকজন দেয় দুটো করে ডিম। যুবক বেলার দোকানদার একটা কাগজে কী সব লেখে। ব্যস, তারপর ওরা গিয়ে গাড়িতে ওঠে। এরপর হুইসল শোনা যায়, সৈন্যরা বন্দিদের গাড়িতে তোলে, ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দ পাওয়া যায়।

(চায়ের দোকানের জোনে আলো ফেরে।)

তৃতীয় যুবক— তখন এই এলাকায় কেউ থাকত না?

দোকানদার— থাকত তো, মাহাতোরা তখন এদিকেই থাকত। মানে কাঁটাতারের ওপারেই ছিল ওদের গ্রাম।

দ্বিতীয় যুবক— মাহাতোরা কেউ কাছে আসত না?

দোকানদার— না, প্রথম প্রথম আসত না। দূরে দূরে খেতিতে জনারের বীজ রুইতে রুইতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখত।

প্রথম যুবক— ট্রেন যাওয়ার পর বাকি যা থাকত তোমরা খেয়ে নিতে?

দোকানদার— ট্রেন চলে যাওয়ার পরে ভগোতীলালের জিম্মায় সব কিছু রেখে আমরা কোনও কোনও দিন মাহাতোদের গ্রামের দিকে চলে যেতাম সবজির খোঁজে। পাহাড়ের ঢালুতে পাথুরে জমিতে ওরা সর্ষে বুনত, বেগুন আর ঝিঙেও হত খুব।

(ওরা আরেকটা চায়ের অর্ডার দেয়। চা আসে। যুবকরা সিগারেট ধরায়।)

তৃতীয় যুবক— আর সেই আন্ডা হল্ট একদিন হল্ট-স্টেশন হয়ে গেল রাতারাতি।

দোকানদার— হ্যাঁ, রাতারাতিই বলা যায়। মোরাম ফেলে লাইনের ধারে কাঁটাতারে ঘেরা জায়গাটুকু উঁচু করা হল প্ল্যাটফর্মের মত।

প্রথম যুবক— তাতে কী লাভটা হল?

দোকানদার— তখন আর শুধু বন্দিদের ট্রেনটাই নয়, মাঝে মাঝে মিলিটারি স্পেশালও এসে দাঁড়াত। প্যান্ট পরা পেছন পকেটে টাকার ব্যাগ গোঁজা আমেরিকান সৈনিকদের স্পেশাল মিলিটারি পুলিশের ট্রেন। তারা ট্রেন থেকে নেমে পায়চারি করত, দু-একটা কী বলতো ওদের ভাষায়।

দ্বিতীয় যুবক— আর ওরা কী করত এখানে এসে?

দোকানদার— সৈনিকের দলও বন্দিদের মতোই সারি দিয়ে মগ আর থালা হাতে একে একে রুটি নিত, ডিম নিত, মগভর্তি কফি নিত। তারপরে যে যার কামরায় আবার উঠত। গার্ড হুইসল বাজিয়ে ফ্লাগ নাড়ত, আমি ছুটে গিয়ে ফর্মে অফিসারকে দিয়ে ও. কে. করাতাম।

প্রথম যুবক— সেই ট্রেন কোথায় যেত?

দোকানদার— সেই ট্রেন কোথায় চলে যেত, কোন দিকে আমরা কেউ জানতে পারতাম না।

সেদিনও এমনি আমেরিকান সৈন্যদের ট্রেন এসে দাঁড়াল।

[আন্ডা হল্টের জোন আলোকিত হয়। দুটো বক্স বা কিউবকেই টেবিল বানিয়ে সার্ভার কুলি তিনজন দাঁড়ানো আর সৈন্যরা লাইন দিয়ে একে একে এগিয়ে এসে ব্রেকফাস্ট নেয়। একজন কফি ঢেলে দেয় মগে, একজন দু-পিস করে পাউরুটি দেয়, আরেকজন দেয় দুটো করে ডিম। ভগোতীলাল নজর রাখছে কেউ ডিম পচা কিংবা রুটি বাসি বলে ছুড়ে দেয় কি না। অন্য একটি ছেলে যে বর্তমানের দোকানদার তার যুবক বেলা, তার হাতে কাগজের একটা লিস্ট। সে কোনও একটা লিস্টে টিক দিচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে সে সৈন্যদের হিসেব রাখছে। ঠিক সেই সময় হঠাৎ তার চোখ গেল কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে। বাকি সব আলো নিভে যায়। একটি স্পটে সেই যুবক এবং অপর একটি স্পটে উইংয়ের ধার-ঘেঁষে দেখা যায় কাঁটাতার থেকে আরও খানিক দূরে মাহাতোদের একটি নেংটি-পরা ছেলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখছে। কোমরের ঘুনসিতে লোহার টুকরো বাঁধা। ছেলেটা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিল ট্রেনটা। কিংবা রাঙা-মুখ আমেরিকান সৈনিকদের দেখছিল। একজন সৈনিক তাকে দেখতে পেয়ে হঠাৎ ‘হে-ই’ বলে চিৎকার করল, আর সঙ্গে সঙ্গে নেংটি-পরা ছেলেটা পাঁইপাঁই করে ছুটে পালাল। কয়েকটা আমেরিকান সৈনিক হা-হা করে হাসছে।]

(আবার চায়ের দোকানের জোন আলোকিত হয়)

দোকানদার— ছেলেটাকে এর আগে কয়েকবার মোষের পিঠে চড়ে যেতে দেখেছি।

প্রথম যুবক— মাহাতোরা কেউ আসত না এদিকে?

দোকানদার— কেউ না। খেতিতে কাজ করতে করতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওরা শুধু অবাক-অবাক চোখ মেলে দূর থেকে দেখত। ভেবেছিলাম ছেলেটাও বোধহয় আর কোনও দিন আসবে না। কিন্তু…

দ্বিতীয় যুবক— কিন্তু!

দোকানদার— তারপর আবার যেদিন ট্রেন এল, ট্রেন থামল, সেদিন আবার দেখি কোমরের ঘুনসিতে লোহা বাঁধা ছেলেটা কাঁটাতারের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে।

তৃতীয় যুবক— আবার?

দোকানদার— এবার সঙ্গে আরেকটা ছেলে, তার চেয়ে আরেকটু বেশি বয়েস। গলায় লাল সুতোয় ঝুলোনো দস্তার তাবিজ।

প্রথম যুবক— ভুরকুণ্ডার হাটে রাশি রাশি বিক্রি হয় মাটিতে ঢেলে, রাশি রাশি তাবিজ, তামার পিতলের দস্তার, বাঁশে ঝোলানো থাকে রঙিন সুতলি, পুঁতির মালা।

দ্বিতীয় যুবক— আমি তো একটা ফেরিওলাকেও দেখেছি কখনও কখনও এক হাঁটু ধুলো নিয়ে, কাঁধে অগুন্তি পুঁতির ছড় আর তাবিজ, দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে মাহাতোদের গাঁয়ের দিকে যায়।

দোকানদার— ছেলে দুটো অবাক-অবাক চোখ মেলে কাঁটাতারের ওপারে দাঁড়িয়ে আমেরিকান সৈনিকদের দেখছিল। প্রথম দিনের বাচ্চাটার চোখে একটু ভয়। যেন তৈরি হয়েই আছে, কেউ একটু ধমক মারলেই সে চট করে হরিণ হয়ে পালিয়ে যাবে।

তৃতীয় যুবক— কেউ ধমক মারল?

দোকানদার— আমি হাতে ফর্ম নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলাম, সুযোগ পেলে হেসে হেসে অফিসারকে তোয়াজ করছিলাম। একজন সৈনিক তার কামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মগে চুমুক দিতে দিতে ছেলে দুটোকে দেখে পাশের সৈন্যকে বললে, ভিখারি কাহিকা!

প্রথম যুবক— (বন্ধুদের বলে) নিজেরাই ভিখারির বাচ্চা শালা।

দোকানদার— (যুবকদের কথা খেয়াল করেনি) আমার এত দিন সেটা মনেই হয়নি। ওরা তো দিব্বি খেতে-খামারে কাজ করে, গুলতি, নয়তো তিরধনুক নিয়ে খাটাশ মারে, নাটুয়া গান শোনে, হাঁড়িয়া খায়, ধনুকের ছিলার মত টান টান হয়ে রুখে দাঁড়ায়। নেংটি-পরা সরু শরীর, কালো, রুক্ষ। কিন্তু ব্যাটা সৈন্যদের ‘ভিখারি কাহিকা’ কথাটা যেন আমাকে খোঁচা দিল। ছেলে দুটোর ওপর আমার খুব রাগ হল। আবার হুইসল বাজল, ফ্ল্যাগ নড়ল, সবাই চটপট উঠে পড়ল ট্রেনে, ট্রেন চলে গেলে আবার সেই শূন্যতা।

প্রথম যুবক— কয়েদিদের ট্রেনটা আর আসত না?

দোকানদার— দিন কয়েক পরেই আবার একটা ট্রেন এল। এবার যুদ্ধবন্দিরা রামগড় থেকে আবার কোথাও চালান হচ্ছে। কোথায় আমরা জানতাম না, জানতে চাইতাম না। ওদের পরনে স্ট্রাইপ-দেওয়া অন্য পোশাক, মুখে হাসি নেই, রাইফেল উঁচিয়ে সারাক্ষণ ওদেরই ট্রেনটা চারদিক থেকে গার্ড দেওয়া হত। ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর লক্ষ্য করলাম, কাঁটাতারের ওপারে শুধু সেই বাচ্চা ছেলে দুটো নয়, খাটো কাপড়ের একটা বছর পনেরোর মেয়ে, দুটো পুরুষ খেতের কাজ ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। ট্রেন চলে যাওয়ার পর ওরা নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করল, হাসল আর কলকল করতে করতে ঝরনার জলের মত মাহাতোদের গাঁয়ের দিকে চলে গেল।

দ্বিতীয় যুবক— সেই দিন ওদের কেউ কিছু বলেনি?

দোকানদার— ট্রেনের জানালায় জানালায় খাকি রং দেখেই বোধ হয় ওরা বুঝতে পারত।

তৃতীয় যুবক— তারপর?

দোকানদার— এভাবে একজন, দুজন, পাঁচজন করে করে পরেরদিন দেখি জনাদশেক মাহাতো-গাঁয়ের লোক ট্রেন আসতে দেখেই মাঠ থেকে দৌড়তে শুরু করেছে। দিনে দুখানা প্যাসেঞ্জার মেল ট্রেনের মতো হুস করে বেরিয়ে যেত, দু-একখানা মালগাড়ি ঠুংঠুং করতে করতে পার হয়ে যেত। তখন তো কই মাহাতো-গাঁয়ের লোক আসত না ভিড় করে!

একদিন গিয়ে বলেছিলাম মাহাতো বুড়োকে…

(দৃশ্য পাল্টায়। দেখা যায় দোকানদারের যুবক বেলার চরিত্র এক বুড়োর সঙ্গে কথা বলে)

দোকানদার— সেদিন ওই দুটো ছোকরাকে পাঠিয়ে যে বললাম, আমাদের আন্ডা হল্টের তাঁবুতে সবজি, চিংড়ি, সরপুঁটি, মৌরলা বেচে আসতে, তার কী হল? কী ঠিক করলে?

মাহাতো বুড়ো— (হেসে) খেতির কাজ ছেড়ে যাব নাই।

দোকানদার— খেতি! কিন্তু আমি তো অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম কালো কালো নেংটি-পরা লোকগুলোকে, খাটো শাড়ির মেয়েগুলোকে আর হাফ ন্যাংটো বাচ্চাগুলোকে।

[তারকাঁটা বেড়ার জোনে কালো নেংটি-পরা লোক, খাটো শাড়ির মেয়ে আর হাফ ন্যাংটো বাচ্চাগুলো দাঁড়িয়ে। ট্রেনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ততক্ষণে এসে গেছে ট্রেন। ঝুপঝাপ নেমে পড়ে সৈন্যরা। আমেরিকান সৈনিকের দল সারি দিয়ে চলেছে মগ আর থালা হাতে। খালি-গা মাহাতো বুড়ো ওদের পেছনে এসে দাঁড়াল।]

ঠিকাদার— দু’শো আঠারো ব্রেকফাস্ট রেডি। বি এফ থ্রি থার্টি টু গেট দু’শো আঠারো ব্রেকফাস্ট।

একজন সৈনিক— লুক অ্যাট দ্য ভেইল অফ ফগ অন দ্য হিল। আ মারভেলাস সিন। হোয়াট আ বিউটি।

[আর একজন সৈন্য কামরার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁটাতারের ওপারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ কফির মগটা পাশের জনের হাতে দিয়ে সে পেছনের পকেটে হাত দিল। ব্যাগ থেকে একটা চকচকে আধুলি বের করে ছুড়ে দিল মাহাতোদের দিকে। ওরা অবাক হয়ে সৈনিকটার দিকে তাকাল, কাঁটাতারের ভিতরে মোরামের ওপর পড়ে থাকা চকচকে আধুলিটার দিকে তাকাল, নিজেরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, তারপর অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই রইল। ট্রেনটা চলে যাবার পর ওরা নিঃশব্দে ফিরে চলে যাচ্ছিল।)

যুবক বেলার দোকানদার— সাহেব বকশিশ দিয়েছে, বকশিশ তুলে নে।

[সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকাল, কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না। সেই যুবক আধুলিটা তুলে মাহাতো বুড়োর হাতে দিল। সে বোকার মত তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর সবাই নিঃশব্দে চলে গেল। কারও মুখে কোনও কথা নেই।]

(আবার চায়ের দোকানের জোন আলোকিত হয়।)

দোকানদার— আমার এই ঠিকাদারের আন্ডারে কাজ করতে একটুও ভাল লাগত না। জনমনুষ্য নেই, একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন দাঁড়ায় না, তাঁবুতে ভগোতীলাল আর তিনটে কুলি। নির্জন এই হল্ট স্টেশনের কাছে মাহাতো-গাঁয়ের লোকরাও ঘেঁষত না। মাঝে মাঝে গিয়ে সবজি কিংবা চুনো মাছ কিনে আনতাম। ওরা বেচতে আসত না।

দ্বিতীয় যুবক— সারাদিন খাটাখাটনি করে কার আর ইচ্ছে করে বলো এতদূর আসতে?

দোকানদার— ওরা কিন্তু ভুরকুণ্ডার হাটে যেত তিন ক্রোশ পথ হেঁটে।

প্রথম যুবক— এরপর ওরা রোজ আসতে লাগল, তাই তো?

দোকানদার— এরপর দিনকয়েক কোনও ট্রেনের খবর ছিল না। সব চুপচাপ। এরমধ্যেই হঠাৎ একদিন…

(অন্য জোনে দেখা যায়, যুবক বেলার দোকানদার আর সেই কোমরের ঘুনসিতে লোহা-বাঁধা ছেলেটা দাঁড়িয়ে। ছেলেটি জিগ্যেস করল…)

ছেলে— টিরেন আসবে না বাবু?

কাগজ হাতে যুবক— (হেসে ফেলে) আসবে, আসবে। তোর আর দোষ কী। সকালে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন একটুও স্পিড না কমিয়ে হুস করে বেরিয়ে যায়, বিকেলের ডাউন ট্রেনটাও থামে না, তবু কয়েক মুহূর্ত জানালায় জানালায় ঝাপসা মুখ দেখার জন্যে আমরাই তাঁবুর ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসি। মানুষ না দেখে আমরাই হাঁপিয়ে উঠি।

ছেলে— খাকি সৈন্যদের টিরেন আসবে না?

যুবক বেলার দোকানদার— সৈনিকদের স্পেশাল ট্রেন আসছে শুনলে যেমন আমাদের খারাপ লাগে তেমনি আবার ভালও লাগে। কালকেই খবর এসেছে কয়েক ঘণ্টা পরেই মিলিটারি স্পেশাল ট্রেন আসবে।

[নিমেষের মধ্যে ছেলেটা দৌড়ে পালিয়ে গেল। পরমুহূর্তেই ট্রেন এসে পৌঁছল। আন্ডা হল্ট জোন আলোকিত হয়। শোনা যায় ঝুপঝাপ করে সৈন্যরা নামল, সারি দিয়ে সব ডিম, রুটি, মগ-ভর্তি কফি নিল। আর তারপরই উইংয়ের দিকে আলো পড়তে হঠাৎ তাকিয়ে দেখা গেল কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে মাহাতো-গাঁয়ের ভিড় ভেঙে পড়েছে। বিশ হতে পারে, তিরিশ হতে পারে, হাঁটুসমান বাচ্চাগুলোকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খাটো শাড়ির মেয়েগুলোও বোকা-বোকা চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল। আমেরিকান সৈনিকরা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে পায়চারি করছিল। দু-একজন স্থির দৃষ্টিতে মাহাতো-গাঁয়ের কালো কালো মানুষগুলোকে দেখছিল।)

একজন সৈন্য হঠাৎ ভগোতীলালের দিকে এগিয়ে গিয়ে পেছনের পকেট থেকে ব্যাগ বের করল একখানা দু-টাকার নোট, তারপর জিগ্যেস করলে…)

সৈন্য— কয়েনস হ্যায়?

ঠিকাদার— নোট ভাঙতি খুচরো আছে নাকি রে কারও কাছে? আমেরিকার সৈনিকরা আবার খুচরো পয়সা রাখতেই চায় না। শহরে গিয়ে দেখেছি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলে, কিপ দ্য চেঞ্জ। (সার্ভার কুলিরা আওয়াজ করে হেসে ওঠে।)

ভগোতীলাল— এক-আনি, দু-আনি আর সিকি মিলিয়ে হয়ে যাবে।

[ভগোতীলাল ভাঙিয়ে দিচ্ছিল, হঠাৎ দেখা যায় কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে ভিড়ের ভিতর থেকে কোমরের ঘুনসিতে লোহার টুকরো বাঁধা সেই ছেলেটা হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে কী একটা চাইছে। ভগোতীলালের কাছ থেকে সেই খুচরো আনি দু-আনিগুলো মুঠোর মধ্যে নিয়ে সেই আমেরিকান সৈনিক মাহাতোদের দিকে ছুড়ে দিল। যুবক বেলার দোকানদারের তখন সাপ্লাই ফর্ম সই করানো হয়ে গেছে, গার্ড হুইসল দিয়েছে। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। ওরা তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, তাকিয়ে ছিল। তারপর ট্রেন চলে যেতেই হঠাৎ লাল মোরামের ওপর, ছড়ানো পয়সাগুলোর ওপর কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে লোক–বউ-বাচ্চা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাড়াকাড়ি করতে লাগল। মারামারি করতে লাগল। মাহাতো বুড়ো ধমক দিয়ে বলে উঠল…

মাহাতো বুড়ো— খবরদার! কেউ তুলবি নি বলচি। ফেল, ফেল, যে যা তুলিছিস ফেল।

[কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না। যে যত পেরেছে আনি দু-আনি কুড়িয়ে নিয়েছে। মেয়েপুরুষের সমস্ত ভিড় হাসছে। মাহাতো বুড়ো রেগে গিয়ে তাদের ভাষায় অনর্গল কী সব বলে গেল। মেয়েপুরুষের ভিড় হাসল। এরপর মাহাতো বুড়ো রাগে গজগজ করতে করতে গাঁয়ের দিকে চলে গেল একাই। মাহাতো-গাঁয়ের লোকগুলোও চলে গেল কলকল কথা বলতে বলতে, খলখল হাসতে হাসতে।]

(আবার চায়ের দোকানের জোন আলোকিত হয়।)

দোকানদার— ওরা চলে যেতেই আন্ডা হল্ট আবার নির্জন। নিস্তব্ধতায়, শূন্যতায় আমার এক-একসময় ভীষণ মনখারাপ হয়ে যেত। দূরে দূরে পাহাড়, মহুয়ার বন, খয়েরের ঝোপ পার হয়ে একটা ছোট্ট জল চোঁয়ানো ঝর্না, মাহাতো-গাঁয়ের সবুজ খেত। চোখ জুড়িয়ে যায়, দেখা যায় কালো কালো নেংটি-পরা মানুষ। (কিছুক্ষণ থামে, আবার শুরু করে) এদিকে মাঝে মাঝেই আমেরিকান সোলজারদের ট্রেন আসে, থামে, ডিম, রুটি, মগ-ভর্তি কফি খেয়ে চলে যায়। মাহাতো-গাঁয়ের লোক ভিড় করে আসে, কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে সারি দিয়ে দাঁড়ায়। চিৎকার করে…

নেপথ্য থেকে একসঙ্গে অনেকগুলো দেহাতি গলা চিৎকার করে— সাব বকশিশ, সাব বকশিশ! বকশিশ সাব। ইধার সাহাব ইধার।

দোকানদার— একদিন সবজি নিতে গিয়েছিলাম, একটা ডাগর মেয়ে হেসে হেসে জিগ্যেস করেছিল, টিরেন কবে আসবেরে বাবু? এক-একদিন অকারণেই ওরা দল বেঁধে এসে দাঁড়িয়ে থাকত, অপেক্ষা করে করে চলে যেত। তিন-চারটে আমেরিকান ততক্ষণে পকেট থেকে মুঠো মুঠো আনি দু-আনি বের করে ওদের দিকে ছুড়ে দিত। পরের দিকে ওরা আর ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা করত না। ওরা হুমড়ি খেয়ে পড়ত পয়সাগুলোর ওপর। হুড়োহুড়িতে কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে হাত-পা ছড়ে যেত কারও, কারও বা নেংটির কাপড় ফেঁসে যেত। ট্রেন চলে যাওয়ার পর ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম ওদের। মাহাতো-গাঁয়ের বোধহয় সকলেই এসে জড়ো হয়েছে। সবারই মুখে ফুর্তির হাসি, সবাই কিছু-না-কিছু পেয়েছে। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেই মাহাতো বুড়োকে দেখতে পেতাম না। মাহাতো বুড়ো আসেনি। সেদিন ওর আপত্তি, ওর ধমক শুনেও পয়সাগুলো ফেলে দেয়নি ছেলেমেয়েগুলো। তাই বোধ হয় রেগে গিয়ে আর আসেনি। আমার ভাবতে ভাল লাগত বুড়োটা খেতে দাঁড়িয়ে একা-একা মাটি কোপাচ্ছে।

দ্বিতীয় যুবক— কাকা, এবার শেষ করো গল্প।

দোকানদার— গল্প নয় বাবু, সত্যি। এক বর্ণও গল্প নয়।

প্রথম যুবক— না গো কাকা, তুমি বলো। এই, তোর শুনতে ইচ্ছে না করলে তুই বাড়ি যা।

তৃতীয় যুবক— হ্যাঁ কাকা, তুমি বলো।

দোকানদার— ভগোতীলালকে নিয়ে আমাদের পাঁচজনের দিন আন্ডা হল্টের তাঁবুর মধ্যে কোনওরকমে কেটে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে এক-একদিন সৈনিক-বোঝাই ট্রেন আসছিল, থামছিল, চলে যাচ্ছিল। মাহাতো-গাঁয়ের লোক ভিড় করে এসে কাঁটাতারের ধারে সারি দিয়ে দাঁড়াত, হাত বাড়িয়ে সবাই ‘সাব বকশিশ, সাব বকশিশ’ চেঁচাত। হঠাৎ এক-একদিন মাহাতো বুড়োকে দেখতে পেতাম কোনও দিন খেতের কাজ ফেলে দু-হাতের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হনহন করে এগিয়ে আসত, রেগে গিয়ে ধমক দিত সকলকে ওর কথা শুনছে না বলে। আবার কখনও বা অসহায় প্রতিবাদের চোখে গাঁয়ের লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু ওর দিকে কেউ ফিরেও তাকাত না। সৈনিকরা পেছন পকেটে হাত দিয়ে হা-হা করে হাসতে হাসতে মুঠো-ভর্তি পয়সা ছুড়ে দিত। মাহাতো-গাঁয়ের লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ত সেই পয়সাগুলোর ওপর, নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে ঝগড়া বাধাত। তা দেখে সৈনিকরা হা-হা করে হাসত।
শেষে পর পর কয়েক দিন লক্ষ করলাম মাহাতো বুড়ো আর আসে না। মাহাতো বুড়ো ওদের দেখে রেগে যেত বলে, মাহাতো বুড়ো আর আসত না। আর সেই কারণেই আমার একধরনের গর্ব হত। এক-একসময় ওই লোকগুলোর ব্যবহারে আমরা, মানে আমি আর ভগোতীলাল খুব বিরক্ত হতাম, ভিতরে ভিতরে লজ্জা পেতাম। ওদের দেখে সৈনিকের দল ওদের ভিখিরি ভাবত, এমনকি বলতও কখনও-সখনও। সেটা আমার খুব খারাপ লাগত। সেদিনও কাঁটাতারের ওপার থেকে ওরা বকশিশ বকশিশ বলে চিৎকার করছে…

[কাঁটাতারের জোন আলোকিত হয়। লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে। তারা বকশিশ বকশিশ বলে চিৎকার করছে, গার্ড জানকীনাথের সঙ্গে যুবক বেলার দোকানদার গল্প করছে। পাশে দাঁড়িয়ে একজন অফিসার চিৎকার শুনে থুতু ফেলার মত গলায় বলে উঠল, ব্লাডি বেগার্স।

যুবক আর জানকীনাথ পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তাদের মুখ অপমানে কালো হয়ে গেল। মাথা তুলে তাকাতে পারল না। শুধু রাগে ভিতরে ভিতরে জ্বলে উঠল, তারা চিৎকার করে উঠল, ব্লাডি বেগার্স, ব্লাডি বেগার্স।

(চায়ের দোকানের জোন আলোকিত হল।)

দোকানদার— আমাদের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল মাহাতোদের ওপর। ট্রেন চলে যেতেই আমি আর ভগোতীলাল ওদের তাড়া করে গেলাম। ওরা কুড়োনো পয়সা ট্যাঁকে গুঁজে হাসতে হাসতে পালাল।

দ্বিতীয় যুবক— এবার সত্যি উঠতে হবে। না হলে পরের ক্লাসে লেট হবে। (তিনজন যুবক উঠে দাঁড়াল)

দোকানদার— (কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে বলে যেতে লাগল) কিন্তু সেদিন আমার বুকের মধ্যের সমস্ত জ্বালা জুড়িয়ে গেল।

(আন্ডা হল্ট জোন আলোকিত হল। দুজন সার্ভার কুলি তখন টেবিল বানানোর ব্লকগুলোকে ঠেলে ঠেলে আন্ডা হল্টের কাঁটাতারের ওপারে সরিয়ে দিচ্ছিল। তাঁবুর দড়ি খুলছিল আর একজন।)

ভগোতীলাল— (ব্লকটার গায়ে একটা জোর লাথি মেরে বললে) খেল খতম, খেল খতম।

[হঠাৎ হইহল্লা শুনে চমকে ফিরে তাকায় সকলে। দেখা যায় মাহাতো-গাঁয়ের লোক ছুটতে ছুটতে আসছে। ততক্ষণে কাঁটাতারের ওপারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে গেছে ওরা। সঙ্গে সঙ্গে একটা হুইসল শুনতে পাওয়া যাবে, ট্রেনের শব্দ কানে আসবে।]

দোকানদার— ট্রেনটা তো আন্ডা হল্টের দিকেই আসছে, জানালায় জানালায় খাকি পোশাক। তা হলে কি ভুল খবর পাঠাল আপিস?

ভগোতীলাল— না কি যে খবরটা শুনে এসেছে সেই ভুল খবর দিয়েছে?

[ট্রেনটা যত এগিয়ে আসছে ততই একটা অদ্ভুত গমগম আওয়াজ আসছে। আওয়াজ নয়, গান। একটু কাছে আসতেই বোঝা গেল সমস্ত ট্রেন, ট্রেন-ভর্তি সৈনিকের দল পরস্পরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছে। ইংরেজি গান শোনা যায়। সেই মুহূর্তে কাঁটাতার জোনে আলো পড়বে মাহাতো বুড়োর ওপর। সমস্ত ভিড়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে মাহাতো বুড়োও হাত বাড়িয়ে চিৎকার করছে, সাব বকশিশ, সাব বকশিশ, বাকিরা তখন মাইমে ভিক্ষা চাইছে। উন্মাদের মত, ভিক্ষুকের মত তারা সকলেই আসলে চিৎকার করছে। এবং সঙ্গে সেই মাহাতো বুড়ো।

(চায়ের দোকানের জোন আলোকিত হয়।)

দোকানদার— আমেরিকান সৈনিকদের সেই ট্রেনটা অন্যদিনের মত এবারে আর আন্ডা হল্টে এসে থামল না। প্যাসেঞ্জার ট্রেনগুলোর মতই আল্ডা হল্টকে উপেক্ষা করে হুস করে চলে গেল। আমরা জানতাম ট্রেন আর থামবে না। ট্রেনটা চলে গেল। কিন্তু মাহাতো-গাঁয়ের সবাই ভিখিরি হয়ে গেল। খেতিতে চাষ করা মানুষগুলো সব— সব ভিখিরি হয়ে গেল।

(যুবক তিনজন যেন আকস্মিকতায় বোবা হয়ে গিয়েছে। তারা নিঃশব্দে চায়ের গেলাস নামিয়ে রাখল। পকেট থেকে টাকা বের করে রাখল। নিঃশব্দে হেঁটে চলে গেল। দোকানদারও যেন বোবা হয়ে গিয়েছে। সেও আর কিছুই বলতে পারছে না। নাটক নিঃশব্দে শেষ হবে।)