বাতাসে নাক লাগিয়ে শুঁকতে শুঁকতে নাক ব্যথা হয়ে গেল। পুজোর গন্ধ পাচ্ছি না। কী জানি আাগে, মানে ছোটবেলায়,নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা দেখতে পেতাম। কোনোটা পাতার ভেলা, কোনোটা আবার দুধ সাদা তরলের মতো। মনে হোতো এই বুঝি বা গলে পড়বে আকাশ থেকে। আর গন্ধ? ধূপধুনোর। এটা অবশ্যম্ভাবী। দিদা আমাদের বাড়ি এসে থাকতো কখনো সখনো। আমার দিদার চুল ছিল দুধ-সাদা,গায়ের রঙটাও। মুখটা তিনকোণা,ছোট ছোট নরূণচেরা চোখ,পাতলা ফিনফিনে নাক আর ততোধিক পাতলা ঠোঁট দুখানি।ঠিক যেন রূপকথা বইয়ের ছবি। মুখে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে আমাকে আার ভাইকে শোনাতো “আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি পূজার সময় এলো কাছে/মধু-বিধু দুইভাই ছুটাছুটি করে তাই আনন্দে দুহাত তুলি নাচে…..”কবিতাটা বলতে বলতে অল্প অল্প দুলছে দিদার থানপরা সাদা শরীরটা আর আমরা দুইভাই -বোন হাঁ করে চেয়ে আছি দিদার মুখের দিকে!!!দিদার গা থেকে একটা গন্ধ পেতাম। জবাকুসুম না কুন্তলীন -কে জানে। তখন তো আর কেউ ভাবেনি যে এই ছবিটাও সারা জীবনের মতো মনের ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবি হয়েই রয়ে যাবে আর সেটাকেই উল্টেপাল্টে ঝেড়েমুছে দেখতে হবে ভবিষ্যতে! গন্ধ বিষয়টাও অনেকটাই তেমনই । আগে এক নিমেষে নাকে পেতাম এখন সেটা নাক কুঁচকে জোর করে শুঁকে শুঁকে খুঁজতে হয়। পুজোর গন্ধ। আকাশের গন্ধ।
আমার বাবা পাবলিশারদের ভৃত্য ছিলেন। কলেজস্ট্রিট তার ঠিকানা ছিল। পুজোর আগে অজস্র পুজোসংখ্যায় গপ্প উপন্যাসের ইলাস্ট্রেশন প্রচ্ছদ ইত্যাদি আঁকা-জোকা করতেন আর কিছু টাকা পাবেন এই আশায় থাকতেন। তাই দিয়ে আমাদের নতুন জামা কেনা হবে। কিন্তু অনেক বছরই মহান প্রকাশকদের বদান্যতার অভাবে পুজোয় আমাদের জন্য জামাকাপড় কেনা হয়ে উঠতো না। আমরা ছোট ছিলাম, খুব চটে যেতাম বাবার ওপর। রুবির বাবা বেল-বটম দিয়েছে, কাজলের চারটে চার রকমের ফ্রক,রীতার সিল্কের এলিফ্যান্ট হাতা মিডি–কত্ত জমকালো!!আর আমরা ? তবে হ্যাঁ যে বছর বাবার ভাগ্য খুলতো সে বছর আমাদেরও পোয়া বারো। বাড়ির সামনে থেকে সোজা ট্যাক্সি চেপে এসপ্ল্যানেড। সেখানে টাইগারে বর্ন-ফ্রি সিনেমা দেখে সাব্বির এ রেজালা-তন্দুররুটি খেয়ে নিউ মার্কেটে জামাকাপড় কিনে তবে বাবার ছুটি। আমাদের আনন্দ আর ধরতো না।
রুবি,কাজল,সীমা,রীতা ওরা অনেক জামা কিনেছে কিন্তু কেউ বর্ন-ফ্রি দেখেনি। এই ভেবে একটু একটু ডাঁট করতেও শিখেছি তখন। একটা সিনেমা,একটা জামা,একদিন ট্যাক্সি চড়া আর রেজালার মধ্যে এক ডুব গহীন আনন্দ লুকিয়ে থাকতো!!! কী যে ভালো লাগতো বাবাকে, মাকে আার দুর্গা ঠাকুরকে!! দিদাকে আমার বাড়ির দুর্গা ঠাকুর মনে হোতো।
দিদার জন্যও শাড়ি আসতো একটা। দিদা সেটা মুখের কাছে তুলে নিয়ে যেন আদর করতে করতে বলতো “আমার জন্য আবার নিলে কেন, সুবোধ।” বাবাকে এর উত্তরে কিছু বলতে শুনিনি শুধু হাল্কা একটা হাসি দেখতে পেতাম চোখে। দিদাও খুব খুশি বুঝতাম। আমাদের আব্দারে আবার দুলে দুলে কবিতা বলতে শুরু করতো “ছেঁড়া ধুতি আপনার ঢের বেশি দাম তার ভিক্ষা-করা সার্টিনের চেয়ে।” আ পো না র উচ্চারণটা এখনও হৃদয়ে পেন্ডুলাম হয়ে রয়েছে।
এইসব শব্দ, ছবিগুলো খুঁজে খুঁজে বেরিয়ে আসে মনের কোণা থেকে। কিন্তু সেই স্বাদ-গন্ধটা হারিয়ে গেল কীকরে বুঝিনা। আশায় আছি,অতিমারি কেটে গেলে স্বাদ আর গন্ধ হয়তোবা ফিরবে। কিন্তু ফিরবে কী আমাদের সেই ছোটবেলা !!!
গন্ধ তো আছে দিদি। মায়াবী গন্ধ— এ গন্ধের ভাগ হবে না। যে গন্ধে শুধু ডুবে যেতেই হয়— ছোটবেলা ফিরবে না বলা ভুল, ফিরলো তো- আপনার লেখার গন্ধে সুরে কথার বাঁধনে—মায়ায়—এক অদ্ভুত মন ছুঁয়ে যাওয়া ছবি হয়ে রইল আমার মনে।
ভালোবাসা।
আমারও ছোটবেলায় ফিরে পেলাম তোমার লেখায় আর মনে পড়ে গেলো বাবার অফিস ছুটির দিনে ধর্মতলা হকার্স কর্নারে গিয়ে নিজেদের সঙ্গে মামাতো পিসতুতো ভাইবোনদের জামা কেনা ☺️ আর স্যুটকেস গুছিয়ে প্রতি বছর পাটনা রওনা দেওয়া।ঐ পুজো পুজো গন্ধটা আমার আটকে আছে তখনকার বাঙালী-পাটনায় ♥️ সীনেমাটা অবশ্য বাবার অফিস ফেরৎ নাইট শো হতো-বেনহার,কুয়্যোভেদিস,টেন কম্যান্ডমেন্টস,গুপী গাইন বাঘা বাইন।আসলে ভাড়া থাকতাম যে ধর্মতলায় 😁
খুব ভালো লাগলো লেখাটা!!
আপনারা পড়ছেন। তাই অনেক ধন্যবাদ।
নাই বা ফিরল ছোটবেলা, আমাদের ছোটবেলা, মনের মধ্যে সে রয়ে গেছে। থাকবেও আজীবন। নাহলে এমন লেখা যায় নাকি।
সেই। ছোটবেলা কেউই ভোলে না।💗
হ্যাঁ গো,দিদি, আমরা প্রত্যেকেই আমাদের ছোট্ট বেলার ভেলায় ভেসে বেড়াই,সেই ডিঙিনৌকা করে উজান বেয়ে বড়ো বেলার ডাঙায় উঠে জীবনটা স্বাদগন্ধ হীন হতে হতে ও হয় না গো, কারণ তোমার মতো সচেতন শিল্পী মনের মানুষ আমাদের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা খুঁজে বেড়ানোর, কাজে মাতিয়ে তোলে যে,খুব মন ছুয়ে গেল গো,এই মহামারী এবার বিদায় নিল বলে, শক্তি ক্রমশ হারাচ্ছে যে,আর ভয় নেই,,,,
খুব ভালো লাগল। গন্ধ পেলাম শৈশবের, ছুঁয়ে গেলাম প্রিয়জনদের। তোমার শব্দেরা যেন মনের কথা বলে গেল আমারও।
ভালোবাসা। অনেক।
সুন্দর লেখাটি…. স্মৃতিমেদুর করে তোলে….।
ছোটবেলায় মনে করালে সুরন্জনা।আমার ছোটবেলার জামা কেনা বাবার ছুটির ধর্মতলা হকার্স কর্নার আর স্যুটকেস গুছিয়ে পাটনা যাওয়া।পুজো পুজো গন্ধটা আটকে আছে ঐ বাঙালী-পাটনায়।তবে সীনেমা দেখাটা ছিলো বাবার অফিস ফেরৎ নাইট শো।পুজোর কেনাকাটার খাওয়াটা তোমার মতোই মাটন রেজ়ালা তন্দুরী রুটি আমিনিয়াতে 😁
চোখ দুটো জলে ছলছল করে উঠলো। এসব হয়তো ঘটেছে আমার জন্মাবার আগে,বা হয়তো এতো ছোট ছিলাম যে স্মরনে নেই। তবে দিদার ছবি স্পষ্ট। দারুন লাগলো দিদি 💖 ভালো থাকিস, সুস্থ থাকিস।
সব আবার ফিরবে…. আকাশের গন্ধ, দিদার গায়ের গন্ধ, রেজালার গন্ধ, নতুন জামার গন্ধ, সব সব ফিরবেই ,আমরা আশাবাদী…
খুব ভালো লাগল। গন্ধ পেলাম শৈশবের, ছুঁয়ে গেলাম প্রিয়জনদের। তোমার শব্দেরা যেন মনের কথা বলে গেল আমারও।
পুজোর গন্ধ পেলাম তো।আপনার এই সহজ,সরল অকপট চারণে।খুব ভালো লাগলো।