অসীম দাস
খামারচন্ডী নাট্যপ্রহরীর প্রযোজনা ‘পরিযায়ী’ নাটকটির অভিনয় দেখলাম গত ১৩ মার্চ ২০২২ শিশির মঞ্চে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত একবিংশ নাট্যমেলায় নাটকটির ষষ্ঠ অভিনয় অভিনীত হলো। শিশির মঞ্চে রবিবারের সন্ধেটা এমন গরম হয়ে যাবে সেদিন ভাবতে পারেনি আমার মতো অনেকেই । নির্দেশক পুলক রায়কে চিনতাম একজন ভালো অভিনেতা, দক্ষ সংগঠক, সু- আয়োজক হিসেবে। ওঁর কথায় মোহিত হওয়ার মতো কিছু তো আছেই যাতে আমাকে আবিষ্ট করেছে! উনি খুব ভালো বন্ধুও বটে। তা না হলে হল ভর্তি থিয়েটারের পূজনীয় দর্শক এত উত্তেজিত, আহ্লাদিত হবেন কেন? ওঁর কথায় জাদু আছে। ওঁর অভিনয়ে সেই সম্মোহন আছে।
সিঙ্গুর হরিপালে যে কটি নাট্যদল বর্তমানে নিয়মিত অভিনয় করে তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম নাট্যপ্রহরী।
গ্রামবাংলার মফস্বলে মাঁচার মঞ্চ থেকে বাঁধানো মঞ্চ, প্রহরের পর প্রহর জাগিয়ে রেখে নাট্য সংস্কৃতির মঞ্চে নিজেকে আলাদা করে পরিচয় করাতে ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ তে পুলক হরিপালে প্রতিষ্ঠা করেন নাটকের দল নাট্যপ্রহরী। ১৯৯৬ তে দলটির সরকারী নিবন্ধীকৃত হয়। নাটকই ধ্যান, নাটকই জ্ঞান এই ছিল পুলকের মন্ত্র। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কারিগর পুলকও একদিন স্বপ্ন দেখেছিল থিয়েটারকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবে। তাই নয়ের দশক থেকে বড়দাদা নাট্যব্যক্তিত্ব অশোক রায়ের কাছে তালিম নেওয়া। নাটকের প্রয়োজনে রবীন্দ্রভারতীতে পড়াশোনা না করতে পারলেও পুঁথিগত বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে নাটকের মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদ করবে, বিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখবে। এসব স্বপ্ন দেখেছেন পুলক। আর এসব স্বপ্ন দেখতে গেলে চাই অর্থ, লোকবল, মনোবল আর ইচ্ছে। আর এই ইচ্ছেতে ভর করে নাট্যপ্রহরী একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক দল যারা এই অস্থির সময়ে মাটি আঁকড়ে টিকে থাকতে পেরেছে।
পরিযায়ী নাট্যটি আসলে এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার নাটক। এ সঙ্কট শুরুতে সব দলেরই ছিল, থাকে। অনেকেই সেই সঙ্কট থেকে হয়তো মুক্তি পেয়ে যায়। কেউ পায় না!
পৃথিবীতে এমন মহাসঙ্কট, অতিমারি হয়তো আগেও এসেছে কিন্তু সাড়া বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়াতে, লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে তা ভাবা যায় না। রাষ্ট্রীয় কপিকলে চাপের মুখে মানুষ নতি স্বীকার করেছে। খিদে সহ্য করেছে। মানুষ একা হয়েছে, কাজ হারিয়েছে। পাখির মতো মানুষও হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিক।
শুদ্ধসত্ব ঘোষের নাটকে যে সঙ্কটের কথা বলা হয়েছে তা হলো মফস্বলে পুলক একজন নাট্যকর্মী। মফস্বলে একটি নাট্যদল চালায়। এই অতিমারির সময় রাষ্ট্র যখন সমস্ত কিছু তে লকডাউন ডেকে দিয়েছে, বিধিনিষেধ এনেছে যন্ত্রে, চলাচলে, চাকায়। করোনা আসার আগে রিহার্সাল হচ্ছিল অলোকবাবুর ভাইপোর বাড়ির ছাদের ঘরে। কিন্তু এই মুহুর্তে অন্য কোথাও রিহার্সাল করতে হবে। এ বাড়িতে করা যাবে না। ভাইপোর সাফ কথা। এখান থেকেই শুরু হয় বিবাদ। এতদিনের অভ্যাস মতো দলের সবাই ভিড় করছে বাড়িতে। নাটকের জিনিসপত্র সব সরিয়ে ফেলতে হবে,এখানে কেউ যেনো না আসে একথা কিভাবে বলবে পুলক ? পাড়ার মানুষজন এ নিয়ে কানাঘুষো করছে। এই দলে অলোকবাবুও অভিনয় করেন। চাপ আসছে ভাইপোর থেকে তার উপর।অলোকবাবু উপায়হীন হয়ে স্থিতিবস্থার পায়ে মাথা নত করে ফেলেছে। দলের আরেক কর্মী রমেনের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অবিবাহিত সংসারে প্রতিদিন অশান্তি। পয়সা নেই, শান্তিও নেই। দলে এসে দেখে এখানেও এক নতুন সমস্যা। তাহলে তো ঠিকানাহীন দল এখন? মনের খিদে মেটাতে নাটকের মহড়া দিতে কোথায় আশ্রয় নেবে তারা?
পৃথিবী জুড়ে এই নতুন সংকটে রাষ্ট্র কেমন নির্বিকার , ধনতান্ত্রিক শক্তিবান মানুষগুলো আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। নিরাপদে নেই কেউ, নিরাপদ নয় কোথাও আমরাও ।
পুলকের ভেতরের তেজ আর রমেনের মনের আগুন এক হয়ে আগুনের বর্ণমালা তৈরি হয়। শেষে রমেনের বাড়িতে ওড়ে থাকা পুরনো সাইকেলকে অবলম্বন করে দুজনে নেমে পড়ে ময়দানে, রাস্তায় । সাইকেলে চেপেই জীবনের খেলা সাজাতে মেতে ওঠে রমেন। দিনরাত সাইকেলে চেপে খেলা দেখানো, খাওয়াদাওয়া, স্নান, ঘুম সব। তাতে সাথ দিয়েছে পুলক। জীবনের নতুন নাটককে বাস্তবের মাটিতে রেখে শুরু হয় নতুন লড়াই। লোক জড়ো করে পথনাটক চলছে। মানুষ সাহসী হয়ে উঠছে। সব বিধিনিষেধ, ভয়কে ভুলে মানুষ কাছে এসেছে।
নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল ২৬ জানুয়ারি ২০২১, পুলক রায় পুলকের চরিত্রেই এবং রমেনের চরিত্রে সঞ্জয় বটব্যাল অসাধারণ অভিনয় করেছেন। সাইকেলে বসে রিং এর খেলা, যতটা আস্তে চালানো সম্ভব, আধুনিক কসরত এসব শিখে উঠতে হয়েছে সঞ্জয়কে। চিন্ময় চক্রবর্তীর অলোক নাটকের দাবি মেনেই অভিনয় করেছেন। ওনার মনের যন্ত্রণা, নেপথ্যে থাকা ভাইপো যেনো ক্রমাগত জ্বালিয়ে গেছে। নাটকটির গতি চড়া, কেউবা স্কেলে সংলাপ বলেছেন এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। বরং ভাবতে হয় নাট্যকার কেমন করে ভেবেছেন, কোন সময়ের সাথে অতিমারির তীব্রতাকে মিলিয়েছেন। লেখকের লেখায় যে কতটা শক্তি ধরে তা একমাত্র পাঠক জানে, রাষ্ট্র জানে কি? মঞ্চ ভাবনা নিয়ে একটু ভাবতে বলবো নির্দেশককে। আরো পরিচ্ছন্নতা ও জিনিসপত্রের দাবি রাখে। যেমনটা দেখেছিলাম গৌতম মুখোপাধ্যায়ের ধৃতরাষ্ট্র নাট্যে রিহার্সাল রুমের পরিবেশ। বিশ্বজিৎ বিশ্বাসের আবহ এবং দীপ সরকারের আবহ নিয়ন্ত্রণ নাটকের প্রয়োজন মিটিয়েছে। দেবব্রত চক্রবর্ত্তীর আলোতে তেমন মায়া চোখে পড়েনি। শেষের দৃশ্যে মনে দাগ কাটার মতো কিছু আলো ভাবা যেতেই পারতো। আর
সাইকেল নিয়ে আরো জাগলারি শিখতে হবে সঞ্জয়কে। কলকাতা মফস্বলে একসময় এই খেলা মোড়ে মোড়ে দেখা যেতো। এসব শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। নাটকের মধ্য দিয়ে দূষণ মুক্ত সাইকেল নিয়ে এই খেলার একটা পরিবেশ ফিরে আসার সম্ভাবনা যদি পাওয়া যায় আবার মোড়ে, গলিতে!
তবে শেষ পর্যন্ত কি বাস্তবের পুলকের নিজস্ব মহড়া কক্ষ তৈরি হবে সেটাই এখন দেখার!
অমল আলো জার্নাল থিয়েটারের ইতিহাস কে সংরক্ষন করতে খুব ভাল উদ্যোগ নিয়েছে।তাদের জার্নালে নাট্যপ্রহরী প্রযোজনা “পরিযায়ী” নিয়ে অসীম দাসের আলোচনাটি আমাদের সমৃদ্ধ করবে।অসীম দাস ও সম্পাদক অভি চক্রবর্তী কে ভালবাসা জানাই।অমল আলো একটি থিয়েটার স্পেশ।সেখানে নিয়মিত নানা অনুষ্ঠান চলে।তাকে কেন্দ্র করে এবং পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তের থিয়েটার চর্চা এই জার্নালে প্রকাশ হয়।এমন কাজ আরো হোক।
শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ ও পুলক রায়ের কাজটি দ্যাখার অপেক্ষায় রইলাম। ধন্যবাদ।