ছোটবেলার পুজোর কথা মনে করতে গেলেই আগে সে সময়টাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে কিন্তু সে মনে হয় এমন একটা পৃথিবী যার অস্তিত্ব যে আদপে কখনো ছিল সেটাই এখন কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়। ছোটবেলাটা যেমন মনে আছে পুজোর অনেকটা আগে থেকেই পুজোর উৎসাহ, উদ্দীপনা শুরু হত ঠিকই কিন্তু আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। পাঁচ ভাই-বোন। সকলের জন্যই একই কাটিং-এর জামা আসতো। শুধু ভাই এর জন্য অন্য, বাকি আমরা চার বোন তাদের জন্য একইরকম জামা আসতো দেশপ্রিয় পার্কের হকার্স কর্ণার থেকে। এবং যে দোকান থেকে জামা আসতো সেটাও একদম নির্দিষ্ট। সেখান থেকে একইরকমের ছিটের সকলের, সাইজ আলাদা আলাদা রকম, এখনো চেষ্টা করলে দেখতে পাই সেই সাদার উপর প্রিন্টেড সুন্দর সুন্দর ফ্রকগুলো পরে আমরা চারবোন সেই অবিশ্বাস্য পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সেখান থেকেই পুজোর উৎসাহ শুরু হতো। আর পঞ্চমীর দিন রাতে বাবা নিয়ে যেতেন ঠাকুর দেখাতে। সেই সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে বেরনো পঞ্চমীর দিন রাতে, যদিও তখন এমন ভিড় হতো না। থিমের পুজোর ব্যাপারও ছিল না। বিশেষত জোর দিতাম উত্তর কোলকাতার দিকের ঠাকুর। মহম্মদ আলি পার্ক, বাগবাজার সার্বজনীন এগুলো দেখতেই হবে এরকম একটা ব্যাপার ছিল। ত্রিধারা আমার পাড়ার পুজো। কিন্তু সেইসময়ের ত্রিধারা ও এইসময়ের ত্রিধারা একেবারেই মেলানো যাবেনা। তখন ভারি বেমানান সব রঙের কাপড়ে ত্রিধারার পুজোর প্যান্ডেল তৈরি হতো। আর ষষ্ঠীর ভোর থেকেই আমরা বাড়িতে ঠাকুরের যে বটি আছে, সেই বটি নিয়ে দৌড়ে চলে যেতাম প্যান্ডেলে। কারণ ফল কাটতে হবে তো! এলোমেলো হাতে খাপছাড়া সাইজের ফল কাটতাম কিন্তু তারমধ্যে সে এক অনাবিল আনন্দ। আর পাড়ার দাদাদের বলতাম কাপড়ের রংগুলো এমন বেমানান কেন? আরেকটু মানানসই করা যেত না? পাশেই দেশপ্রিয় পার্কের জাঁকজমক পূর্ণ পুজো সবেতেই যেন ত্রিধারা কিরমক যেন পিছিয়ে থাকতো। আর পুজোর দিনগুলো আরেকটা বড় আকর্ষণ ছিল, ঐ ত্রিধারার পুজো মণ্ডপকে কেন্দ্র করে প্যান্ডেলের সামনে বসা। ঠাকুর দেখতে বেরোনোর ওই পঞ্চমীর দিনই যা তাছাড়া অনান্য দিন যে খুব একটা ঠাকুর দেখতে যেতাম তা না। কিন্তু ঐ যে পাড়ার সব ববি,মিমি, রাখি, টুম্পা, ঝুম, টিঙ্কু, মিঠুন, রূপা সবাই একজোট হবো সেই দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আরেকটা দারুণ ব্যাপার ছিল- সেটা হচ্ছে,পুজোর সময় নাটক। পাড়ার জ্যেষ্ঠ অভিভাবক গোছের মানুষ, সকলের দাদা। সেই দাদাই ছিলেন আমাদের সবরকম সাংস্কৃতিক ইচ্ছাপূরণের রসদ। পুজো ঠিক শেষ হতেই আমাদের চারমাথা মোড়ে প্যান্ডেল বেঁধে আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এবং তার জন্য প্রস্তুতি চলতো বহুদিন ধরে। কোনোবার অবাক জলপান, কোনোবার বা চিত্রাঙ্গদা। পাড়ার ছোটদের একধরনের নাটক। বড়দের আরেকধরনের নাটক। সেই সময় থেকেই বোধয় নাটকের প্রতি, নাচের প্রতি,গানের প্রতি অন্য আকর্ষণ তৈরি হওয়া। সে যে কি আনন্দের সেই আনন্দের সঙ্গে এখনকার কোনো আনন্দেরই তুলনা হবে না। ঐ যে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া শাড়ি জামা নিয়ে সেজে-গুজে মঞ্চে ওঠা, তারমধ্যে একটা অনাবিল আনন্দ ছিল। মনে আছে একবার রিহার্সালে, পাড়ার দিদি ডলু দি রিহার্সাল করাচ্ছে, আমি চিত্রাঙ্গদায় গ্রামবাসীর নাচ করছি কারণ চিত্রাঙ্গদায় মেন রোলগুলো পাড়ার বড়রা করছে। গ্রামবাসীর নাচ করতে গিয়ে দেখা গেল যে একমাত্র আমিই গ্রামবাসী, যে পৌঁছতে পেরেছি আর বাকি কেউই আসেনি। তো মনে আছে ডলি দি খুবই কড়া দিদিমণি, চোখ পাকিয়ে বলেছিল তুমি একা? বাদ দিয়ে দেবো এবার। সে যে কি আকুতি তারপর বাকিদের ডেকে তোরা আয়, তোরা আয়, নাহলে আমরা বাদ হয়ে যাবো। এবং সেই শাড়ি জড়িয়ে নাচ। সে মানে, ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না সেই আনন্দ। পুজোর দিনগুলো কেটে যাওয়ার পর ঐ যখন বিসর্জনের বাজনা বাজতো তখন ভারি মন খারাপ হতো ঠিকই, কিন্তু অনুমতি ছিলনা বাড়ি থেকে যে ঐ যে বিসর্জনের সাথে সাথে একটু যে প্রফেশনে হেঁটে যাবো তার। একবার লোভে পরে ঐ সবাই যাচ্ছে, আমরাও একটু বিসর্জনে হাঁটতে যাই বলে আমি আর বোন হাঁটতে বেড়িয়ে পরেছিলাম। তারপর বাড়ি ফিরতে বেশ খানিকটা রাত। বাড়ি যখন ফিরলাম দেখলাম থমথমে পরিবেশ, বাবা আমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি ভাবলাম বাবা ফেরার আগে খাওয়া-দাওয়া সেড়ে শুয়ে পরবো যেন বকুনিটা না খেতে হয়। কিন্তু সে যা বকুনি খেলাম, সে বকুনি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বকুনি খাওয়া। যে বাড়িতে না জানিয়ে বিসর্জনের প্রশেসানে চলে যাওয়ার। তারপরে দেশপ্রিয় পার্কের খুব জাঁকজমক পূর্ণ প্রশেসান যখন যেত তারপাশে আমাদের ত্রিধারার টিমটিমে প্রশেসান এবং স্মৃতিতে থেকে যেত ঐ যে ফাঁকা মণ্ডপে জ্বলে থাকা একলা প্রদীপটা। আর বিসর্জনের দিন পুরস্কার হিসাবে পেতাম ময়ূরের পেখমের পালক। সেটা হাতে নিয়ে বিশ্বজয়ের আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফেরা। আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেলাম যে, বাড়িতে ছিল শিউলি গাছ, তাই পুজোর আমেজ প্রথম আসতো বোধয় সেই শুয়োপোকার আগমন দিয়ে। শুয়োপোকা ঢুকে পড়ছে গায়ে ঘষা লেগে যাচ্ছে সেটাকে ব্লেড দিয়ে চেঁচে তুলে সেখানে চুন লাগানো হচ্ছে এবং সেই শুয়োপোকাই বহন করে নিয়ে আসছে পুজোর শুভ সূচনা। সেই শিউলি ফুলের গন্ধ, এখন আর আশেপাশে সেরম একটা শিউলি ফুল দেখতে পাইনা কিন্তু সেই শিউলি ফুলের গন্ধ যেন এখনো নাকে আসে । সেই থিমবিহীন, সেই জাঁকজমকবিহীন কিন্তু আন্তরিক পুজোর গন্ধ যেন এখনো পাই। আরেকটা কথাও বলা হলো না, বিজয়ারও একটা অন্যরকম মজা ছিল। ঐ বিজয়ার প্রণাম করতে যাওয়ার এক দারুণ উৎসাহ ছিল। বাড়ি থেকে টিফিন বক্স নিয়ে বিজয়ার প্রণাম করতে যেতাম। গলির সামনের বাড়িটাতেই একতলা, দুতলা, তিনতলা, তিনটে তলাতেই প্রণাম করতে যেতাম। ঐ যে নিমকি আর মিষ্টি , যে যা দিত সবটা খেতে পারতাম না। ঐ টিফিন বক্সে ভরে বাড়ি নিয়ে আসতাম।সেটাও একটা দারুণ মজার ব্যাপার ছিল। সে পুজো বদলে গেল খুবই দ্রুত।
One thought on “পুজোর গন্ধ – সেঁজুতি মুখোপাধ্যায়”
Comments are closed.
বাঃ!❤️