ক্যানডিড থিয়েটারের রতনপুর | অভি চক্রবর্তী

রতনপুর কি অশোকনগর? নাকি অশোকনগরই রতনপুর? লেখকই কি নীলু? যেকোনো লেখাই কি তবে লেখকের আত্মজীবনী বা আত্মজীবনের প্রসারণ? নাকি ফ্লবের যেমন বলেছিলেন যে ঔপন্যাসিক তার সৃষ্টির পিছনে লুকাতে চান? তেমন লেখকও নানান ছদ্মবেশে তার সৃষ্ট চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ করেন। কথা বলেন তার লেখালিখির সঙ্গে। তর্ক চালান। ক্রোধে ফেটে পড়েন। প্রেমে গলে যান। সত্যিই এ এক অপার রহস্য।

বাসুদেব দাশগুপ্ত রচিত রতনপুরের মতো এই তীব্র ছোট গল্পেও লেখকের উপস্থিতি মারাত্মকভাবে লক্ষণীয়। আমরা যারা লেখকের সহনাগরিক, বড় হতে হতে এই শহরের রাস্তাঘাটে, ক্লান্ত মধ্যাহ্নে, বসন্তের বিকেলে তাঁর সম্পর্কে নানান মিথ ও মিথ্যের সংশ্লেষ শুনতে শুনতে বড় হয়েছি তারা জানি বা বুঝি রতনপুর আসলে লেখকের মনোজগৎ হয়তো বা তাঁর বাসভূমিও বটে। তিনি কি আকস্মিক স্মৃতির মরচে ধরা ট্র্যাঙ্ক খুঁজে পান কফি হাউসে রতনপুরের উৎসবে? শহরের কফি হাউস ভাড়া করে এক গ্রাম উৎসব হচ্ছে সত্যিই অভাবনীয়। প্রায় সাত দশক আগে বাসুদেব যে অসমবয়সী প্রেম রতনপুর গল্পে দেখিয়েছেন, তা আজকের গল্পকাররাও লিখতে পারলে নিজেদেরকে সাহসী মনে করবেন। ক্রমাগত থ্রিলার আর মধ্যবিত্তের ন্যাকা ন্যাকা বৈবাহিক সম্পর্ক বা তার বাইরে দলীয় রাজনীতির যে ক্যাকিফোনির করাল স্রোত বাংলা সাহিত্যে বহমান, প্রাচীন এই গল্পের নাট্যরূপ আমাদের মিনিট পঁচিশেক মুক্তি দিল তার থেকে। নীলু তার বদলে যাওয়া রতনপুরে ঢুকে অবাক হয়ে যায়। ফিরে ফিরে পায় নানান স্মৃতির কোটর। এক কোটর থেকে আরেক কোটরে যায় নীলু। বাঁধা পায়। হাল ছাড়েনা। নিটোল গল্পের রিনিঝিনি রতনপুরে নেই বরং সেই তারকাভস্কির নস্টালজিয়া ছবির মতো এ কাহিনী নীলুর সঙ্গে আমাদেরকেও আক্রান্ত করে। বিহ্বল করে।

শেষে নীলুর ছোট হয়ে যাওয়া, রতনপুরে সে এখন বহিরাগত। তাই তাকে লুকাতে হবে। আসলে পুরুষ মাত্রই এ সংসারে সে বহিরাগত। সে জোগানদার। তাই নীলুকে ছোট হয়ে যেতে হয়। আমাদের সব্বাইকে এ সংসারে ছোট হয়ে যেতে হয়। এই ঘটনাপ্রবাহকে যে মিনিমাম এলিমেন্ট দিয়ে সুদীপ্ত দ্যাখালেন তা সত্যিই অনবদ্য। দমবন্ধ লাগে আমাদের। সঙ্গে একটা আনক্যানি মিউজ্যিক গোটা নাট্যে আমাদের অস্থির করে রাখে। পিষে মারে। বুকের ভিতর পুরনো বাতাসের তোলপাড় করা শব্দ শোনা যায়। এতো পরিমিত অভিনয়, পরিমিত আলো ও শব্দের মিশ্রণ এবং তার সুনিপুন প্রয়োগ অন্তরঙ্গ নাট্যের আঙিনায় ক্যানডিড থিয়েটারকে সসস্ত্র এবং ব্যতিক্রমী করে তোলে। আমার ব্যক্তিগত মত ক্রমাগত সাহিত্য নিয়ে মহালকক্ষে নিরন্তর ভাঙচুর এবং সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক হিসেবে সুদীপ্ত অন্তরঙ্গ নাট্যের গহীনে প্রবেশের সদরের চৌকাঠে এসে উপস্থিত হয়েছেন।

শ্লাঘার বিষয় এই যে এতো আন্তরিক এবং বলিষ্ঠ প্রয়োগে তিনি বাসুদেব দাশগুপ্তকে মঞ্চে এনেছেন। সত্যিই আমরা কখনোই এ সাহস পাইনি। কারণ স্থানীয় অঞ্চলে বিখ্যাত লেখকের এক সর্বজ্ঞ মৌলবাদী গোষ্ঠী থাকে। সেই গোষ্ঠীর বিদ্রুপের খরশান সয়েছি ছেলেবেলা থেকেই, সেইসব বিদ্রুপ পেরিয়ে বাসুদেববাবুর আখরায় পৌঁছনো হয়নি কখনো। সুদীপ্ত পারলেন। তার এই পারাকে মিছিল করে স্যালুট জানাই। চারিদিকে প্রচুর নীরিক্ষামূলক স্পেস গজিয়ে উঠেছে সেখানে এইসব নাট্যের বেশি বেশি অভিনয় প্রয়োজনীয়।