শম্ভু মিত্র যাপনচিত্র | পর্ব – ১৮ | কমল সাহা

দশচক্র ১

প্রথম অভিনয় ১.৬.১৯৫২ শ্রীরঙ্গম।
মূল নাটক: হেনরিক ইবসেন রচিত অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল।
বঙ্গানুবাদ: শান্তি বসু।
নির্দেশনা: শম্ভু মিত্র।
প্রযোজনা: বহুরূপী।
মঞ্চ: অশোক মজুমদার।
আলো: তাপস সেন।
অভিনয়: অমলেন্দু গুহ: অমর গাঙ্গুলী, ড. পূর্ণেন্দু গুহ: শম্ভু মিত্র, রাধানাথ নন্দী: গঙ্গাপদ বসু, কালীকিংকর: মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, অরুণ: অনলাভ দত্ত, বরুণ: অঞ্জলাভ দত্ত, কেষ্ট: পরেশ ঘোষ, ধ্রুব: নির্মল চ্যাটার্জী, করুণাকিরণ: ব্রজ চক্রবর্তী / কুমার রায়, সমরেশ: সবিতাব্রত দত্ত / মহম্মদ জ্যাকেরিয়া, মঞ্জু: তৃপ্তি মিত্র / কল্যাণী দত্ত, হৈম: সাজেদা আসাদ / তৃপ্তি মিত্র।

(বিশেষ কারণে প্রথম ২ টি অভিনয়ে মঞ্জু সাজেন তৃপ্তি মিত্র)

নব পর্যায়ে প্রথম অভিনয়: ২৮.১০.১৯৬২ নিউ এম্পায়ার।
মঞ্চ: অনিল ব্যানার্জী
আলো: কালীপ্রসাদ ঘোষ।
মঞ্চ: আরতি কুন্ডু / শাঁওলী মিত্র
অভিনয়: অমলেন্দু গুহ: অমর গাঙ্গুলী, ড. পূর্ণেন্দু গুহ: শম্ভু মিত্র, রাধানাথ নন্দী: গঙ্গাপদ বসু / কুমার রায়, কালীকিংকর: সুনীল সরকার, অরুণ: জহর মুখার্জী, বরুণ: রমাপ্রসাদ বণিক, কেষ্ট: রামপদ চ্যাটার্জী, ধ্রুব: হিমাংশু চ্যাটার্জী / মুকুন্দ দাস, করুণাকিরণ: কুমার রায় / দেবতোষ ঘোষ, সমরেশ: অরুণ মুখার্জী / শান্তি দাস, হৈম: ললিকা বসু / রমলা রায়।
অন্যান্য ।। অঞ্জন সিংহ / অনিল ব্যানার্জী /অমল গুহ / দিলীপ মজুমদার / দেবতোষ ঘোষ / দেবব্রত মুখার্জী / বলাই গুপ্ত / বিশ্বনাথ মিত্র / মুকুন্দ দাস / রমেণ রায় / রণেন ঘোষাল / রাজেন মুখার্জী / শিবশংকর মুখার্জী / সুখেন চক্রবর্তী / সমীর চক্রবর্তী /হেসেন মুখার্জী।
(দশ বছরের মধ্যে সব চরিত্র বদলে গেল। র‌ইলেন নিজের চরিত্রে অমর গাঙ্গুলী আর শম্ভু মিত্র। প্রথম পর্বে তৃপ্তি মিত্র। কখনো স্ত্রী, কখনো মেয়ে। সমরেশ চারজন। হৈম এবং মঞ্জুও চারজন। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১২টি চরিত্রের সঙ্গে অন্যান্য ভূমিকার ১৬ জন! ভীড়ের দৃশ্য? জনসভার? প্রথম পর্বে এঁরা কারা? অরুণ-বরুণ দুই ভাই – অনলাভ-অঞ্জলাভ দুই ভাই। গালিলেওর জীবনের মতোই মঞ্চেও বাবা ও মেয়ের ভূমিকায় শম্ভু মিত্র-শাঁওলী মিত্র।)

দশচক্র ২

বহুরূপীতে দশচক্র‌ই বাঙালি পোশাকে প্রথম বিদেশী নাটক। পৃথিবীর তাবৎ নাট্য সম্ভারের আমরা উত্তর সাধক। আত্মোন্নয়নের প্রথমায়োজনে বিচিত্র রত্ন সম্ভার আহরণ করে নিজেদের সৃষ্টি সাধন আমরা কর্তব্য বলে মনে করি। বাস্তববাদী থিয়েটারের জনক ইবসেনের নাটক পাশ্চাত্য দেশে যে ধরনের অত্যন্ত বাস্তবঘেঁষা মঞ্চসজ্জার সাহায্যে পরিবেশিত হয়ে থাকে, তাকে অনুকরণ না করে আমরা এমন দেশীয় নাট্য পদ্ধতি আবিষ্কার করবার চেষ্টা করেছি যাতে এই নাটকের ভাবসত্য ও নাটকীয় সচলতা বিন্দুমাত্র ব্যাহত না হতে পারে।

ড. পূর্ণেন্দু গুহ সমাজের দেহে এক ক্ষুদ্র আবিষ্কার করেছেন। সরল বিশ্বাসে তিনি আশা করে ছিলেন, সমাজের সকলেই এর প্রতিকারে তাঁকে সাহায্য করবেন। কিন্তু প্রথমেই বাধা আসে কর্তা ব্যক্তিদের কাছ থেকে। তিনি ভাবলেন, এই কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উদারনৈতিক এবং প্রগতিবাদী দলের লোকেরা আছেন। কিন্তু কী এক গূঢ় প্রক্রিয়ায় সমাজের সবচেয়ে প্রগতিবাদী এবং সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল – উভয় পক্ষ‌ই হঠাৎ পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলাতে পারেন! তখন সেই মানুষটির একটি মাত্র আশাই অবশিষ্ট র‌ইল — কোনো রকমে জনসাধারণের কাছে তাঁর কথা পৌঁছে দেয়া। কিন্তু আধুনিক প্রচার যন্ত্রের ক্ষমতা এত ব্যাপক এবং জটিল যে, সাধারণ লোকের বুদ্ধিকে গুলিয়ে দিতে তার দেরি হলো না। এ ক্ষেত্রেও তাই-ই ঘটলো।

এবার এই একলা নিঃসহায় মানুষ কোন্ দেবতার কাছে দাঁড়াবে? কোন্ নিরিখে সে জানবে কোন্‌টা ঠিক, আর কোন্‌টা ভুল? কোন নিকাষ যাচাই হবে সত্যাসত্য? ব্যক্তিগত মানুষ কি সমষ্টির চিন্তার স্রোতে গা ভাসিয়েই সকল সময়ে নিশ্চিন্ত বোধ করবে? এই ভাবনার গুরুত্ব অনেক। বিশেষ করে আজ আমাদের দেশে যে-কালে গণতন্ত্রের গভীরে না গিয়ে আবরণটুকু আশ্রয় করে সে সুবিধাবাদের জন্ম হয়েছে, তা কি ব্যক্তিকেন্দ্রিক, কি সামাজিক, কি রাজনৈতিক–সর্বক্ষেত্রেই ভয়াবহরূপে প্রকট। ব্যক্তিগত মানুষ ও সমাজগত মানুষের সম্পর্কের এই দ্বন্দ্বে আমরা উৎকন্ঠিত।

প্রগতির চাকা সদাসর্বদা সরলরেখায় চলমান নয়। তখন আত্মধর্ম আর সত্যের সম্মান বাঁচাতে কখনো কখনো মানুষকে সমষ্টি থেকে একলা হতে হয়। সেই একক ধর্মযোদ্ধা তখন সোজা হয়ে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ায় অনেক প্রচলিত ক্ষয়ে যাওয়া সত্যকে ফেলে। অনেক ঘূণে ধরা তত্ত্বকে ভেঙে নিজের স্বার্থকতার পথ বেছে নেয়। এর জটিলতা আমাদের উদ্বিগ্ন করে, এর উপসংহার আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।…

দশচক্র ৩

নরওয়ের নাট্যকার হেনরিক ইবসেন, জন্ম ১৮২৮, মৃত্যু ১৯০৬। অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল-এর রচনা কাল ১৮৮২; তাঁর স্বদেশের আর্দশ সমাজ গঠনের ভাবনা নিয়ে এই নাটক। তাঁকে আধুনিক থিয়েটারের জনক বলা হয়। সমকালের সমাজ ও জীবন নিয়ে বাস্তববাদী নাট্যকার। স্বাধীনতার ৫ বছর বাদে, দেশ গঠনের কাজে নিমগ্ন একজন ভালোমানুষ বারবার কীভাবে নানা চক্রান্তের জালে জড়িয়ে পড়ছেন— কীভাবে কম্যুনিস্ট পার্টি বারবার জাতীয় নেতাদের দেশ গঠনে বাধা দিচ্ছে (?) এই ব্যাপারে কটাক্ষ করার অভিপ্রায়ে শম্ভু মিত্র বেছে নিলেন ইবসেনের এই কাহিনি। বলা বাহুল্য, গণনাট্যের আর্দশ চ্যুতি এবং মানুষের মূল্যবোধের অভাব প্রচন্ড নাড়া দিয়েছিল বহুরূপী তথা আমাদের আলাদা মানুষটিকে। বিপুল জনসাধারণের মধ্যে না গিয়ে একলা এক বৈজ্ঞানিক মানুষের মঙ্গলব্রতে নিমগ্ন থাকবেন; লড়াই করবেন একা; যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে— তবে একলা চলো রে! যেন পৃথিবীটা ভরে গেছে শুধু খারাপ মানুষের ভীড়ে— ভালো মানুষ একা ড. পূর্ণেন্দু গুহ!

এই ভাবনাটিকে আত্মঘাতী মনীষা বলা যেতে পারে। বিশ্ব‌ ইতিহাসে অনেক সংগ্রামী মানুষকে স‌ইতে হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন, তীব্রতম বাধা বিপত্তি। সক্রেটিস বিষপানে বাধ্য হয়ে ছিলেন; জোয়ান অব আর্ককে পুড়িয়ে মারা হয়েছে; বন্দী করা হয়েছে গালিলেও কে কেন! কিন্তু এঁরা লড়াই থামাননি। মরে গেছেন কিন্তু লড়াই বন্ধ হয় নি। কেউ বলেন নি— মানুষের সমর্থন না পেলে আমি একাই পথ চলবো! বরং এঁদের সংগ্রাম স্মরণীয় হয়ে উঠেছে বিপুল জনসাধারণের স্পন্দিত সমর্থনে। ২৭ বছর জেলে বন্দী থাকার পর নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হয়েছেন! আর ড.পূর্ণেন্দু গুহ অস্বীকার করছেন জনশক্তির অবদান! ‘সমকালীন জীবনের আগুন আহরণ করে সেই আগুনে আমরা নিজেদের দগ্ধ করি। কেউ কেউ হাউই-এর মতো পারে আকাশের বিমান উচ্চতায় উঠে যেতে। আবার অনেকেই পারি না। সমস্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়েও মাটির ওপরেই জ্বলি। জ্বলি, আর একদিন ফুরিয়ে যাই।
(শম্ভু মিত্র/ক্ষণস্থায়ী, তবু –/১৯৫২ )

অনেক বছর বাদে সত্যজিৎ রায় এই কাহিনি নিয়েই গড়বেন গণশত্রু। গণশত্রু কারা? ক্ষণস্থায়ী নাট্যকর্মী না কি জনগণ নিজেরাই! এ প্রশ্ন অনন্তকালের, সকলের জানা দরকার এর সঠিক উত্তর।

দশচক্র ৪

গণনাট্য পত্রিকায় জানুয়ারি ১৯৫৩ দশচক্র নাটকের সমালোচনা লিখলেন দিলীপ চৌধুরী:… ‘প্রযোজনা পরিচালক ও রূপায়নে শিল্পগত নৈপুণ্যের ক্ষেত্রে বহুরূপীর ‘দশচক্র’ যে বাংলা নাট্যজগতে একটি বিরাট স্বার্থকতার বার্তা বহুল করে আনলো তা অনস্বীকার্য।… এ যুগের জন সাধারণ সম্পর্কে এখানে একটা ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টির আকাশে কি রয়ে গেল না? যে জনতা ডাক্তারের সভা পণ্ড করলো তারাই কি বৃহত্তর জনমানবের প্রতীক? তারা কি তাদের স্বার্থ সম্পর্কে এতোই অচেতন আর উদাসীন? মধ্যবিত্তের ঘাড়ে ‘বারবার অভিসম্পাত করেই ক্ষান্ত হ‌ওয়াটা প্রগতিশীল নাট্য নির্দেশের সহযোগী হতে পারে কতটুকু তাও বোধ হয় বিচার্য। …

অতীত অবদানের মধ্যে ছেঁড়াতারের অভূতপূর্ব সাফল্যের পর এঁদের সাম্প্রতিক নাটক দশচক্র-এ আংশিক ক্রুটি বিচ্যুতি থাকা মঞ্চেও অভিনয় এবং রুচিগত উৎকর্ষে সমুত্তীর্ণ। অনাড়স্বর আয়োজনের মধ্যে অতি সামান্য মঞ্চসজ্জা ও ব্যবস্থার সাহায্যে এতো স্বার্থক নাট্যরূপ বহুদিন বাঙলার জনসমাজের চোখে পড়েনি।…’

বারবার মনে পড়ছে সেই অন্ধকারে জনসভার দৃশ্যটা। সমস্ত শরীর জুড়ে একটা প্রচন্ড শিহরণ— বোধের শেকড়ে একটা তীব্র আঘাত— তিনি অবলীলায় বলে যাচ্ছেন, তাঁর অনবদ্য কষ্টে সেই সব অমানবিক একটি সংলাপ! তিনি গণনাট্যে যোগ দিয়েছিলেন ফ্যাসিস্ত ছিলেন না বলে— এবার গণনাট্য ছেড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ওই সব সস্তা প্রগতি বুলিতে জনগণকে বোকা বানাতে তিনি রাজী নন! অসম্ভব দুঃখ পেয়েছি— রাগ হয়েছিল তাঁর ওপর। আমাদের সবচেয়ে বড় বিপদ, তিনি মানুষকে তাঁর যাদুবিদ্যায় নিজের কথাটা শুনিয়ে দিতে পারেন অমোঘ ভাবে। সুস্থ চিন্তাকে বিপথে পরিচালিত করার ভয়ংকর শক্তি তাঁর ছিল। ভঙ্গির সৌন্দর্যে ভুলিয়ে দিতেন যুক্তির গভীরতা।

দেশ স্বাধীন হয়েছে। গণতন্ত্র শুরু হয়েছে‌। এখন তোমার কর্তব্য কি? ড. পূর্ণেন্দু গুহ অনেক রকম পাবলিককে গত ৬ মাস ধরে তাঁরা বিদ্রোহী– বুঝতে পারছেন না ভালো মন্দের পার্থক্য। আপনারা শান্ত হোন। ভিন্ন পথ নেই। দরকার সেই রাশিয়া কিংবা চীন থেকে নেতৃত্ব আমদানি করার!

ক্রমশ…