কমল সাহা
বহুরূপীর নীতি ও কার্যভার || ১.৫.১৯৫০
সভাপতি : মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। সম্পাদক : অশোক মজুমদার। কোষাধ্যক্ষ : মহম্মদ জ্যাকেরিয়া। কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য : অমর গাঙ্গুলি, তৃপ্তি মিত্র, মহম্মদ ইসরাইল ও সবিতাব্রত দত্ত। আর শম্ভু মিত্র? তিনি রইলেন নেপথ্য নায়ক হিসেবে যেমন ছিলেন স্বাধীনতার পর এক উলঙ্গ সন্ন্যাসী। তিনি পরিচালক।
উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি
১. আমরা ভালো নাটক অভিনয় করতে চাই, যে নাটকে সামাজিক দায়িত্ব জ্ঞানের প্রকাশ ও মহত্তর জীবন গঠনের প্রয়াস আছে।
২. দেশের ঐহিত্যের ভাণ্ডারে যে সমস্ত সাহিত্য ভাণ্ডার আছে তার মধ্যে নাটকগুলির ও গল্প উপন্যাসাদির প্রয়োজন মতো নাট্যরূপ দিয়ে সেগুলিকে অভিনয় করে জনপ্রিয় করে তোলাও আমাদের কর্ত্তব্য।
৩. আবৃত্তি ও গানের অনুশীলন করে সেগুলি পরিবেশনের বিভিন্ন রূপ আবিষ্কার করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি যেনো করি।
৪. বৎসরে চারটে নতুন নাট্য-আসরের ব্যবস্থা করবোই। অনুগ্রাহকরা বিনা খরচে অভিনয়াদি দেখতে পাবেন।
৫. অনুগ্রাহকদের বার্ষিক হার চাঁদার ন্যুনপক্ষ্যে ৮্ (টাকা) , অপর পক্ষে ১২্ (টাকা), এই চাঁদা আমাদের আসর ব্যবস্থাপনায় খরচ হবে।
৬. …বর্ষ হিসাবে চাঁদা নেওয়ার কারণ এই যে, প্রত্যেক নতুন অভিনয়ের সময়ে তাঁদের কাছে খরচ বাবদ চাঁদা চাইতে যাওয়ায় আমাদের অনেক শক্তি ও সময়ের অপচয় ঘটে।
(গুদামপচা পটের সামনে অভিনয় করতে হয় … চট টাঙিয়ে জাত ও কুলরক্ষা …)
৭. অনুগ্রাহকরা এককালীন না দিয়ে কিস্তি হিসেবেও চাঁদা দিতে পারেন।
৮. শিল্পের শ্রীক্ষেত্রে কোনও দিন জাতিধর্মের ভেদ থাকে না। থাকা উচিত নয়। আমাদের এই দলেও জাতি ধর্মের সংকীর্ণ গণ্ডী ভেঙে মানুষের সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটানোই আমাদের লক্ষ্য।
( নিচে সভাপতি ও সম্পাদকের স্বাক্ষর। সংক্ষেপিত কর্মসূচি )
পূনশ্চ।। ছেচল্লিশের দাঙ্গা হয়ে গেছে। দলে এলেন কলিম সরাফি, মহম্মদ জ্যাকেরিয়া, মহম্মদ ইসরাইল। শম্ভু মিত্রের মন্তব্য : ওঁরা থাকলে ব্যাপারটায় উদারতার প্রকাশ ঘটবে। বঙ্গ নাট্য ইতিহাসে মুসলমানের উপস্থিতি সমুদ্রে ১ চামচ জল …দশ হাজারে ১ জন!
উলুখাগড়া || ১
শম্ভু মিত্রের মতে এখন নাটকের দুর্ভিক্ষ চলছে। তাই নিজের প্রথম নাটকটাই করাতে বাধ্য হলেন ছদ্মনামে। উত্তাল সময়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ খাপ খাবে না! তিনি এখনো পৌঁছুতে পারেননি রবীন্দ্রনাথে।শেক্সপিয়র নিয়ে উৎপল ব্যস্ত। ওটা ওঁর একচেটিয়া। ও নাটক করার মতো শক্তিশালী অভিনেতা বহুরূপীতে নেই! বিজনের নাটকে কাব্যময়তায় আধিক্য। দিগিনবাবুর সঙ্গে আড়ি। শচীনবাবু নিঃশেষিত। বীরুবাবু গণনাট্যের। সুতরাং উলুখাগড়া। বহুরুপীর প্রথম নাটক। ঘোষিত নীতি ও কার্যসূচির সঙ্গে মিল নেই। কোনো সাহিত্য গ্রহণ করলেন না! নাট্যরূপ কে দেবেন? উলুখাগড়ার নির্বাচন মোটেই ভালো হলো না। এটা কোন স্মরণীয় নাটকই নয়। পেশাদারী মঞ্চের বাইরে বেরুতে পারছেন না তিনি। নাটকের নয়, দুর্ভিক্ষ চলছিল শম্ভু মিত্রের ভাবনা ও চিন্তার জগতে। সিনেমার হাতছানি আর গণনাট্য-মুক্তির এক তীব্র টানাপোড়েন। দেখা যাক, বাজে নাটক কতোটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নির্দেশনার গুণে, অভিনয়ে। ১২.৮.৫০ উলুখাগড়ার প্রথম অভিনয় রেলওয়ে ম্যানমন ইনস্টিটিউট্যুটে অনুগ্রাহক সভ্যদের জন্যে। রচনা : শ্রী সঞ্জীব (শম্ভু মিত্র)। নির্দেশনা : শম্ভু মিত্র। প্রযোজনা : বহুরূপী (প্রথম নাটক)। মঞ্চসজ্জা : বংশীলাল চন্দ্রগুপ্ত ও গণেশচন্দ্র বসু। আবহ সঙ্গীত : দেবব্রত বিশ্বাস, কৃষ্ণকুমার মিত্র, সঞ্চিত গুপ্ত, রবীন্দ্র মিত্র।
অভিনয়ে :- করুণা : তৃপ্তি মিত্র/ মিনতি : মুক্তি গোস্বামী/ নিনা : গীতা ভাদুড়ী ( পরে অনিতা দাশগুপ্তা ) রঘু : মহম্মদ জ্যাকেরিয়া / বিনোদ : শম্ভু মিত্র / সুরেশ : সবিতাব্রত দত্ত ( অমর গাঙ্গুলি ) তিনজন গুণ্ডা – নন্দ : শোভেন মজুমদার / কেনো : অমর গাঙ্গুলি (বেনীমাধব মুখার্জী) / ভজা : নির্মল চ্যাটার্জী / পকানন : গঙ্গাপদ বসু (কুমার রায়) / দেবব্রত : কালী সরকার (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, গঙ্গাপদ বসু)
|| পুনশ্চ ||
তৃপ্তি মিত্রেরা ৯ বোন। এ নাটকে ৩ জন। পথিকে বুধনী সেজেছে স্মৃতি। যে কোনো সৌখীন নাট্যদলে অভিনেত্রী সংগ্রহ এক তীব্র সমস্যা। এখানে জামাইবাবুর শ্যালিকার অভাব নেই। ঈর্ষণীয় প্রাপ্তিযোগ।
এই সেই বংশী চন্দ্রগুপ্ত — মানিকদার ছবির নেপথ্য সম্পদ।
ছদ্মনাম কেন? রচনা– নির্দেশনা– অভিনয়– সবই একজন, ব্যাপারটা কি অশোভন হতো?
উলুখাগড়া || ২
স মা লো চ না
প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পূর্ণ অভিনব। একটা দরজা বা একটা জানলা বসিয়ে সেট সাজানোর চেষ্টা একটা গভীর শিল্প বোধের পরিচয় দেয়।
— চিত্রবাণী সেপ্টেম্বর,১৯৫০
পটভূমিকায় ইহার গল্পাংশ গড়িয়া উঠিয়াছে। সম্পূর্ণ নূতন ধরনের নাটকখানির মঞ্চসজ্জা করেছিল — কোন দৃশ্যেই পুরা দৃশ্যপট নাই …
— আনন্দবাজার পত্রিকা ১৫.৯.৫০
পরিচালনায় ও অভিনয়ে তিনি রসানুভূতির ও রস সঞ্চয়ের শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। বিনোদের প্রগলভতা যেমন লঘু ছন্দে ব্যস্ত করে তিনি মনোরঞ্জন করেছেন। তেমন মর্মাহত বিনোদের মনের গভীরতম স্তরের কঠোর অনুভূতিকেও অভিনয় দ্বারা হৃদয়গ্রাহী করেছেন।
—শচীন সেনগুপ্ত, আনন্দবাজার ১৫.১০ ৫০
উলুখাগড়া সম্পর্কে আমাদের মত বিপরীত। গোপন ব্যবসায়ে বড় বড় শহরের খালি বড়লোকের বাড়ির চিত্র। এরা সমাজের কতটুকু অংশ? বাইরের বৃহৎ সমাজের কয়জনের ইহাদের সঙ্গে পরিচয় আছে? এই ক্ষুদ্র অংশের আভ্যন্তরীণ ব্যভিচারের চিত্র অপরিচিত জনসমক্ষে প্রচারে লোকশিক্ষার পরিবর্তে বিপরীত ফল হইবে বলিয়াই আমরা আশংকা করি। এই বই প্রচারের যদি কোথাও প্রয়োজন থাকে তবে তাহা বড় বড় শহরেই হওয়া উচিত, যেখানে এই সম্প্রদায় বিদ্যমান।
— অঞ্জলি পত্রিকা, কাটোয়া ২.১১.৫০
পুনশ্চ ।। উলুখাগড়ার কাহিনী মিলবে ‘প্রথম নাট্য রচনা’ শিরোনামে ১৯৪২-৪৩ পর্বে। ব্যক্তিগত ভাবে বর্তমান গবেষক অঞ্জলি পত্রিকার সঙ্গে একমত।
ক্রমশঃ
বাহ!পড়লাম।চলতে থাকুক।
ইতিহাস সন্মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনেক ধন্যবাদ।
এসব তথ্যমূলক লেখা থেকে আমরা সময় ও মানুষকে চিনতে জানতে চেষ্টা করি বরং।
লমলদার এই আগে পিছে করে লেখার স্টাইল দারুণ। যেমনটা আমরা পরেছিলাম ‘শম্ভু মিত্র প্রতি কল্প উৎপল দত্ত ‘লেখায়।
এই ধারাবাহিক এগিয়ে চলুক, তর্ক চলুক জমিয়ে।