কমল সাহা
প্রথম নাট্য উৎসব, আয়োজক বহুরূপী নাট্যদল। স্থান নিউ এম্পায়ার। অভিনয় সূচি:
৩.১২.৫০ – পথিক, ১০.১২.৫০ – উলুখাগড়া,
১৭.১২.৫০ – ছেঁড়াতার, ২৪.১২.৫০ – পথিক, ৩১.১২.৫০ — উলুখাগড়া, ৭.১.৫১ – ছেঁড়াতার।
প্রতি রবিবার সকাল সাড়ে দশটায়।
দু সপ্তাহে ৩টি নাটক ২বার করে। টিকিট : ১০, ৫, ৩, ২, ১, বঙ্গ জীবনের অঙ্গ যেমন দূর্গাপূজা, পুরী ভ্রমণ, বিবাহ উৎসব, জলসা, বইমেলা ঠিক তেমনি শম্ভু মিত্র আরো একটি উৎসবের সূচনা করলেন। নাট্য উৎসব। এর আগে শিশিরবাবুও এই শব্দ দুটি এভাবে ব্যবহার করেননি। বিশেষ অভিনয়, বেনিফিট নাইটস, কম্বিনেশন শো অনেক হয়েছে। নাট্যোৎসব এই প্রথম। সুদৃশ্য বিশাল রঙ্গালয়। ইংরেজি সিনেমার সাহেবী ব্যাপার। সেখানে খড় ইট চট বেড়া ইত্যাদির প্রবেশ নিষেধ। তখন এরিক এলিয়ট এসেছিলেন কলকাতায়, তিনি উলুখাগড়া দেখে মুগ্ধ। কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলেন তিনিই। অনুমতি মিলল।
অরণি বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে আঁকলেন বিরাট একটা হোডিং। ঝুলিয়ে দিলেন নিজেদের বাড়ির বারান্দায়। দলের সভ্যরাই বাঁশ আর দরমা বেড়ায় পোস্টার লিখে প্রচার অভিযান শুরু করে দিলেন। এই উপলক্ষেই যোগাযোগ হলো খালেদ চৌধুরীর সঙ্গে।
আর্থিক লাভ বিশেষ হলো না। টিকিট বিক্রি হলো সমস্তটাই। প্রত্যেক শোয়ের জন্য মঞ্চ ভাড়া দিতে হলো ৫০০ টাকা! জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র বিস্মিত হয়েছিলেন এক ভরি সোনার দাম ১০০ টাকা হওয়ায়। কী দুর্মূল্য! তাহলে সেদিনের ৫০০ টাকা কী বিরাট অংশ সহজেই অনুমেয়।
অর্থ না হলেও দলের অভিজাত্য বাড়ল। একটা সম্মানজনক অবস্থায় পৌঁছুনো গেল। গরীবের একদিন ঘি খাবার স্বপ্ন নয় — চিরকাল সুখে থাকার অদম্য ইচ্ছা! প্রযোজনার খ্যাতিতে তুঙ্গে উঠলো প্রশক্তির শব্দ রাশি। বিরাট ঝুঁকি নিলেন শম্ভু মিত্র – জিতে গেলেন পরোক্ষ ভাবে। এর ফলভোগ করবে বহুরূপী দীর্ঘদিন।
সিনেমা. ১৯৫০
এক. ২৪.২.১৯৫০ ‘আবর্ত’ বাংলা ছবির মুক্তিলাভ। নির্দেশনা : বিশ্বকর্মা। অভিনয়ে : শম্ভু মিত্র।
দুই . OUR INDIA তথ্য চিত্রের মুক্তি। ছবিটির পরিচালক জন জিলে্স। প্রযোজক : ডকুমেন্টরি ইউনিট অব ইন্ডিয়া। এই ইংরেজি ছবিতে অভিনয় করেন কে. এন. সিং, ডেভিড, দূর্গা, খোটে, দেব আনন্দ, প্রেমনাথ, পৃথ্বীরাজ কাপুর, শম্ভু মিত্র ও শীলা নায়েক। এটি শম্ভু মিত্র অভিনীত দ্বিতীয় ও শেষ ইংরেজি ছবি।
তিন . ‘দুর্লভ জন্ম’ ছায়া ছবির মুক্তি। নির্দেশনা : প্রফুল্ল চক্রবর্তী। অভিনয়ে : শম্ভু মিত্র।
চার. ‘হিন্দুস্থান হামারা’ ছবির মুক্তি। OUR INDIA-র হিন্দি রূপ। অভিনয়ে: শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র।
ভক্তের ইতিহাস
মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর। কলকাতা থেকে নাটক এলো। এলেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র। সদ্য স্বাধীন বিভক্ত দেশ। আশা আর আকাঙক্ষায় জট পাকানো প্রচণ্ড চঞ্চল সেই দিনগুলি। উদ্বাস্তু অধ্যুষিত অর্থনীতি। অরাজক রাজনীতি। গণনাট্য সংঘে ভাঙন। বহুরূপীর নাটক দেখে মন মাতালের অবস্থা।
নাট্যাভিনয়ের পরদিন পাকা বাড়ির পুজোর দালানে অসংখ্য ভক্তের ভীড়, তারা বসেছে কথা শুনতে। ভক্তের মতো। সামনে মহর্ষি, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র। এবং আরো কয়েকজন। অনেক প্রশ্ন, অনেক উত্তর। বেশির ভাগ উত্তর দিলেন মহর্ষি আর শম্ভু বাবু – তৃপ্তি মিত্র রইলেন চুপ করে বসে। একজন গ্রাম্য ভক্ত জানালেন শম্ভু মিত্রকে : একটা কবিতা আবৃত্তি করবেন। আবৃত্তি হলো। শেষ হতেই ‘আরেকটা’ ‘আরেকটা’ রব উঠলো। শম্ভু বাবু বললেন : ‘এবার আমরা দুজনে মিলে একটা আবৃত্তি করবো আর এইটেই শেষ। আমাদের ক্ষমা করবেন, আমরা খুব ক্লান্ত।’
তৃপ্তি মিত্র এবং শম্ভু মিত্র আরম্ভ করলেন :
‘দে দোল দোল—দে দোল–এ মহাসাগরে তুফান তোল ‘…
এর আগে যুগ্ম আবৃত্তি শোনেননি এই গাঁয়ের মানুষ। প্রায় গ্রামীণ মনের নালায় তুফান উঠলো। এত অভিনব শব্দসঙ্গীতের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হলো সেদিন। সেই শব্দতরঙ্গ শোনা গেছে এঁদের প্রতিটি নাটকেই! সব বইতে।
ছোট্ট শহর। পালা পার্বণে যাত্রা হতো। কখনো কখনো হতো ঐতিহাসিক বা ধার্মিক। পুরুষরা সেজেগুজে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতো। ‘চোখে ঘুম, মুখে চানাচুর ‘… রঙ্গমঞ্চের রঙ্গ দেখে উদ্বেল গ্রামবাসী! হঠাৎ এবার চোখ খুলে মন দিয়ে নাটক দেখার নাটক শেখার অভিজ্ঞতা। একদিন নাটক দেখে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ সেই নাটক নিয়ে আলোচনায় বাধ্য হওয়া। মগ্ন হয়ে থাকা একটা বিরাট পরিবর্তন এলো মুর্শিদাবাদে।…
কিন্তু সত্যি সবাই জানে কি ইতিহাস! ইতিহাস কি কখনো সত্যি জানায়! সব ইতিহাসই তো হয় ভক্তের নয় নিন্দুকের লিপিবদ্ধ করা!
— তথ্য উৎস : বাসু ভট্টাচার্য রচিত নিবন্ধ
তৃপ্তি মিত্র : তৃপ্তিদি
বিভাব |১
প্রথম অভিনয় ২৯.৪.১৯৫১ , প্রযোজনা : বহুরূপী, নির্দেশনা : শম্ভু মিত্র। স্থান : সুধাংশু গুপ্তের বাড়ি। ২৩৫ লোয়ার সার্কুলার রোড, কলকাতা। অনুগ্রাহকদের জন্যে বিশেষ অভিনয়। নাট্যরচনা : বহুরূপীর সদস্যবৃন্দ। ছোট্ট একাঙ্কিকা।
অভিনয়ে : অমর গাঙ্গুলী, তৃপ্তি মিত্র, শম্ভু মিত্র
তৎসহ আবৃত্তি গাঁথা, দেবব্রত বিশ্বাসের গান, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের নবজীবনের গান।
অভাব এবং বিভাব
…এর নাম হওয়া উচিত ‘অভাব নাটক’। কারণ দুরন্ত অভাব থেকে এর জন্ম। আমাদের একটা ভালো stage নেই। সিন সিনারী আলো কিছু আমাদের নিজেদের নেই। সঙ্গে থাকবার মধ্যে আছে কেবল নাটক করার বোকামিটা। তাও যদি বা যোগাড়যন্তর করে অভিনয়, একটা ফাঁকি সরকারের পেয়াদা খাজনার খাতা খুলে স্টেজের দরজায় হাজির। তাঁরা পেশাদারের কাছে খাজনা নেন না। কিন্তু আমাদের কাছে নেন। কারণ, আমরা তো নাটক নিয়ে ব্যবসা করি না। তাই সরকার আমাদের গলা টিপে খাজনা আদায় করে নেন। এবং এই নেওয়াটাই এমন বিচিত্র সাঁড়াশি ভঙ্গীতে যে আমরা সর্বস্ব দিয়ে থুয়ে আবার ব্যোমকালী বলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি।
তাই অনেক ভেবে চিন্তে আমরা একটা প্যাঁচ বের করেছি। stage-এর দরকার হবে না। যে কোন রকম একটা plat form হলেই চলবে। সিন সিনারী দরজা জানালা টেবিল বেঞ্চ কিছুরই দরকার হবে না। আমরা অভিনয় করবই।
(শম্ভু মিত্র / বিভাব/ বহুরূপী : ৬৯, ১.৫.১৯৮৮)
কাবুলিআলা এবং বিভাব
কাবুলিআলার নাট্যরূপ দিতে পারলেন না কানাই বসু। ঘোষিত নাটকের বিকল্প হিসেবে একটা স্বতঃস্ফূর্ত নাট্যালেখ রচনা করলেন অমর গাঙ্গুলী শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্র। হাসি ঠাট্টা মজার একাঙ্ক। ঠিক সেই সময় কলকাতায় খবর এলো আগরতলা থেকে : খাদ্যের দাবীতে মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চালনা। সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘটনা জুড়ে দেয়া হলো নাটকের শেষাংশে। এভাবেই নাটকের দুর্ভিক্ষ দূর করছেন নবীন নাট্যদল। প্যাঁচ কষছেন কর ফাঁকি দেবার।
বিভাব | ২
হেঁয়ালি ও বিভাব
রবীন্দ্রনাথও এক সময় ইয়োরোপের অনুসরণে হেঁয়ালি নাট্য রচনায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। কথা ছিল সবাই মিলে রচনা করবেন একটা নাটক। শুরুও হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরোটাই লিখতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকেই। অনেকে মনে করেন, বিভাব শম্ভু মিত্রের রচনা।
কাবুকী এবং বিভাব
প্রচলিত কিংবদন্তী এবং পুরাণ কাহিনী মিলে জাপানী কাবুকী নাটক রচিত হয়। কখনো এসে পড়ে ইতিহাসের অনুষঙ্গ। মঞ্চ কিংবা উন্মুক্ত স্থানে অভিনীত হয় কাবুকী। পাত্রপাত্রীরা বাঁ দিক থেকে ঢোকে, গভীর পর্যন্ত যায় মধ্য ভাগে — প্রবেশ প্রস্থান করে একই পথ ধরে। সমস্ত নাটকটাই অভিনীত হয় দর্শকদের মাথা সমান উঁচু বেদীতে। কখনো পাত্র পাত্রীরা ঢুকে পড়ে দর্শকদের মাঝখানেও।
(পেঙ্গুইন ডিকশনারি অব থিয়েটার ১৯৬৬ / জন রাসেল টেলর / বঙ্গানুবাদ লেখক)
একবার রবীন্দ্রসদনে এবং একবার জাপানের কোনে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাবুকী দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিভাবের সঙ্গে আশ্চর্য এর মিল।
তামাশা এবং বিভাব
মহারাষ্ট্রের থিয়েটার বড় প্রিয় ছিল শম্ভু মিত্রের। সিনেমা উপলক্ষে বারবার বোম্বে গেছেন। ১৯৫১ সালের মধ্যেই দেখে নিয়েছেন মারাঠী লোকনাট্য তামাশা। তামাশার আঙ্গিকের সঙ্গেও এর অনেক মিল। গণনাট্য পর্বে বিভিন্ন সম্মেলনে গেছেন গ্রামে গঞ্জে। সেখানেও দেখেছেন অনেক লোক নাট্য। সহজ এবং অনাড়ম্বর লোকনাট্যের প্রতি ঝোঁক তাঁর বহুদিনের।
যাত্রা এবং বিভাব
যাত্রা নিয়ে শম্ভু মিত্রের নিবন্ধ ‘বাংলা থিয়েটার’ রচিত হয়েছে ১৯৫১ এবং বিভাবের প্রযোজনাও ১৯৫১। যাত্রার ভাবনা উদ্দীপ্ত করেছে বিভাব করার সময়ে। স্পষ্ট বলেছেন : ‘আমি করেওছি বার আষ্টেক দশ।’ রবীন্দ্রনাথকে তিনি আমাদের যাত্রার শ্রেষ্ট নাট্যকার বলেছেন সেই নিবন্ধে।
দ্রষ্টব্য : যা দেখেছি / শম্ভু মিত্র / ১৯৭২
বিভাব | ৩
যাত্রায় দৃশ্যপট লাগে না। পর্দা থাকে না। সকলের সামনে অভিনেতা অভিনেত্রীরা তাঁদের প্রবল অভিনয় গুণে দিনকে রাত্রিতে পরিণত করেন। যা বলেন তাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় অগণিত দর্শক। মঞ্চও লাগে না।
‘বাংলায় অভিনয় পদ্ধতি হচ্ছে কথকতার বংশধর। কথা কইতে কইতে গান গেয়ে ওঠা যাত্রারও নিয়ম ছিল, থিয়েটারেরও নিয়ম, বাংলা সিনেমারও নিয়ম।’
ইয়োরোপের অপেরা থেকে থিয়েটারের সৃষ্টি। আজকের থিয়েটারে যাত্রার আঙ্গিক ‘ব্রেখটের থিয়েটার’ বলে পরিচিত! শিশিরকুমারও চেয়েছিলেন থিয়েটারকে যাত্রার সহজ বিন্যাসে নিয়ে যেতে, পারেননি।
বিভাবের ভূমিকা
বিভাব যখন অভিনীত হচ্ছিল, অভিনয় শুরুর আগে শম্ভু মিত্র ছোট্ট একটি ভাষণ দিতেন এই অভিনব নাট্যকলা বিষয়ে। তাতে তিনি উল্লেখ করতেন সংস্কৃত নাট্যশাস্ত্র, তার আঙ্গিক; জাপানী নো নাটক এবং বাংলা লোকনাট্যের কথা। বুঝিয়ে বলতেন বিভাবের বৃত্তান্ত।
ভোটের ভেট এবং বিভাব
আগামী বছর (১৯৫২) সাধারণ নির্বাচন। পানু পাল লিখবেন ‘ভোটের ভেট’। উৎপল দত্ত ঋত্বিক ঘটক পানু পাল সবাই মিলে অভিনয় করলেন মনুমেন্টের নীচে। প্রথম বাংলা পথনাটক। সেই নিয়ে গণনাট্যে গণ্ডগোল। এরপর অন্তত: ৭০টি পথনাটক লিখেছিলেন পানু পাল।
আজ নির্বাচনী এবং অন্যান্য সংকট নিয়ে প্রচুর পথনাটক অভিনীত হচ্ছে। কার্জন পার্ক, অঙ্গন মঞ্চে, আকাদেমির সামনে। শতাব্দী, পথসেনা নিয়ে বাদল সরকার প্রচণ্ড ব্যস্ত। বিভাবকে কি পথনাটক বলা যায়? কিংবা পোস্টার নাটক? প্রথম পথনাটকও কি শম্ভু মিত্রের সৃষ্টি?
সব মিলিয়ে বিভাবের ব্যাপ্তি অনেকখানি। ব্যক্তিগত ইচ্ছায় কারো বাড়িতে, বিশ্বকর্মা পূজার কোনো কারখানায় বিভাব অভিনয় করেছে বহুরূপী। শম্ভু মিত্র এখনো ‘ম্যাগ সায় সায়” পাননি, এখনো তিনি আর পাঁচজনেরই মতন।
ক্রমশ
দারুণ লেখা
স্মৃতি তোর অদম্য সহনশীলতায় আমরা আপ্লূত। তুই না থাকলে কো টাইপ করত, জানিনা।
দারুণ কমল দা, সেই কুড়ি বছর আগে ভরা বর্ষায় আপনার বাড়ি গেছিলাম। কি স্নেহ কি ভালোবাসা পেয়েছি। শুভ জন্মদিন। ভাল থাকবেন।
Tathya samridhya… Darun Laglo