স্মরণে বিজয় ভট্টাচার্য | সৌম্যেন্দু ঘোষ

বিজয় ভট্টাচার্য (জন্ম. ১২.১১.১৯৪৮ – মৃত্যু. ২৬.১২.২০২১)

বিজয় ভট্টাচার্য এর পিতার নাম শ্রীনিবাস ভট্টাচার্য। বিদ্যালয়-এর পড়ার পর তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা বি.কম। সারাজীবন বেশ ভালোভাবেই চাকরি করেছেন, কিন্তু তাঁর বৈশিষ্ট্য চাকরি করতে করতেই সংস্কৃতির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ২৯-২০ বছর বয়স থেকেই হুগলি জেলার কোন্নগরের নবগ্রাম সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘মহাদেশ পরিষদ’-এর আনুকূল্যে তাঁর নাট্যজীবন শুরু হয়। ১৯৬৮ থেকেই এখানে ‘রাইফেল’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘হাঁড়ি ফাটিবে’, ‘অগ্নিগর্ভ লেনা’ প্রভৃতি নাটকে অভিনয় শুরু, আবার এখানেই ‘বিসর্জন’, ‘নটী বিনোদিনী’, ‘নৌকাডুবি’, ‘রাহুমুক্ত’ নাটকেও অভিনয় করেছেন। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইউনিট থিয়েটার-এ যোগ দেন। বসবাসের জায়গা থেকে একটু দূরে ভদ্রকালীতে। এঁদের নিজস্ব নাট্যকার ছিলেন অরুণ চক্রবর্তী এবং অসীম ভট্টাচার্য, নির্দেশক ছিলেন আশিস চট্টোপাধ্যায়। ১৯৭০ থেকে ৭৫ এখানেই তাঁর অভিনয় কাল। কী সব নাটক! ‘দামস্ট্রং মূল্যফোস্কার চন্দ্রাভিযান’, ‘লাশবিপণি প্রোঃ ইন্দুমুদি’, ‘গণতন্ত্র ও গোপাল কাহার’, ‘বোকাবুড়োর কান্ড’, ‘কেউ কেউ আজ‌ও জেগে আছে’ প্রভৃতি নাটকগুলি সারা বাংলায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল।

তখন মফস্বলের নাট্যদল আকাডেমি অফ ফাইন আর্টস ভাড়া নিয়ে খুব একটা নাটক করত না। এঁরা কিন্তু দুটি একাংক নিয়ে নাট্যজগতের খবরের শিরোনামে উঠে আসতে পেরেছিলেন। একদিনে দুটি একাংক মঞ্চস্থ করতেন। ৭৫ থেকে ৮০ সোশ্যাল স্কোয়াড নামে একটি সামাজিক সংগঠনের নাট্যবিভাগ কিংশুক-এ যোগদান করেন। চাকরির জায়গা আকাডেমি মঞ্চের কাছেই, মঞ্চস্থ নাটক কলকাতার কাগজে সমালোচিত হতেই ‘অভিনয়’ পত্রিকার সঙ্গে যোগ। মফস্বলের বিজয় তখন কলকাতাতেও বেশ পরিচিত। তখনও পর্যন্ত বিজয় কিন্তু অভিনেতা, দারুণ নাট্য সংগঠক। ১৯৮৪ তে নিজস্ব নাট্যদল গঠন করেন লাইফ থিয়েটার নামে। প্রথম নাটক রচনা ‘কমিউনিষ্ট পরিবার’। কোন্নগর, ভদ্রকালী থেকে কলকাতা ছুঁয়ে বিজয় তখন পশ্চিমবাংলার গ্রামে গ্রামে গঞ্জে গঞ্জে একাংক নাট্য প্রতিযোগিতার আসরে মাতিয়ে চলেছে। অভিনেতা নাট্যকার হলেন, নির্দেশক হলেন, সংগঠনের হালহকিকত তো জানতেন‌ই এবারে সমস্ত বিভাগগুলিতে নিজেকে মেলে ধরলেন। নিজের দলের প্রয়োজনে নাটক লিখতে বাধ্য হলেন, অন্য দলকেও নাটক দিতে থাকলেন।

ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ইতিহাস নিয়ে তাঁর ট্রিলজি ‘শহিদ’, ‘ইস্তেহার’, ‘সকাল সন্ধ্যা’। তাঁর বহুবহু নাটক রচনার মধ্যে মাত্র কয়েকটি হলো, ‘ছায়াবৃতা’, ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘নিলাম’, ‘টানাপোড়েন’, ‘অগোছালো’, ‘কালের মন্দিরা’, ‘জাতকের জন্য’, ‘মধ্যাহ্নের সূর্যোদয়’, ‘এ পরবাসে’, ‘মাঝি’, ‘দ্বিধা’, ‘প্রতিপক্ষ’, ‘ঝণ’, ‘দধাচি’, ‘কাঠগড়ায় ইতিহাস’, ‘কমরেড’, ‘চেনামুখ অচেনা গল্প’, ‘গোয়ের্ণিকা’, ‘কবাডি কবাডি’, ‘পাকদন্ডী, ‘আকরিক’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘ব্লাস্ট’, ‘লক্ষ্যভেদ’, ‘সমাপতন’, ‘মানুষের জন্য’, ‘শেষ যুদ্ধ আজ’, ‘পরদা’, ‘পার্বতী উপাখ্যান’, ‘ছায়াযুদ্ধ’, ‘মিথ্যে কাঁচের আরশি’, ‘ধ্বংসস্তূপে আগুন’, ‘ভৌগোলিক, ‘উপছায়া’, ‘সংরক্ষণ’, ‘রজত জয়ন্তী’, ‘সিঁড়িভাঙা অঙ্ক’, ‘আত্মজ’, ‘এদোষ কাল’। এরপরেও আরও অনেক নাটকের নাম লেখা হলো না।

‘গণনাট্য’, ‘গ্রুপ থিয়েটার’, ‘অসময়ের নাট্যভাবনা’ মূলত এই তিনটি নাট্যপত্রিকায় নিয়মিত নাটক প্রকাশ হতে থাকল। সুদূর মফস্বল হলেও নাটক নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের সঙ্গে নৃপেন্দ্র সাহার সংযোগ থাকবে না এটা সেই সময়ে ভাবাই যেত না। ‘বহিরঙ্গন’ বলে স্বল্পদিনের জন্যে আলোড়ন ফেলে দেওয়া একটি নাট্যপত্রিকায় বিজয়কে সাথী করে নৃপেন্দ্র সাহা অনেকটা এগিয়ে গেলেন। পত্রিকাটি দ্বিভাষিক ছিল, ইংরেজি এবং বাংলা। খবর সংগ্রহ থেকে ডিটিপি করানোর জন্যে সারারাত ধরে কাজে বিজয় ছিল অত্যন্ত দক্ষ। পশ্চিমবঙ্গ নাট্যমেলায় প্রতিদিন বুলেটিন প্রকাশের কাজে রাত্রিযাপনে তাঁর জুড়ি মেলা ছিল ভার। নাট্যমেলায় দশদিন ধরে, একটি প্রেক্ষাগৃহের যাবতীয় কাজও সাবলীল ভাবে করে যেতেন।

যখন নিজস্ব দলও আর ভালোভাবে কাজ করতে পারছিল না, তখন পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি আয়োজিত যাত্রা উৎসবের ‘জুরি’ হয়েছিলেন। ব্রাত্য বসু নির্দেশিত ‘কন্যাদান’ নাটকে একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয়ও করতে দেখেছি। উপলব্ধি করেছি নেপথ্য নাট্য নিয়ন্ত্রণে নিশ্চিয়‌ই তাঁর কোনও গুরুদায়িত্ব ছিল। একাংক নাট্য প্রতিযোগিতার আসরে আসরে তিনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। কখনও অভিনয়ের জন্যে, কখনও নির্দেশনার জন্যে, কখনও নাট্যকার হিসেবে। অভিনয় পত্রিকা পুরস্কৃত করেছিল ১৯৭৮ সালে। ১৯৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ তার সুবর্ণ জয়ন্তীতে তাঁকে পুরস্কৃত করেছিল। বাংলা থিয়েটার বিশেষ করে গ্রামবাংলার থিয়েটার খুব সহজে তাঁকে ভুলে যেতে পারবে না।

One thought on “স্মরণে বিজয় ভট্টাচার্য | সৌম্যেন্দু ঘোষ

  1. অনবদ্য লেখা। বহু স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেল।

Comments are closed.