কমল সাহা
|| পথিক || ১
ই.বি.আর ম্যানশন ইনস্টিট্যুট (বর্তমানের নেতাজী মঞ্চ ) ১৬.১০.১৯৪৯ পথিকের প্রথম অভিনয়। প্রযোজনা: অশোক মজুমদার ও সম্প্রদায়। রচনা: তুলসী লাহিড়ী। বিদেশী নাটকের ভাব অনুসরণ। নির্দেশনা: শম্ভু মিত্র। মঞ্চ: অশোক মজুমদার; আলো: আশুতোষ বড়ুয়া ও তাপস সেন; স্থিরচিত্র: কালীশ মুখার্জী; আবহ: অমিয় ঘোষ ও অমূল্য সান্যাল; চিত্রাঙ্কণ: অমিতাভ দত্ত, গণেশ বসু, অরুণাভ দত্ত, অরণি ব্যানার্জি ও রবি মুখার্জি। অভিনয়ে: অমর গাঙ্গুলী, অরীন্দ্রজিৎ চ্যাটার্জী, অশোক মজুমদার, কলিম শরাফি, কালী সরকার, কুমার রায়, গঙ্গাপদ বসু, জহর রায়, তুলসী লাহিড়ী, তৃপ্তি মিত্র, দীপ্তি বাগচি, নির্মল চ্যাটার্জী, প্রবোধ মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, মহম্মদ ইসরাইল, মহম্মদ জ্যাকেরিয়া, শম্ভু মিত্র, শোভেন মজুমদার, সবিতাব্রত দত্ত, স্মৃতি ভাদুড়ী।
নবান্নর মতোই চট দিয়ে ঘেরা মঞ্চ, খড়ের চালের ছাউনি, কয়লাকুঠি অঞ্চলের পরিচিত দৃশ্য। দোকান ঘরের বেড়ায় লাগানো হলো চা কোম্পানীর পোস্টার। সস্তা সাবান বিড়ি সিগারেটের পাশে টাঙিয়ে দেয়া হলো ব্রুফবন্ড ও লিফটনের পাতা চায়ের মালা। বাংলা-বিহার সীমান্তে জি.টি. রোডের ধারে একটি চায়ের দোকান। সেখানেই সব চরিত্রের আসা যাওয়া। এক সেটের নাটক।
দূরে ভালুকসোঁধা কোলিয়ারিতে একটা দুর্ঘটনায় মারা গেলেন দুলাল বাউরী কুলি। ঘটনাটি আছড়ে পড়ল ছোট্ট দোকানঘরে। যে যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হলো মনুষ্যত্বের দামে। অসীম রায় নামে এক নাট্যকার … বড়ো বেমানান এই দোকান ঘরে… নাটকের উপাদান খুঁজে বেড়াচ্ছেন… সাধারণ মানুষের ভীড়ে মিশে যেতে চাইছেন অসীম রায় অথবা শম্ভু মিত্র। তৃপ্তিদির স্মৃতি : ‘এই চায়ের দোকানের মালিক যশপাল (তুলসীবাবু), আমি ওঁর ভাইপো সুদর্শনের বাঙালি স্ত্রীর মেয়ে সুমিত্রা, স্ত্রী মারা গেছে। আমি ওঁর কাজ-টাজ করে দিই। উনি এই নাতনিকে অসম্ভব ভালোবাসেন কিন্তু মাতাল ভাইপোকে একদম সহ্য করতে পারেন না। ইত্যাদি। এই দোকানে একদিন সন্ধ্যেবেলায় এক পথিক — অসীম আসে চা খেতে – নাটকের একদম শেষে আসে এক ডাকাত সিংড়া সিং – যে নাকি ছিল এই পথিকের Class mate এবং জীবনে frustrated হয়ে যে এই পথ বেছে নিয়েছে। মিংড়া সিং যশপালকে বলে ‘যা টাকা আছে সব বার করে দাও’। কৃপণ যশপাল বললে, ‘টাকা একদম নেই, টাকা কোথা থেকে পাবো!’ ইত্যাদি অনেক কথার পর ডাকাত তার সহযোগীকে বললে — ওকে খুঁটিতে খুব শক্ত করে বাঁধো। তাতেও যদি না বলে তাহলে ওর গায়ে কেরোসিন ঢেলে ওর গায়ে আগুন ধরিয়ে দাও। অসীম বাধা দিতে আসে। ডাকাত আর অসীমে তর্ক চলে। থিয়েটারের উপযুক্ত চমকপ্রদ সংলাপ, ন্যায় অন্যায় নিয়ে। এদিকে সহযোগী যশপালকে আষ্টে পিষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। কেরোসিন ঢালার মুহূর্তে তুলসীবাবুর আর আমার প্রায় একই সঙ্গে আর্তনাদ করে ওঠবার কথা। কিন্তু হঠাৎ ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, উনি নিবিষ্ট হয়ে শম্ভু মিত্র এবং সবিতাব্রত দত্তর অভিনয় দেখছেন। তারিফব্যঞ্জক ভঙ্গিতে সারা মুখ উদ্ভাসিত। ভাবটা — ‘ছোকরারা বেশ করছে তো!’ আমি তো হতবাক। কথা ছিল আমরা আর্তনাদ করলে — অসীম ছুটে আসবে। এবং বোধ হয় বাইরে থেকে পুলিশ ইত্যাদি আসবে। ওদের সংলাপ শেষ। আর্তনাদ কই? বাইরে থেকে ওরা আসে কী করে! সমস্তটা মনে পড়তে আমি তো ‘না না’ বলে চীৎকার করলুম। উনিও সম্বিত পেয়ে কোনও রকমে একটা ‘হায় রাম’ বললেন। যাই হোক সর্বরক্ষে হলো। পরে যখন এই নিয়ে আমরা হাসাহাসি করেছি তখন দেখেছি উনি খুব উপভোগ করছেন বসে বসে।’ …. (বিনোদন সংখ্যা দেশ ১৩৮০)
মহলা চলার সময় এই শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় ভরসা রাখতে পারছিলেন না তুলসীবাবু বারবার মনে হতো অর্বাচীন অ্যামেচারদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কী ভুলই না করেছেন ! অথচ প্রথম দিনেই নবীনদের অভিনয় মুদ্ধ হয়ে দেখলেন নিজের পার্ট ভুল করেও। আসলে পেশাদারী মঞ্চে অল্প কয়েকটা নাটকে অভিনয় করলেও খুব মন দিয়ে অনেক স্মরণীয় নাটক দেখেছেন শম্ভু মিত্র। প্রত্যেকটা ঘটনার বিশ্লেষণ করেছেন। বিশেষ করে শিশিরকুমারের প্রযোজনা ছিল তাঁর সব চেয়ে বড়ো শিক্ষা। এই নিয়ে বহুবার বহু নিবন্ধ লিখেছেন। নাটকের নির্দেশনা নাট্যমুহূর্ত গড়ে তোলা, সংলাপ বলার যাবতীয় কৌশল রপ্ত করেছিলেন পেশাদারী অভিনয় দেখে দেখে। শম্ভু মিত্রের পথিক তেমন স্মরণীয় প্রযোজনা নয় — তবুও এই নাটকে তাঁর নিষ্ঠা ও যত্নের অভাব ছিল না। দীর্ঘ এক বছর টানা রিহার্সাল চলেছে। নাটক চলাকালীন মনে হয়নি অনেকেই নতুন এবং এই প্রথম অভিনয় করছেন। সংঘবদ্ধ অভিনয়ের রীতি এই শুরু। কেউ কাউকে গ্রাস করছেন না — সবাই একটা নির্দিষ্ট ছন্দে নির্দেশিত সুরে সংলাপ বলে চলেছেন। সমৃদ্ধ হচ্ছেন তিনি।
স্মৃতিচিত্র /১
তুলসীবাবু যে কেবল আমাদের পরামর্শগুলো নিলেন তা নয়, তার পরেও কিছু দিলেন। সে হলো রামু ধরের অনন্য চরিত্র, যা পরে মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের অভিনয়ে অবিস্মরণীয় হয়েছে। এবং এই পরিবর্তনের ফলে নাটকের শেষটাও বদলে যেতে বাধ্য হ’ল। যে বাউরী চরিত্রগুলি আদিতে তুচ্ছ ছিল তারাই নায়ক হয়ে উঠলো – একা নয়, সমগ্র ভাবে এবং নাটকের মহৎ কথা তাদের মুখ দিয়েই বর্ণিত হলো।
— শম্ভু মিত্র / প্রসঙ্গ : নাট্য
স্মৃতিচিত্র /২
… ‘টিমওয়ার্কের সেই যেন সূত্রপাত। চায়ের দোকানের খুঁটি নাটি খেয়াল করে স্টেজটাকে সাজিয়ে ফেলা হ’ত। …আঁকা পটের বিরোধী তিনি (শম্ভু মিত্র) প্রথাবধিই। নতুন চটের পর্দার ওপর আলো পড়লে চমৎকার দেখায়। তাঁর প্রযোজনায় মনোরম মঞ্চসজ্জা তিনি চাননি – চেয়েছেন একটা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করতে । …
কুমার রায় / ১৯৯৪
পথিক, মূল নাটক : দি পেট্রিকায়েড ফরেস্ট,
নাট্যকার : রবার্ট এসেট্ সেরউড, আমেরিকা ১৯৩৫, রূপান্তর : তুলসী লাহিড়ী, রচনাকাল – ১৯৪৮ কলকাতা।
স্থান – বাংলা-বিহার সীমান্তে চায়ের দোকান > পূর্ব অ্যারিজোনার মরুভুমি অকাল,
অসীম/ মানবদরদী নাট্যকার > অ্যালাড কুইয়্যার / স্বপ্নবিলাসী সাহিত্যিক,
সিংড়া সিং / ডাকাত সর্দার, আনন্দ > ডিউক ম্যান্টি / ডাকাত সর্দার
যশপাল / দোকানদার > জেসন ম্যাপল / সরাই খানার মালিক
সুমিত্রা / যমপালের নাতনী > গ্যাবি / ম্যাপলের নাতনী
সুদর্শন / যশপালের ভ্রাতৃষ্পুত্র > গ্রাস্প / ম্যাপলের পুত্র
নিবারণ / সুমিত্রার কৃপাপ্রার্থী > বোজ্ / গ্যাবির প্রণয়াকাঙ্ক্ষী,
( দর্শন ও বস্তুবাদের চড়া সুর, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্লান্ত পৃথিবী আরো স্পষ্ট রূপান্তরিত দুর্ভিক্ষ আর ক্ষুধাতুর বাংলার মানচিত্রে )
ক্রমশঃ