থিয়েটার মানুষ গড়ে তাই সাগ্নিক থিয়েটার করে | বিজয়কুমার দাস | পর্ব – ৪১

থিয়েটার একটি ঝুঁকির জীবন। এটা জেনেও যারা থিয়েটারেই দেহ মন সমর্পণ করে বেঁচে থাকতে চায়, সাগ্নিক কোলে তাদের মধ্যে একজন। কলকাতাতেই বেড়ে ওঠা সাগ্নিকের। আর থিয়েটারের পর্বটা শুরু নান্দীকারের মত নাট্যদলে। ছোট থেকেই নাটক দেখার অভ্যাস সাগ্নিকের। সুখের কথা এই যে, বাড়ির কেউ এই অভ্যাসকে কু-অভ্যাস মনে করেনি। বরং মা বাবার প্রশ্রয় পেয়েছে নাটক দেখার জন্য। মায়ের কোলে চেপে তার নাটক দেখা শুরু। দাদু ( নিমাই চন্দ্র মান্না) যুক্ত ছিলেন নাটক ও যাত্রা জগতের সঙ্গে । ছোটবেলা কেটেছে মামার বাড়িতে। দাদুর মুখে যাত্রা -নাটকের সেইসব গল্প শুনতে শুনতে হয়তো থিয়েটারের পোকা ঢুকে পড়েছিল সাগ্নিকের মগজে। সাগ্নিক অনুভব করেছে, থিয়েটারের পোকা একবার মগজে ঢুকে পড়লে আর সেখান থেকে বের করা যায় না। মানে থিয়েটারের পোকা যার মগজে ঢোকে তাকে থিয়েটারের মঞ্চে টেনে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। তাই ছোটবেলায় থিয়েটার দেখার নেশায় মশগুল সাগ্নিক ২০০৫ সালে নান্দীকারে যুক্ত হয়। সেখানে ১১ বছর ধরে তার থিয়েটারের পাঠ গ্রহণ। ২০১৬ সালে নান্দীকারের থিয়েটার অনুশীলনে সমৃদ্ধ সাগ্নিক যুক্ত হয় ইচ্ছেমতো, নটধা, কার্টেন কল এর মত নাট্যদলের কর্মশালায়। অন্যদিকে নান্দীকারে থাকতে থাকতেই থিয়েটার প্যাশন দলে ২০০৮ সাল থেকেই অভিনয় করা শুরু করেছিল।

এক সময় সাগ্নিক অনুভব করে, থিয়েটারই তার প্রকৃত ক্ষেত্র। যে ছেলে নান্দীকারে থিয়েটারের পাঠ নিতে ঢুকে ১১ বছর সেখানে কাটাল, সে কি তবে লেখাপড়া করেনি?… এ প্রশ্ন করতেই সাগ্নিকের কাছে জানা গেল, রীতিমত সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং উত্তীর্ণ মেধাবী ছাত্র সে। রামমোহন মিশন হাই স্কুলে আই সি এস ই (I C S E) মডার্ণ একাডেমিতে আই এস সি (I S C)। তারপর হেরিটেজ ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং এ স্নাতক। এ হেন মেধাবী ছাত্র নিজেকে সমর্পণ করে দিল থিয়েটারে?… বাড়ির কেউ কিছু বলল না?… না, বলেনি। বরং সাগ্নিকের থিয়েটার প্রীতি প্রশ্রয় পেয়ে গেল পরিবারের মানুষজনের কাছে। আসলে ইঞ্জিনীয়ারিং পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি থিয়েটার নিয়ে নানা বই পড়ার অভ্যাস ছিল তার। মা কাকলী কোলে, বাবা সনাতন কোলে, কাকু শুভাশিস চক্রবর্তী তাকে সবসময় উৎসাহিত করেছেন তার থিয়েটার প্রেমকে।

২০০৬ সালে নান্দীকারের “ভালোবাসা ভালোভাষা” নাটকে প্রথম মঞ্চে নেমে অভিনয় করেছিল সাগ্নিক। গিরিশ মঞ্চে মঞ্চস্থ হওয়া সেই নাটকের নির্দেশক ছিলেন বাংলা থিয়েটারের বিস্ময়কর অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। এরপর কি থিয়েটারের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে আসা যায়?… চলে আসতে পারেনি সাগ্নিক। থেকে গেছে থিয়েটারে। জড়িয়ে পড়েছে মঞ্চমায়ায়।

থিয়েটার করতে এসে সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য হয়েছে রমাপ্রসাদ বণিক, দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদার, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, দেবব্রত মাইতি, কমল চট্টোপাধ্যায়, ঝুলন সরকার, তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, ড: ইন্দুদীপা সিনহা প্রমুখ বিশিষ্ট নাট্যজনের। একজন উৎসুক ছাত্রের মত আগ্রহ নিয়ে এঁদের কাছে অনেক শিখেছে থিয়েটারের খুঁটিনাটি। আর শিখতে শিখতে অনুভব করেছে, থিয়েটার মানুষ গড়ে। তাই সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং উত্তীর্ণ মেধাবী ছাত্রটি নাটকের নানা চরিত্র হয়ে মঞ্চে উদ্ভাসিত হয়েছে নব নব রূপে।

নিজের লব্ধ অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে ২০১৬ সালে “সন্তোষপুর মনন” নামে নিজের নাট্যদল তৈরি করেছে। সেখানে সে নির্দেশক হিসাবে যেমন থিয়েটারের প্রজন্ম গড়ে তুলছে তেমনই। ৫ দলের জন্য নাটক লেখা, নাটকের আবহ, আলো, মঞ্চসজ্জা নিয়েও নিজেকে যুক্ত রাখে। বলা যায়, একজন পরিপূর্ণ অভিনেতা ছাড়াও নাট্য নির্দেশক, সর্বোপরি একজন পরিপূর্ণ থিয়েটার কর্মী হিসাবে নিজেকেও গড়ে তুলছে সাগ্নিক। তাই আর থিয়েটার ছেড়ে যাওয়ার কথা সে ভাবে না। বুক চিতিয়ে থাকতে চায় থিয়েটারে।

করোনার বিপর্যয়ের কালে হয়তো মনে হয়েছিল, এ বড় ঝুঁকির জীবন – কিন্তু মাটি কামড়ে পড়েছিল থিয়েটারেই। তবে থিয়েটারের পাশাপাশি অভিনয় নির্ভর অন্যান্য মাধ্যমেও সে যুক্ত আছে। কিন্তু থিয়েটার থেকে উপার্জনটাই তার কাছে পরম সম্পদ। নিজের দল সন্তোষপুর মনন এ প্রতিনিয়ত সনক, অসিজিৎ, সৌভিক, পায়েল, অংশিকা, সুমন, নিলয়, মিঠাই, আকাশ, দেবপ্রিয়, শুভায়ন এর মত একদল নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের নিয়ে থিয়েটারের কাজে মগ্ন থাকা, সাগ্নিকের কবিতা লেখা, কবিতা বলা, ব্যায়ামের মত নিয়মিত অভ্যাস।

অভিনীত নাটকের সংখ্যাও কম নয় সাগ্নিকের। নানা দলে নানান নির্দেশকের অধীনে এবং অবশ্যই নিজের দলে অভিনীত ভালোবাসা ভালোভাষা, পিল পিল পিল, ইন্ডিয়ান আইডল, স্বপ্ন মুহূর্তে, যাই একটিবার, তাসের দেশ, Code Red, যারা জেগে থাকে, Cell Phone, পাগলা ঘোড়া, সিস্টেম – ২, আলোর কিনারে, দর্পণ সাক্ষী, Wrong – রিং, লজ্জা, রাত তখন বারোটা, ভূণীবাবুর চাঁদনী, প্রজন্ম, মাল্যদান, হয়তো নাটক নয়তো নয়, ভ্যাবলাই ভালো, মুনাফা ঠাকুরণ, ইতি – মৃতজন, অঙ্ক – স্যার গোলাপী বাবু ও টিপু প্রভৃতি নাটকে সাগ্নিক তার অভিনয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে। অভিনীত এইসব নাটকের চরিত্রগুলি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।

আগামীতে তার জন্য অপেক্ষা করছে আরো অনেক অজানা চরিত্র। এই মঞ্চ, এই সাজঘর, এত নাট্যজনের সান্নিধ্য, অভিনন্দন, করতালি আর বাড়ির মানুষজনের সীমাহীন প্রেরণা থেকেই সাগ্নিক অনুভব করেছে, যে থিয়েটারের পরিমণ্ডলে সে বেড়ে উঠেছে তার থেকে ভালই জায়গা, নিজেকে প্রকাশ করার হয়তো আর কেনো ক্ষেত্র নেই, তাই মঞ্চই তার জীবন

2 thoughts on “থিয়েটার মানুষ গড়ে তাই সাগ্নিক থিয়েটার করে | বিজয়কুমার দাস | পর্ব – ৪১

Comments are closed.