শম্ভু মিত্র যাপনচিত্র | পর্ব – ১৬ | কমল সাহা

চার অধ্যায় – ১

উপন্যাস : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য — রচনা : কান্ডি , সিংহল ৫.৬.১৯৩৪ ; গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৩৪১ প্রথম সংস্করণ। প্রথম সংস্করণে প্রকাশিত ভূমিকা বা ‘আভাস’ : ‘তিনি ( ব্রহ্মবাদ্ধব উপাধ্যায়, সম্পাদক, Twentieth century মাসিক পত্র) ছিলেন রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসী, অপর পক্ষে, বৈদান্তিক — তেজস্বী, নির্ভীক, ত্যাগী, বহুপ্লুত ও অসামান্য প্রভাবশালী। শান্তিনিকেতন আশ্রমে বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠায় তাঁকেই আমার প্রধান সহযোগী পাই। …এমন সময় লর্ড কার্জন বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ-ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প হলেন। এই উপলক্ষে রাষ্ট্রক্ষেত্রে প্রথম হিন্দু-মুসলমান- বিচ্ছেদের রক্তবর্ণ রেখাপাত হ’ল। এই বিচ্ছেদ ক্রমশ আমাদের ভাষা সাহিত্য আমাদের সংস্কৃতিকে খণ্ডিত করবে, সমস্ত বাঙালি জাতকে কৃশ করে দেবে এই আশংকায় দেশকে প্রবল উদ্বেগে আলোড়িত করে দিল। বৈধ আন্দোলনের পন্থায় ফল দেখা গেল না। লর্ড মর্লি বললেন, যা স্থির হয়ে গেছে তাকে অস্থির করা চলবে না। সেই সময়ে দেশব্যাপী চিত্তমখনে যে আবর্ত আলোড়িত হয়ে উঠল তারই মধ্যে একদিন দেখলুম এই সন্ন্যাসী ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন। স্বয়ং বের করলেন ‘সন্ধ্যা’ কাগজ, তীব্র ভাষায় যে মদির রস ঢালতে লাগলেন তাতে সমস্ত দেশের রক্তে অগ্নিজ্বালা বইয়ে দিলে। বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর এতো বড়ো প্রচণ্ড পরিবর্তন আমার কল্পনার অতীত ছিল। এই সময়ে দীর্ঘকাল তাঁর সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। মনে করেছিলুম, হয়তো আমার সঙ্গে তাঁর রাষ্ট্র-আন্দোলন প্রণালীর প্রভেদ অনুভব করে আমার প্রতি তিনি বিমুখ হয়ে ছিলেন অবজ্ঞাবশতই।

নানা দিক থেকে নানা উৎপাতের উপসর্গ দেখা দিতে লাগল। সেই অন্ধ উন্মত্ততার দিনে… হঠাৎ এলেন উপাধ্যায়। …চৌকাঠ পর্যন্ত গিয়ে একবার মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘রবিবাবু, আমার খুব পতন হয়েছে।’ …গেলেন চলে। …কর্মজাল জড়িয়ে ধরেছে, নিষ্কৃতির উপায় ছিল না। …উপন্যাসের আরম্ভে এই ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য।’

বিভিন্ন সাময়িক পত্রে এই ‘আভাস’ নিয়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। ১৩৪২-এ বৈশাখ সংখ্যায় প্রবাসীতে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রত্যুত্তর।

চার অধ্যায় সম্পর্কে কবির কৈফিয়ত

‘আমার চার অধ্যায় গল্পটি সম্বন্ধে যত তর্ক ও আলোচনা উঠেছে তার অধিকাংশই সাহিত্য বিচারের বাইরে পড়ে গেছে। এটা স্বাভাবিক, কারণ, এই গল্পের যে ভূমিকা, যেটা রাষ্ট্র চেষ্টা আলোড়িত বর্তমান বাংলাদেশের আবেগের বর্ণে উজ্জ্বল করে রঞ্জিত। আমরা কেবল যে তার অত্যন্ত কাছে আছি তা নয় তার তাপ আমাদের মনে সর্বদাই বিকীরিত হচ্ছে। এই জন্যেই গল্পের চেয়ে গল্পের ভূমিকাটিই অনেক পাঠকের কাছে মূখ্যভাবে প্রতিভাত। এই অধুনাতন কালের চিত্ত-আন্দোলন দূর অতীতে সরে গিয়ে যখন ইতিহাসের উত্তাপবিহীন আলোচ্য বিষয় মাত্রে পরিণত হবে তখন … এর সাহিত্যরূপ স্পষ্ট হতে পারবে।…

যেটাকে এই ব‌ইয়ের একমাত্র আখ্যানবস্তু বলা যেতে পারে সেটা এলা ও অতীন্দ্রের ভালোবাসা। নর নারীর ভালোবাসার প্রতি ও প্রকৃতি কেবল যে নায়ক নায়িকার চরিত্রের বিশেষত্বের উপর নির্ভর করে তা নয়, চারিদিকের অবস্থার ঘাত প্রতিঘাতের উপরেও। বাইরের এই অবস্থা যেটা আমাদের রাষ্ট্র প্রচেষ্টার নানা সংগঠনে তৈরি, সেটার অনেকখানি অগত্যা আমার নিজের দৃষ্টিতে দেখা। …তার সংবেদন ভিন্ন লোকের কাছে ভিন্ন রকমের হ‌ওয়ার‌ই কথা।…

গল্পের উপক্রমণিকার উপাধ্যায়ের কথাটা কেন এলো এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই জিজ্ঞাস্য। অতীনের চরিত্রে দুটি ট্র্যাজেডি ঘটেছে, এক সে এলাকে পেল না, আর সে নিজের স্বভাব থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে। এই শেষোক্ত ব্যাপারটি স্বভাব বিশেষে মনস্তত্ত্ব হিসাবে বাস্তব হতে পারে, তারই সাক্ষ্য উপস্থিত করার লোভ সংবরণ করতে পারিনি। …একজন মহিলা আমাকে চিঠিতে জানিয়েছেন যে তাঁর মতে ইন্দ্রনাথের চরিত্রে উপাধ্যায়ের জীবনের বহিংশ প্রকাশ পেয়েছে আর অতীন্দ্রের চরিত্রে ব্যস্ত হয়েছে তার অন্তরের প্রকৃতি। এ কথাটি প্রণিধানযোগ্য সন্দেহ নেই। …অবশেষে সংক্ষেপে আমার মন্তব্যটি জানাই :  চার অধ্যায়ের রচনায় কোনো বিশেষ মত বা উপদেশ আছে কি না সে তর্ক সাহিত্য বিচারে অনাবশ্যক। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে এর মূল অবলম্বন কোনো আধুনিক বাঙালি নায়ক নায়িকার প্রেমের ইতিহাস। সেই প্রেমের নাট্যরসাত্মক বিশেষত্ব ঘটিয়েছে বাংলাদেশের বিপ্লব প্রচেষ্টার ভূমিকায়। এখানে সেই বিপ্লবের বর্ণনা-অংশ গৌণ মাত্র; এই বিপ্লবের ঝোড়ো আবহাওয়ায় দুজনের প্রেমের মধ্যে যে তীব্রতা, যে বেদনা এনেছে সেইটেতেই সাহিত্যের পরিচয়। তর্ক ও উপদেশের বিষয় সাময়িক পত্রের প্রবন্ধের উপকরণ।
৮ চৈত্র ১৩৪১

শম্ভু মিত্রের বক্তব্য

চার অধ্যায় অভিনয়ে প্রথম ও শেষ অধ্যায়ের শেষে একটু সুরের দরকার ছিলো যার শীর্ষবিন্দুতে ‘বন্দেমাতরম’ কথাটি জিগির দেওয়ার মত আসবে। সে সুর রচনা করে ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। এছাড়া আবহ সৃষ্টি করার জন্যে কখনো ঝড়ের শব্দ, কখনো কুকুরের ডাক, কখনো গির্জার ঘড়ির আওয়াজ ব্যবহার করা হয়েছিলো।  …এবং যেহেতু ‘চার অধ্যায়ের’ লেখক একজন অসাধারণ বুদ্ধিমান ও অসাধারণ দূর দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ তাই মহলা দিতে-দিতে ও অভিনয় করতে-করতে এর অনেক নিগূঢ় অর্থ আমাদের কাছে যেন স্পষ্ট হয়েছে।…

‘চার অধ্যায়’-এর মহলা শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই বোঝা গেল যে এর সংলাপ বলতে ততো অসুবিধে হচ্ছে না। সহজ কথা বলার মতোই বলে নেওয়া যাচ্ছে। এর একটা কারণ হতে পারে যে এর সংলাপের ভাষা খুব শহুরে।  তাই চার অধ্যায়কে নাটকিত করার সময়ে যখন একে কেটে ছেঁটে সাজানো হচ্ছিল তখনি এর চিন্তার ধারাটা, এর অনুভবের ধারাটা, জীবন্ত হয়ে বোধের মধ্যে আসছিল। …দৃশ্যসজ্জাও করা হয়েছিল আমাদের পূর্বাপর ধারা অনুযায়ী।  এ নাটকে অভিনয় করতে-করতে আরো অনেক কথা মনে হতে থাকে। ধর্মীয় উপলক্ষে আমাদের দেশে নানা জায়গায় নানা সেনা বসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ধর্ম বহু সময়েই মানুষকে মেলায় না। পৃথক করে। …তাই কবি বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ, বসন্তোৎসবের মতো seculer উৎসবের প্রচলন করেন। কিন্তু আমাদের সমাজ সেগুলো গ্রহণ করেনি। কিন্তু কবি যে এই চেষ্টা করেছিলেন এটা যেদিন হৃদয়ঙ্গম হলো সেদিন যে কী পরিমাণ অভিভূত হয়েছিলুম তা বলতে পারি না। কী মহৎ, লোক! …তেমনি ‘এলা’র ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দেখলাম — যে ক্ষেপণ করে, দূর করে। অর্থাৎ সে যে বার বার অতীনকে দূরে সরিয়ে দেয় — সেই চিন্তা থেকেই কি কবি তার নামকরণ করেছিলেন? কী জানি! এবং চার অধ্যায়ে পৌঁছুবার আগেই আমরা এটা তো বুঝতে পেরেছি যে রবীন্দ্রনাথ লোকটি আমাদের মতো লোকের চেয়ে হাজার গুণ বেশি বুদ্ধিমান। সুতরাং তাঁর সংলাপের সেই ধারালো বুদ্ধিটা যদি না বোঝাতে পারি লোককে, যদি সেই সংলাপ বুদ্ধিবর্জিত ‘কাব্যিক-কাব্যিক’ সুরে পড়ি, তাহলে নিজেদের যে-টুকুও বুদ্ধি আছে তার‌ও অপমান ঘটাই।

প্রথম দৃশ্য

সময় : সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা। জুন, ১৯৫১। স্থান : মিত্র দম্পতির বাসগৃহ তথা বহুরূপীর মহলা কক্ষ। পরিচালক প্রহর গুণছেন। মহর্ষি ঢুকলেন কয়েক সেকেন্ড দেরিতে। ( নাটকের শুরুতে উত্তেজিত পরিচালকের সংলাপে)

শম্ভু মিত্র – মহর্ষি, আমরা চার অধ্যায় করবো বলে মনে করছি।

মহর্ষি – চার অধ্যায়! ওটা তো উপন্যাস।

শম্ভু মিত্র – হ্যাঁ, সংলাপ প্রধান। নাট্যরূপ দিতে অসুবিধে হবে না।

মহর্ষি – রবীন্দ্রনাথের তো অনেক নাটক আছে। হঠাৎ উপন্যাসকে নাট্যরূপ দিয়ে…

শম্ভু মিত্র – সামাজিক কারণে।

মহর্ষি – এই কথাটা মুক্তধারা করার সময় মনে ছিল না কেন?

শম্ভু মিত্র – ওটা করেছি অন্যদের অনুরোধে, অন্যদের জন্যে। এবার করছি নিজেদের পছন্দ মতো, নিজেদের জন্যে।

মহর্ষি – হুঁ। ওটা করবে! ওটায় আবার নানারকম কথা চালু আছে…

শম্ভু মিত্র – বেশ তো, আপনি পড়ুন। পাণ্ডুলিপিটা পড়ে যদি আপনার মনে হয় যে করা উচিত নয়, তাহলে করবো না।

মহর্ষি – না, না করো। মনে যখন হয়েছে তখন করে দেখা যাক।

দ্বিতীয় দৃশ্য

( সময় : সকাল আটটা। পরদিন। মহর্ষির বসবার ঘর। শম্ভু মিত্র সেখানে হাজির হলো। )

শম্ভু মিত্র – ব‌ইটা পড়েছেন? কেমন লাগলো? করা যেতে পারে? এই সময়টায়?

মহর্ষি – একসঙ্গে এতোগুলি প্রশ্নের উত্তর দিই কীভাবে! বোসো —

শম্ভু মিত্র – না, মানে সারারাত্তির … একটা কী রকম যেন … বোঝাতে পারছি না…

মহর্ষি – পড়েছি। না হে, কোথাও কোনো ভুল কথা, বা অন্যায় কথা তো নেই। তবু—

শম্ভু মিত্র – তবু — কি —

মহর্ষি – তবু প্রথম যখন পড়েছিলাম তখন কেন যে মনে হয়েছিল! বোধ হয় চারিদিকে সকলে খুব বলছিল — তাতেই মনে একটা ইমপ্রেশন হয়ে গিয়েছিল। না না, করো, খুব করা যায়।

তৃতীয় দৃশ্য

স্থান : নিউ এম্পায়ার, গ্রীণরুম। চার অধ্যায় অভিনয় চলছে। হাউসফুল। পাব্লিক মন্ত্রমুগ্ধ। এলার মুখশ্রী কেউ দেখছে না, শুধু শুনছে। সবিতাব্রত ততোদিনে দল ছেড়ে চলে গেছেন। গীতার তীব্র আপত্তি। দিদির সঙ্গে অমন মাখামাখি প্রেমের দৃশ্য অসহনীয়। মঞ্চের বাইরে তখন এলা মানে গীতা, অতীন মানে সবিতাব্রত।

একটা দৃশ্যের পরে শম্ভু মিত্র মানে অতীন গ্রীণরুমে ঢুকে মেকআপ বদল করছেন। ইন্দ্রনাথ সেজেছেন মহর্ষি। রবীন্দ্রনাথের প্রণম্য মানুষ ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় হয়ে উঠেছে ইন্দ্রনাথ — অন্যদিকে মহর্ষির ভাবশিষ্য পুত্রবৎ শম্ভু মিত্র।

(মহর্ষি ঢুকলেন। হন্ত দন্ত হয়ে। চোখের শিরাগুলো উত্তেজনায় লাল হয়ে ফুটে উঠেছে, নিশ্বাস দ্রুত। অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবে —)

মহর্ষি – এ নাটক করে আমরা ভালো কাজ করেছি।

শম্ভু মিত্র – এখন নয়, শোয়ের শেষে বলুন —

মহর্ষি – না না, শম্ভু — খু-ব ভালো কাজ করেছি। এবার বার করা উচিত।

শম্ভু মিত্র – সবই আপনার আশীর্বাদ (প্রণাম করে )

মহর্ষি – আশীর্বাদ করার আমি কে? ওই যে অন্ধকারে অসংখ্য বিন্দুবৎ মুগ্ধ বিস্মিত মাথাগুলি — আশীর্বাদ দেবেন ওঁরা। ওঁরা আমাদের দর্শক — এঁরাই নারায়ণ।

সমাপ্তি দৃশ্য

এলা – সত্যি বলছ অন্তু, সত্যি?

অতীন – একটা খবর পেয়েছি আমরা —

এলা – কী খবর?

অতীন – আজ ভোর রাত্রে পুলিশ আসবে তোমাকে ধরতে।

এলা – নিশ্চিত জানতুম একদিন পুলিশ আমাকে ধরতে আসছে।

অতীন – কেমন করে জানলে?…

এলা – কিচ্ছু দরকার নেই অন্তু। আমার চৈতন্যের শেষ মুহূর্ত তুমিই নাও। ক্লোরোফরম এনেছে? দাও ওটাকে ফেলে। ভীরু নই আমি। জেগে থেকে যাতে মরি তোমার কোলে তাই করো। শেষ চুম্বন আজ অফুরান হল অন্তু। অন্তু!

( দূরের থেকে হুইসেলের শব্দ এলো। পর্দা পড়ে। যবনিকা )

ক্রমশ

2 thoughts on “শম্ভু মিত্র যাপনচিত্র | পর্ব – ১৬ | কমল সাহা

  1. স্বদেশীকতার স্বপ্নে বোনা চার অধ্যায় কবির জনপ্রিয় উপন্যাস থেকে নাট্যরসের যে আস্বাদন শম্ভু মিত্র মহাশয় পেয়েছিলেন তা এই গবেষণার পর্বে পর্বে পতা বর্নিত।

  2. কমল দা এখনো যেভবে লেখায় গবেষণায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন তা দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়। অত্যন্ত জরুরি লেখা। শুভেচ্ছা নিও দাদা।

Comments are closed.