শম্ভু মিত্র যাপনচিত্র – পর্ব ৮

কমল সাহা

 

|| পথিক || ৩

সমালোচনা এক. 

‘ রচনা কৌশল সম্পূর্ণ অভিনব। একটি ছোট্ট দোকানঘরের মধ্যে কয়েকদিনের ঘটনা নিয়ে যে পরিপূর্ণ নাট্যরসপুষ্ট একখানি ৩ ঘন্টার নাটক হতে পারে তা না দেখলে ঠিক ধারনা হয় না। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য (রাসু ধর), কালী সরকার (যশপালের ভাইপো), গঙ্গাপদ বসু (কয়লা খনির মালিক), শম্ভু মিত্র (একজন পথিক) সকলেই অত্যন্ত সংযত ও সু অভিনয় করেছেন‌। সর্বোপরি প্রশংসা দাবী করতে পারেন বুধনী (স্মৃতি ভাদুড়ী সুমিত্রাদের ঠিকে ঝি) ও বাউরী (দীপ্তি বাগচি?) চরিত্রের অভিনেত্রী। এদের অপূর্ব টিমওয়ার্ক সারাক্ষণ দর্শকদের অভিভূত করে রাখে। সাধারণ রঙ্গমঞ্চের প্রয়োগ পদ্ধতি ও অভিনয় ধারার প্রভাব থেকে এরা সম্পূর্ণ রূপে মুক্ত। বাংলাদেশের নূতন নাট্য আন্দোলনের গতিকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে, এ বিশ্বাস আমাদের আছে। ‘
– গৌরকিশোর ঘোষ, সত্যযুগ, অক্টোবর ১৯৪৯

সমালোচনা দুই . (বোল্ড হবে)
‘ সম্প্রতি শিয়ালদহ রেলওয়ে ম্যানশন হলে শ্রীযুক্ত তুলসী লাহিড়ীর নবরচিত পথিক নাটকের অভিনয় দেখিয়া আমরা তৃপ্তি লাভ করিয়াছি। মালভূম জেলার একটি কয়লাখনি সকলকে কেন্দ্র করিয়া মাত্র তিনটি দৃশ্যে পূর্ণাঙ্গ নাটকখানি গড়িয়া উঠিয়াছে । আঙ্গিকের দিক দিয়া ইহা আধুনিক।’

— আনন্দবাজার পত্রিকা ২৮.১০.১৯৪৯

সমালোচনা তিন . (বোল্ড হবে)
‘এই সম্প্রদায়ের কর্ণধার পরিচালক শম্ভু মিত্রের নাট্য প্রতিভার পরিচয় বাংলাদেশ পেয়েছে শ্রীযুক্ত মিত্র পরিচালিত নবান্ন নাটকের মধ্যে। কিন্তু অধিকতর অভিজ্ঞতা ও প্রতিভার বিকাশে এবং নবীন ও বাংলার খ্যাতনামা কয়েকজন প্রধান শিল্পী সমন্বয়ে অভিনীত ‘পথিক’ অকুন্ঠ প্রশংসার দাবী রাখে। … অতি সাধারণ চট সহযোগে অনাড়ম্বর দৃশ্য সজ্জায় … তিনি এক নতুন দৃষ্টির পরিচয় দিলেন। একটি মাত্র দৃশ্যে নাটকের সমস্ত ঘটনা সমাবেশ করলেও কোথাও এক ঘেয়েমি সৃষ্টি করে না। এমন কি নাটকের গতি চরিত্রগুলোর সজীবতা।
নায়ক অসীম রায়ের ভূমিকায় শম্ভু মিত্র চরিত্রটিকে শুধু সার্থক করে তোলেননি তার অভিনয় প্রতিভার দর্শক মাত্রের‌ই শ্রদ্ধার্জন করে। তাঁর নাট্যপ্রতিভা আমাদের মনে এতখানি আশান্বিত করেছে যে, এই নবীন শিল্পী বাংলার নাট্যক্ষেত্রের অভিনয়ের যশ বৃদ্ধি করতে সমর্থ হবেন।’
– সচিত্র ভারত, ০৯.১২.১৯৫০

শম্ভু মিত্রের চিঠি(বোল্ড হবে)
পথিক প্রযোজনার পরেই ১৯৪৯ এর শেষ দিকে মিত্র দম্পতি বোম্বে গেলেন সিনেমার কাজে তিন মাসের জন্য। ১১ এ, নাসিরুদ্দিন রোডের বাড়ি বিশ্বদীপ। মহর্ষি নিয়ে এসেছেন তার পুত্র শংকর ভট্টাচার্যকে। তাদের অবর্তমানে দলের অবস্থা নিবু নিবু। আমোদ উত্তেজনা মহলা হৈ চৈ সব স্তিমিত। উদ্বিগ্ন শম্ভু মিত্র বোম্বে থেকে চিঠি লিখলেন অশোক মজুমদার মশাইকে, সম্ভবত ডিসেম্বর ১৯৪৯ :
… ‘ আমরা ভয়ানক নতুন একটা কাজ করতে চলেছি। নাটকের আন্দোলন যে করতে নেমেছে মনে থাকে সে এক প্রচন্ড সুরুহ আর্টিস্টিক কাজ করতে নেমেছে। আমাদের মধ্যে একটা fanatic zeal না থাকে তো আমরা doomed. খালি আমরা doomed হলে ভাবনা ছিল না। আন্দোলন‌ও doomed. এই আন্দোলন আমাদের বাঁচার পদ্ধতি বদলে দেবে। দল ছাড়া নাটক হয় না, এই এর প্রচন্ড সুবিধে এবং মুস্কিল। সুবিধে এই জন্যে যে, ঠিক মতো দল গড়তে পারলে আমরা তার মধ্যে collectively এবং co-operatively বাঁচতে শিখবো। This is the art of the New life, the life yet to come. আর তা যদি না পারি, তাহলে যা মুস্কিল এবং যা নোংরামি সে তো তোমরা সকলেই ভালো করে জানো। …আমরা ভয়ানক fortunate যে we have such wonder but young people around us — সত্যিই remarkable, আমি যতো ভাবি, ততো আমার বুক ভরে যায়। i really feel emotional — এগুলো incomparable human material নিয়ে আমরা কিছু করতে পারবো না? i deby.’

কয়েকটি প্রশ্ন (বোল্ড হবে)

১. চিঠিটার প্রচুর ইংরেজি শব্দ। শম্ভু মিত্র অনেক নিবন্ধ লিখেছেন কিন্তু তাঁর অনবদ্য ভাষার সঙ্গে এর কোন মিল নেই। খুবই emotional চিঠি।

২. এই পর্বে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন প্রচুর অভিনেতা। পরে তিনি তৈরি করে নেবেন তাঁর শক্তিমান অভিনয় শিল্পী দল। এতোগুলি অতুলনীয় মনুষ্য সম্পদ পেয়েও তিনি অসন্তুষ্ট থাকবেন। অনীহা প্রকাশ করবেন নির্দেশনায়!

৩. নতুন একটা দল গঠন করার পর
নামকরণের আগেই দুটো প্রযোজনা করে তিনি সস্ত্রীক বোম্বে! মন পড়ে রইলো কলকাতায়। বোম্বের মায়া কাটাতে পারলেন না! দল বিপর্যস্ত… কোনদিনই পারবেন না বোম্বের হাতছানি এড়াতে!

আদর্শ শিক্ষক (বোল্ড হবে)
একেবারে শুরু থেকেই শম্ভু মিত্র ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। স্তানিস্লাভস্কির ব‌ই থেকে পড়ে শোনাতেন, বুঝিয়ে দিতেন। এমনকী সংগঠন কী করে করতে হবে সে সম্পর্কেও নানান রকমের ব‌ই যোগাড় করে আলোচনা করতেন। বুঝিয়ে দিতেন। বলতেন এটা একটা মিশন। এই যে নাটক আমরা করতে যাচ্ছি, এর মধ্য দিয়েই, মানে নাটমঞ্চের থেকেই আমরা একটা দেশের কাজ করতে যাচ্ছি। এই স্বাধীনতার পর, জনসাধারণের কী কর্তব্য, কীভাবে তাদের চলতে হবে, কীরকম ভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের সচেতনতা আসবে এসব সম্পর্কে তাদের বোঝাতে গেলে নাটক একটা মস্ত বড় হাতিয়ার। এবং সেই নাটক করতে হবে এমন একটা মন নিয়ে, এমন একটা চিন্তা নিয়ে যাতে আমরা সেই ভাবে কম্যুনিকেট করতে পারি জনসাধারণের সঙ্গে। দর্শকদের সঙ্গে।
শুধু নাটকের কথাই নয় — তিনি চাইতেন দলের প্রতিটি সদস্য হয়ে উঠবে সংস্কৃতিবান সৃজনমনস্ক কর্মী। সর্বদাই কাজ করতে হয়েছে নবীনদের নিয়ে – সবাই তাঁকে অসম্ভব শ্রদ্ধাভক্তি করেছে — গুরুদক্ষিণা দিয়েছে শ্রমে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়। দূরত্ব একটু ছিল‌ই – বড়ো মাপের মানুষের সঙ্গে সকলের নৈকট্য কল্পনাতীত।
অসহনীয় কষ্টের মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। আর্থিক কষ্ট তো ছিল‌ই, অনেকের‌ই কোন‌ও রোজগার ছিল না। শম্ভুবাবুর‌ও নয়। এদিকে শাঁওলীর আবির্ভাব হয়েছে। একদিকে সংসার চালানোর দায় অন্যদিকে নাট্যক্রিয়ায় সম্পূর্ণ মন দেয়া। ঘরে-বাইরে নানা বিতর্ক নিয়ে কাজ করা। খাওয়া দাওয়া তো জুটতো না ভালো করে। কোনো আর্থিক সাহায্য কারুর কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। কিন্তু কোনো দিন শম্ভু মিত্র দুঃখ করেননি। চিরকাল তিনি সেই অর্থে যাকে সামাজিকতা বলে, উৎসব বলে, সেই সবে অংশগ্রহণ করবেন না। মহলার সময় সকলে মিলে কিছু পয়সা সংগ্রহ করে মুড়ি কিনে তৃপ্তি সহকারে খাওয়া হত। এমন দিন‌ও গেছে অভিনয়ের দিন চা জলখাবারের পয়সা সংগ্রহ করা যায়নি। অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। চাকরির সুযোগ তো তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু নেননি‌। ভাগ্যিস নেননি। তাই আমাদের থিয়েটার এত ধনী হয়ে উঠলো।
( তথ্যসূত্র : অশোক মজুমদার ও অমর গাঙ্গুলীর সাক্ষাৎকার )

ক্রমশঃ 

One thought on “শম্ভু মিত্র যাপনচিত্র – পর্ব ৮

Comments are closed.