নিভৃত পূর্ণিমা নাট্যগ্রাম, বোলপুর। ডানদিক দিয়ে একটি পায়ে হাঁটা রাস্তা। দুদিকে লতাগুল্মের সারি, মাঝে সাদা-লাল টাকের মত আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। চাঁদ জোছনায় রাস্তা দেখা যায়! ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা দু’জন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা! মাথার উপর শনশন মেঘমালা। একটা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সময়কে হাতড়ে খুঁজছিল ও। আমি খুঁজছিলাম একটা চরিত্র, কথা বলার ভঙ্গি, সুন্দরবনের নদী নালা পেরিয়ে একটি তেজি তরুণ , কতটা প্রাণ থাকলে এভাবে ‘রাজা’র মত বাঁচতে পারে! সম্ভব! নদী পথ, জোয়ার-ভাঁটা , মেঠো কাদা রাস্তা, পা-ভ্যান পেরিয়ে ক্যানিংয়ে আসতে কত জনের অর্ধেক জীবন কেটে যায়!
খুরশিদ আলম ঘরামী, সোনারপুর স্টেশনের কাছে একটা ভাড়া ঘরে থাকত, একটা অফিস চালাত তখন। চাকরি দেওয়ার অফিস। সেক্টর ফাইভের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে হিউম্যান রিসোর্স অফিসারদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করত একেবারে মেঠো কায়দায়। নিজস্ব ঢঙে! অফিসে ভ্যাকানসি হলে সেখানে চাকরি প্রার্থীদের পাঠাত সে। এভাবেই গ্রামগঞ্জ থেকে আসা যুবকদের একা আশ্রয় হয়ে উঠেছিল একদিন! রাজা সে তখন থেকেই! এই চাকরির বিনিময়ে অল্প টাকা সেও নিত। কিন্তু চাকরি গুলো ভুয়ো ছিলনা। রাজা সেই নিভৃত অবকাশে বলেছিল। গ্রামের ছেলে আমিও, তাই বুঝি ঠিক কোথায় আমরা পিছিয়ে পড়ি। আসলে,আমাদের ছেলেরা কথা বলতেই ভয় পায় গো। আমি ওদের হয়ে কথা বলে দিতাম, যাতে ওরা চাকরিতে না আটকায়” ছেলেবেলা একটা রাজদূত বুলেট আসতো প্রতি সপ্তাহে, নিজেদের উঠোনে। এ ছিল নিয়মিত ভিজিটিং। একজন ডাক্তার রোজ আসতেন বাড়িতে। ছোট্ট ছেলেটি গতিহীন বুলেটে বসে ঝড় তুলতে চাইত। মুখে আওয়াজ হত। ভোঁ…. পিপ পিপ। মাঝ বয়সী বাবা তখন শয্যাশায়ী। রাজনীতি করতেন। সুন্দরবনের বাসন্তী থানা এলাকার জননেতা মৌলুদ ঘরামী একদিন রাতে বাড়ি ফিরছিলেন। আততায়ীরা পিছন থেকে আক্রমন করে। একসময় মাঝবয়সী মানুষটিকে মৃত ভেবে ফেলে চলে যায় তারা। পরদিন গ্রামবাসীরা উদ্ধার করে তাঁকে। প্রাণ ছিল তখনও। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসেন মাঝবয়সী জননেতা।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর হাড়গোড় জোড়া লাগাতে আসতেন সুন্দরবনের কাঁঠালবেড়ের বিখ্যাত হাড়ভাঙার ডাক্তার। এলাকায় প্রচলিত কিংবদন্তি, স্বপ্নেদেখা ওষুধ দিয়ে তিনি জোড়া লাগান ভাঙ্গা হাড়, হাত-পা-পাঁজড়। ছোট্ট রাজা, ওই ডাক্তারের স্ট্যান্ড তোলা গতিহীন বুলেটে বসে প্রথম গতির স্বাদ নিয়ে ফেলেছিল।
তারপর, মোটরবাইক তার সঙ্গী হয়ে গেল, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। পরবর্তীকালে চাকরি সূত্রে সুন্দরবনের ন্যাজাট, কলিনগরে থাকা, অন্যদিকে চুনোখালিতে পুরোনো বাড়ি। সোনারপুর, মিশনপল্লী এলাকায় ছোট্ট মেয়েটার পড়াশোনার সুবিধার্তে ঘরভাড়া করে থাকা আর বিভিন্ন দলে থিয়েটারের কাজ। সে, সোনারপুর হোক বনগাঁ হোক, মধ্যমগ্রাম, হাতিবাগান হোক বা অন্যকোথাও, এই পুরো যাত্রাপথেই ছিল একটাই সঙ্গী, মোটরবাইক।
সোনারপুর থানার বাইরে, একটি ছোট ম্যাটাডোরে বা ছোটাহাতিতে কালো পলিথিনের মধ্যে শুয়ে ছিল রাজা। বটগাছের পিছনটায় দাঁড়িয়ে ছিল মোটরবাইকটি। একটাও আঁচড় লাগেনি শেষসঙ্গীর গায়ে। শুধু আঘাতটা নিজে সয়েছে রাজা।
আচ্ছা, কেমন ছিল সেই শেষ মুহূর্তটা। সোনারপুর রাস্তা তখন এমনিতে খুব একটা ভিড় থাকেনা। মোড়ের ব্যস্ততা কামরাবাদ পেরিয়ে ওখানে একটু কম। রাত তখন দশটা পাঁচ হবে! সামনে দিয়ে ধাবমান মালবাহী লরী। রাজা নিশ্চই বাঁচতে চেয়েছিল! ওই বাঁচা টুকুর মাঝে কি ছায়াছবির মত ভেসে উঠেছিল অসমাপ্ত অমঞ্চস্থ নাটকের স্ক্রিপ্ট গুলো, আলোকিত রিহার্সাল রুম, অপেক্ষমান চেনা মুখের সারি! মনে পড়েছিল ছোট মেয়েটার কথা, মনে পড়েছিল লাভলিকে! ওই টুকু সময়ের মাঝে এত কিছু কি ভাবা সম্ভব?
লাভলি আমাদের এলাকার মেয়ে। শ্বশুরমশাই সামান্য ব্যবসা করে জীবন চালান। একটি শ্যালক নাম, মুস্তাক। মুম্বাইতে থাকে। সেখানে রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনে ফুটবল খেলে সে। রাজা বলেছিল ওকে ভবিষ্যতের বাইচুং ভুটিয়া বলছে ভারতের মিডিয়া। আমার ক্রীড়া সাংবাদিক সত্ত্বার মুখোমুখি হয়ে একদিন অনেক উৎসাহে নিজের ফুটবল প্রেমের কথা শুনিয়েছিল রাজা। অনেক প্রেমের মাঝে আসল প্রেম ছিল মঞ্চ। আমি বলবনা শুধু থিয়েটার। ও আসলে যাত্রাশিল্প থেকে নিজেকে পরিশীলিত করে তোলা একজন অভিনেতা। দাদা খুব নামী শিল্পী। রাজাও কম কিছু ছিলনা। এরকম একটি যাত্রার আসরে পালা শেষে উপস্থিত দর্শকবৃন্দ ভক্তবৃন্দে পরিণত হয়েছিল, একবার। সেই মাঠে প্রতিবারই যাত্রা নিয়ে যেতেই হত রাজাকে, ভক্তবৃন্দের টানে! প্রথমবার ওই মাঠে যাত্রাপালার শেষে, রাজা সেফটিপিন দিয়ে ঝোলানো অনেক টাকা পেয়েছিল জামায়। দশটাকা, কুড়ি টাকা, পঞ্চাশ টাকা করে পরিমাণ দাড়িয়েছিল প্রায় ছয়শো টাকা!
তবে থিয়েটারে আসার পুরোটাই কালিনগরের দীপক নায়েকদার কৃতিত্ব। আসলে রাজার মধ্যে একটি অভিনেতা , সংগঠক অর্থাৎ একজন অদ্যান্ত থিয়েটারকর্মী লুকিয়েই ছিল। সেটা আবিষ্কৃত হয়েছিল চাকরিসূত্রে ন্যাজাট, কালিনগর যাওয়ার পর। কালিনগর, ঐকতান ছিল ওর মাদার গ্রুপ। তবে আমি আর কল্যাণীর অয়ন জোয়ারদারদা, গভীর রাতের আড্ডায় বলে ছিলাম, রাজা হল মফস্বলের দেবুদা ( দেবশঙ্কর হালদার) | রাজা আসলে ছিল সব দলের উর্ধ্বে অথবা এইসব দলাদলীর বিরুদ্ধে, একটা বৃহৎ নাট্যসমাজের ছেলে। জনপ্রিয় ফেসবুক গ্রুপ, যা নাটকের প্রচারে ব্যবহৃত হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। পূর্বতন থিয়েটার ক্যাফে থেকে থিয়েটার ফোরামে উত্তীর্ণ হওয়ার পর মূল দায়ভার সামলাতে দেখেছি আমাদের রাজাকে। প্রতিটা কাজ কতনা নিষ্ঠা সহকারে করত ও!
আমার সঙ্গে আলাপ হয় ওর জন সংস্কৃতির আবাসে। আলাপটি খুব দ্রুতই দৃঢ়তা পায়। অনেক অনেক রাত জাগা স্বপ্ন আমিও ভাগ করেছি ওর সঙ্গে। আমাদের বাংলা প্রসেনিয়ামের ‘বিরহী বন্দুক ‘- এ, নিবিড় কাজ ওকে করতে দেখেছি। যে কোনো চ্যালেঞ্জ কাঁধে নিয়ে সেটা উতরে যাওয়াটা ছিল ওর কাছে জলভাত! রাজার চলে যাওয়ার খবরে, ব্যথিত গোটা দল। চিত্রা বিশ্বাসই করতে পারছিলনা রাজার চলে যাওয়া। এটা আসলে মেনেই নিতে পরেছিলাম না আমরা কেউই। দিব্যেন্দু আমাকে ফোন করে টানা পনেরো মিনিট কেঁদেছে। কেউ কোন কথা বলতে পারিনি। সুমি, নাটকের একটি মুহূর্ত যেখানে আমি ও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ছবি দিয়ে লিখেছিল, ছবি গুলোর দিকে তাকাতে পারছিনা। সুমন বলছিল যে রাস্তায় রাজার তাজা রক্ত পড়েছিল, সেই রাস্তা দিয়ে রাত তিনটের সময় বাইক নিয়েই ফিরেছে ও। চারিদিকে নিস্তব্ধ ছিল। কিছু চিহ্ন নেই। রাজা হারানোর যন্ত্রণা নেই। সুমন কিন্তু বাইক চালিয়েই বাড়ি ফিরেছিল রাজা!
রাজারা এমনই হয় । নিভৃতে আসা অনন্ত রাত্রে মিশে যাওয়া। মাঝের সময়টুকু শুধু হৃদয়ের সাম্রাজ্যে রাজত্ব করে যাওয়া, অনেক নাট্যকর্মীর মত ওর ভিতরেও একটি ধারণা ছিল, থিয়েটারে সমাজ বদল সম্ভব। রাজনৈতিক পালা বদলে বারবার থিয়েটার নেতৃত্ব দেবে!
আমাকে বলেছিল ‘এমন এক নাটক লেখ, যাতে সমাজের বদল ঘটে যেতে পারে!’ আমি ভেবেছিলাম, তেমন নাটক কি সত্যি লেখা যায়! কেউ পারলে পারবে আমার পক্ষে, কোনোদিনই তা লেখা সম্ভব নয়। কারণ আমি রাজার মত অতটা সৎ ভাবে থিয়েটার করিনি এমনকি ভাবিও কোনোদিন।