অভি চক্রবর্তী
এখন প্রশ্ন হচ্ছে মণীশের নাট্য, অর্ঘ্যের নাট্য দেখে যাচ্ছি বহুদিন ধরে। নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন এসেছে মাঝে মাঝে, কেন দেখতে যাই?
◆ সবসময়ই সমকাল স্পষ্ট হয়ে ধরা দ্যায় বলে?
◆ দারুণ একটা পারফর্মেন্সে বুঁদ হয়ে থাকার জন্য?
◆ মাঝে মাঝেই ধ্রুপদী সংগীত শোনার মতো অনুভব হয় বলে?
◆ ঠিক আগের প্রজন্মের একজন নির্দেশক ধারাবাহিক প্রায় পঁচিশ বছর ধরে শুধু থিয়েটারের মধ্যেই নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন কি করে?
◆ নাকি সম্পর্ক আমাদের এই টলমল সময়েও, এই জীঘাংসাময় সোশ্যাল আচ্ছাদনেও বেশ মধুর বলে?
আমি যাবার সময় ট্রেনে উঠতে উঠতেই এসব ভাবছিলাম। সঙ্গে ছিল দলের বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী। তারা প্রসেনিয়াম জ্ঞান মঞ্চ (২.৬.২০২২) প্রেক্ষাগৃহে মণীশ দার নাট্য এই প্রথমবার দেখবে।
এদিন কিন্তু অন্য প্রশ্নের মাঝে ফেললেন মণীশ। প্রথমেই সাইকোসিসের কথা বলি, যেখানে অর্ঘ্যের মহলাঘরই, অভিনেতা তৈরির পদ্ধতিগুলিই যেন দর্শককে ডেকে দ্যাখালেন মণীশ। সহজে বলে ফেল্লাম। কারণ আমাদের এই আস্ত নাট্যসমাজ নাকি নাট্যে গল্প খুঁজে বেড়ায়! মণীশের নাট্যে আমি কখনোই কিন্তু এই গল্প বলবার সরল পদ্ধতি দেখিনি। বরং যেকোনো গল্পের লিনিয়ার ন্যারেটিভকেই মণীশ ভাঙচুর করে নাট্য তৈরি করেন, নিজস্ব ধরনে। যেখানে তিনি ভয়ানক প্রান্তিক। বিচ্ছিন্ন এবং দুর্গম গিরিখাতের মতো একা। এই একলা মণীশ সারাকেনের 4.48 সাইকোসিসকে বাংলায় আনলেন, আনলেন অর্ঘ্যের নাট্য তৈরির যে নিজস্ব ভাষা এতোদিন ধরে তিনি সযত্নে তৈরি করেছিলেন তাঁর সমস্ত পরিক্ষার বাইরে গিয়ে। একটা নিজস্ব সিগনেচার তৈরি এবং তা কন্টেন্টের সঙ্গে যাক বা না যাক তাকে মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়ার যে খেলা তথা ভান তথা কৌশল আমরা বহুনাট্য নির্মাণ কাজেই দেখি মণীশ তা ছাড়খার করে দিলেন।
গোটা নাট্য জুড়ে কৌস্তভ খুঁজে গেলেন সৎ অভিনয়ের ভাষা। বারবার যে কারণে নাট্য বন্ধ করে দিচ্ছেন তিনি, দলের তরুণীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন। হেনস্থা করছেন বাকি অভিনেতাদের। লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে সব। এক বর্ণাঢ্য তছনছের উৎসব যেন…
কোথাও দর্শক হিসেবে কিন্তু আমার মনে হয়েছে এও তো সাজানো, এও তো তৈরি। আবার পরক্ষণেই মনে হয়েছে এর মধ্যে দিয়েই তো অভিনেতা তার যাবতীয় মন ও শরীর দিয়ে নগ্ন সত্যের দিকে যাবেন! এছাড়া তার কাছে পথ কি? আমরা সবাই তো ‘সাজানো ঘটনা’র বাইরে আসতে চাইছি… স্তানিস্লাভস্কি থেকে ব্রেশট হয়ে গ্রোটস্কি অব্দি এই জার্নিই তো বহমান… নাট্যের অন্তিম দৃশ্যে কৌস্তভ যখন উলঙ্গ হয়ে অভিনীতব্য চরিত্র অন্বেষণের জন্য মঞ্চে ঢুকে পড়ে… অভিনয়ে থাকতে চান। তখন কিন্তু সাইকোসিস আর নাট্য থাকেনা, প্রদর্শনের বড়াই থাকেনা বরং অভিনেতার প্রস্তুতির যে অগোছালো কয়েকটি ধারার কথা উল্লেখ করলাম, মণীশ খুব দৃঢ়ভাবে সেই ধারায় আত্ম-অস্মিতার স্বাক্ষর রেখে গেলেন। যে কথা তত্ত্বে লেখা সহজ, প্রবন্ধে কথার পর কথা রেফারেন্সের পর রেফারেন্স জড় করে সামনে আনা সহজ মণীশ তা বল্লেন আরেকটি অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই। এ বড় জরুরি কাজ। নাট্য শেষপর্যন্ত মঞ্চসাহিত্য, মঞ্চ অধ্যয়ন। এ নাট্য যেন সেকথাই বলে যায় আবার।
আরেকটি কথা উল্লেখ করে এই সামান্য প্রতিক্রিয়ার অবসান ঘটাব, তা হল এই যে এই নাট্যের কোরাসের ব্যবহার। যেখানে কেউ আসলে কিছুই করেনা। ভয়ঙ্কর নিঃশব্দে বসে থাকে। বসে থাকে মাস্ক পরে। এক অত্যাশ্চর্য ভঙ্গিতে। তাদের মুখমন্ডলের নিস্ক্রিয়তা এক আশ্চর্য শঙ্কার জন্ম দ্যায়…যে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে নাট্যের শেষে দর্শকদের মধ্যে। ‘কথা বলো, কথা বলো। সুস্থ থাকার ভান কোরো না।’
পরপর অভিনেত্রীদের আত্মহত্যা, একলা অসহায় হয়ে যাওয়া মানুষের অবসন্নতাকে আশ্চর্য নিরাভরণ সত্যে ধরলেন অর্ঘ্যের কুশলীরা। প্রথমে উল্লেখিত সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বলেও আরো নতুন কিছু নিয়ে ফিরলাম সাইকোসিস দেখে। নতুন কিছু।
ব্রিটিশ লেখক সারা কেইন তাঁর জীবনের অল্প সময়ে জীবন নাট্যের গভীর বিষয় নিয়ে যেমন — মুক্তির প্রেম, যৌন আকাঙ্ক্ষা, বেদনা, অত্যাচার—শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক—এবং মৃত্যুর বিষয় নিয়ে কাজ করে গেছেন। তাঁর লেখার কাব্যিক তীব্রতা, ভাষা, নাট্য রূপের অন্বেষণ বরাবর চরম এবং হিংসাত্মক। সাইকোসিস 4.48 বাংলায় তেমনই এক সাহসী কাজ এই আলোচনা থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম। বরং দেখার আগ্রহ বাড়িয়ে তুললেন মণীশদা।
অবশ্যই দেখো।
দারুন লেখা। নাটকটি অবশ্যই দেখবো❤️।
এই প্রতিবেদনের জন্য শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা
ধন্যবাদ দাদা। তোমার আন্তরিকতা ভালবাসা এবং থিয়েটারের প্রতি নিষ্ঠ থাকা আমাদেরকে প্রাণিত করে।
Darun natok..sokoler dakha uchit
একদম ঠিক বলেছিস।
নাটকটা দেখলাম।