[বহুরূপীর পথপ্রদর্শক, স্রষ্টা তথা বাংলা থিয়েটারের সৃজনশীল নাট্যব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র। রবীন্দ্র থিয়েটারের অজেয় স্বপ্নকে বাস্তবের ধরাধামে প্রস্ফুটিত করেছেন তিনিই। তাঁকে নিয়ে আজ পর্যন্ত, কন্যা শাঁওলী মিত্র ছাড়া তেমনভাবে কেউ তাঁর জীবনচিত্রচর্চা করেননি বলে আমাদের ধারণা। স্বয়ং শম্ভু মিত্র নিজেও আত্মজীবনী লেখেননি! ‘সন্মার্গ সপর্যা’ নামে বিক্ষিপ্ত কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন আর কয়েকটি বই শুধুমাত্র। বর্তমান প্রজন্মের নাট্যকর্মীদের সঙ্গে আদ্যান্ত পরিচয় করাতেই আমাদের এই প্রয়াস। ‘শম্ভু মিত্র যাপনচিত্র’ অমল আলো জার্নালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে পারব, এই ভেবে আমরা আনন্দিত, গর্বিত। আমাদের আশা, শম্ভু মিত্রের সমগ্র জীবনকে ঘিরে ‘শম্ভু মিত্র যাপনচিত্র’ থেকে অজানাকে জেনে নিয়ে থিয়েটার সমৃদ্ধ হবে, আমরাও উপকৃত হব।
এই পর্ব থেকে ছেলেবেলা-১ শুরু হল।
লেখকের সম্পূর্ণ লেখা অসম্পাদিত রেখে টাইপ হয়েছে। তাই কোথাও তথ্যে কোনও অসঙ্গতি থাকলে সে দায় সম্পাদকের নয়। বিনীত: সম্পাদক]
ছেলেবেলা: ১৯১৫-৩৮
‘ছেলেবেলার কথা— মানে আমি জন্মেছি কলকাতায়। এই দক্ষিণ কলকাতাতেই, ডোভার লেন বলে একটা রাস্তা যাচ্ছে, সেইখানেই একটা বাড়ি ছিল আমার মায়ের…’ (শ. মি.)
শম্ভু মিত্রের জন্ম ২২.৮.১৯১৫ মামাবাড়িতে। বাবা শরৎকুমার মিত্র, মা শতদলবাসিনী দেবী। এঁরা তিন ভাই এক বোন। শম্ভু মিত্রের নিজের দাদা এবং দিদি কিনা জানা যায়নি। সম্পর্ক খুবই নিবিড় ছিল। শরৎকুমারের দুই ছেলে— শম্ভু আর শংকর। শিবঠাকুরের নামে দুই ছেলে। অনেক বছর বাদে এই বড়টি হয়ে উঠবেন ‘শিবের সাধক’— লিখবে একটা অসাধারণ নাটক— ‘চাঁদ বণিকের পালা’। এ পালায় বারবার ফুটে উঠবে আত্মজৈবনিক হাহাকার।
‘শিব তারে বাঁচালো না সদুদ্দেশ্যে বাঁচালো না আপন কর্মের প্রতি নিষ্ঠা তারে বাঁচালো না, কোথা যে কি ভুল হলো জানে না আবর। এইবার কিবা করে চাঁদ সদাগর।’
আমরা শুরু করছি আরও এক চাঁদ সদাগরের জীবনকাহিনি। বেশ দীর্ঘ এবং বিতর্কিত এই জীবন। সদুদ্দেশ্য নিয়ে আত্মমগ্ন এক সৃজনশীল মানুষ, নিজের কর্মের প্রতি চূড়ান্ত নিষ্ঠাবান তবুও বারবার তীব্র আক্রান্ত। যাঁরা তাঁর কাছের লোক হবেন তাঁরাও আড়ালে কিংবা প্রকাশ্যে প্রচার করবেন কটু সমালোচনা। ব্যতিক্রমী এই মানুষটিকে ভুল বুঝবেন সাধারণ মানুষ, তাঁর বন্ধুরাও। আর তিনি বারবার আক্ষেপ করবেন, ‘কোথা থেকে যে কি ভুল হলো জানে না আবর!’
আমরা ভাগ্য, নিয়তি, ভগবান বিশ্বাস করি না। এড়িয়ে চলি এইসব অবান্তর শব্দ। তিনি বিশ্বাস করেন। বারবার ‘দুর্ভাগ্যের’ অমোঘ বিধানে, ‘নিয়তির’ সর্বনাশা ‘অভিশাপে’ তিনি রাজা হয়েও অউদিপাউসের মত বিপর্যস্ত, সদাগর হয়েও চাঁদের মত শান্ত! আমরা এই দীর্ঘ জীবন জুড়ে খুঁজে বেড়াব ভুল আর নির্ভুলের অভিঘাত, সৃষ্টি আর নির্মাণের আয়োজনে ব্যাপৃত এক অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষের বিবর্তন এবং নানা স্তর। তিনি প্রায় শতাধিক নাট্যনিবন্ধে নিজের জীবনবৃত্তান্ত এড়িয়ে গেছেন। আমরা তাঁর সাক্ষাৎকার, নানাজনের লেখালেখি এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে এই ছেলেবেলা পর্বটি নির্মাণ করেছি। যৌবনকালের মতই বাল্যকাল অজস্র শিহরণের ইতিহাস। এই পর্বের সময়সীমা: ১৯১৫-৩৮।
শম্ভু মিত্রের দাদা ফোটোগ্রাফিতে মগ্ন ছিলেন, ছিলেন বাক্শক্তিরহিত। বাইরের মানুষ জানতেন এঁরা আপন ভাই। বটুকদা (ছদ্মনাম, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র) বয়সে বড় হলেও সেজদা বলে ডাকতেন, এমনকি কলিম শরাফীও ডাকতেন সেজদা। পরে আর সবাই শম্ভুদা। ব্যক্তিত্বের প্রখর উচ্চতায় তিনি শম্ভুবাবু বলেই বেশি সম্বোধিত। শম্ভুদা বলতেন খুব কাছের কয়েকজন। আরও এক দাদা ছিলেন তাঁর, জ্যোতিদাদা। এঁর প্রসঙ্গ পরে।
ছোটভাই শংকর, তাঁর স্ত্রী এবং তিনি নিজে জীবনের শেষ পর্বে থাকবেন জ্যোতিষ রায় রোডে শাঁওলীর ছোট্ট ‘বৃদ্ধাশ্রমে’। মেয়েটি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন বাবা-কাকা-কাকিমাকে সেবাযত্ন এবং সুখশান্তি দেবার। যেদিন মধ্যরাতে তিনি প্রয়াত হবেন, ঘুম থেকে শাঁওলী ডেকে তুলবেন কাকা-কাকিমাকে। তাঁরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক চেয়ে থাকবেন কয়েক মুহূর্ত। শংকরবাবু কোনও কথা বলতে পারবেন না। দাদার মৃত্যুতে চিৎকার করে কাঁদতেও বারণ, শোক নিয়ে চেঁচামেচি তিনি পছন্দ করতেন না। নীরবে শেষবার প্রণতি জানিয়ে শুয়ে পড়বেন নিজের ঘরে গিয়ে। গোপন, রহস্যময় শোকযাত্রায় অংশ নেবার শারীরিক ও মানসিক শক্তি থাকবে না এই ছোটভাইয়ের। এঁদের কোনও অন্তরঙ্গ স্মৃতিচিত্র মিলছে না শম্ভু মিত্রের লেখালেখিতে।
বাবা শরৎকুমার মধ্যবিত্ত সাধারণ বাঙালি। আজীবন চাকরি করে গেছেন। বেশ উদারপন্থী মানুষ। সংসার পেতেছিলেন ভবানীপুরে, চক্রবেড়িয়া অঞ্চলে। সেইখানেই শম্ভু-শংকরের বাল্যকাল কেটেছে। অনাড়ম্বর, আরও পাঁচটা মধ্যবিত্ত সংসারের মতই ছোট্ট সুখের পৃথিবী ছিল তাঁর। হঠাৎ প্রয়াত হন শতদলবাসিনী দেবী। তখনকার দিনে এ অবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহ অনিবার্য ও স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু শরৎকুমার তা করেননি। দুই ছেলেকে আরও শক্ত করে বুকে চেপে ধরেছেন। তিনিও ছিলেন যথেষ্ট আধুনিক মানুষ। মাতৃহীন শম্ভু বাবার অতিরিক্ত স্নেহের প্রশয় পেয়ে শিশুকাল থেকেই বেশ জেদি এবং একরোখা হয়ে ওঠে। নিজেই যেন নিজের অভিভাবক। একেবারে স্বাধীন— প্রচণ্ড আত্মব্রতী, আত্মনির্ভর এবং আত্মপ্রত্যয়ী। একবার যেটা ‘না’ বলবে, ‘হ্যাঁ’ করাবার সাধ্য নেই কারও। আত্মম্ভরিতার প্রস্তুতি চলছে। চলছে নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ। অনেক বছর বাদে লোকে বলবে, শম্ভু মিত্র মানুষ, বড় মাপের মানুষ— প্রচণ্ড ইগোসর্বস্ব, অহংকারী এবং আত্মকেন্দ্রিক। এই সব বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে তাঁর কন্যার রচনায়, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আমরা দেখব, তিনি শুধু এক ব্যতিক্রমী মানুষ। প্রবল প্রতিভাবান। অহংকার করার মত অনেক কাজ তিনি করবেন। ইগো-সর্বস্ব ছিলেন না কোনওদিনই। আর তাঁর মনন জুড়ে ছিল তীব্রতর এক দ্বিধা— রাজনৈতিক চেতনা আর শিল্পবোধের দ্বন্দ্ব। গণনাট্য না বলে নবনাট্য, সৎনাট্যের ব্যাখ্যা। এই মানুষটির কেন্দ্রে ছিল তাঁর দেশ। দেশকে ভালবেসেছিলেন অনেকের চেয়ে বেশি। তাঁর কতটা অহংকার ছিল হিসেব করার আগে তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ভারত নাট্যক্ষেত্রের অহংকার। প্রতিভাবান মানুষজন অনেকরকম স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনা করেন। শম্ভু মিত্রকে বলা যায় একেবারে মানুষ। আলাদা তাঁর পৃথিবী, আলাদা তাঁর স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের আর্তি। তাই আজীবন তিনি অন্ধকারের আরাধক, একক সংগ্রামে বিশ্বাসী। ছোটখাটো বাস্তবের যুক্তিতে বিশ্লেষণ করতে গেলে এ মানুষটাকে চেনা যাবে না কিছুতেই। দুঃখী এবং একা মানুষ। নৈরাজ্যের অন্ধকারে কেবলই হাহাকার আর আক্ষেপ। ছেলেবেলার অসংলগ্ন দিনগুলি ঘুরেফিরে যন্ত্রণা দিয়েছে সমগ্র জীবন আর তিনি শুধু মগ্ন ছিলেন অজস্র অভিনব গ্রন্থপাঠে, জ্ঞানের তপস্যায়, সৃজনের সাধনায়। বিষাদের ঘোর কাটেনি কোনওদিনই। সামান্য আঘাতেও মর্মাহত হয়েছেন অনেক বেশি— অনুভবে বারবার বেদনার সুর—
‘ঘূর্ণাচক্রে ঘুরে ঘুরে মরে
স্তরে স্তরে
সূর্যচন্দ্রতারা যত
বুদবুদের মতো।’
‘লেখাপড়া করতুম আমরা ওই বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে। স্কুলটি যখন প্রথম শুরু হয়, তখন আমরা ওইখানে ছাত্র। তা তখন আমাদের ফোর্থ ক্লাস বলা হ’ত… ক্লাস সেভেন হবে বোধহয় সেটা… প্রাইজ ডিষ্ট্রিবিউশন, না প্রথম বছরে কী একটা ওইরকম উৎসবে, আমাকে দিয়ে একটা ইংরেজি কবিতা বলানো হয়… আমার যদ্দুর মনে আছে, ‘I am a little soldier’ এইরকম গোছের একটা কবিতা ছিল।’
এই ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করেই শম্ভু মিত্রের হাতেখড়ি হল। এরপর তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠবেন শুধু আবৃত্তির জন্যেই। প্রচুর রেকর্ড, প্রচুর ক্যাসেট। ‘মধুবংশীর গলি’ তো কিংবদন্তী কাব্যপাঠ। বাংলাদেশে আজ যে আবৃত্তির এত চর্চা এত অনুষ্ঠান এরও জনক শম্ভু মিত্র মহাশয়। তিনিই সর্বপ্রথম কবিতা কীভাবে পড়তে হয়— আবৃত্তি কাকে বলে শিখিয়েছিলেন। পুরনো রেকর্ডে রবীন্দ্রকণ্ঠে আবৃত্তি শুনেছি আমরা। দুর্লভ, শুধু রবীন্দ্রকণ্ঠের সম্পদ— আবৃত্তি বলা যায় না কিছুতেই। জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একেবারে নবীন কবিদের কবিতা তিনি পড়েননি কোনওদিন। ব্যতিক্রম জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র। বটুকদাকে বিখ্যাত করেছিলেন ওই একটা কবিতার আবৃত্তি দিয়েই। স্কুলের পড়া বাদেও প্রচুর পড়তেন তিনি। সবরকমের সাহিত্য। এই যে এক খুদে সৈনিক ইংরেজি কবিতা পড়ে গেল, ১২/১৩ বছরের বালক— সাহিত্যপাঠের অভ্যেস না থাকলে তা সম্ভব ছিল না। আমরা ধরে নিতে পারি বাড়িতে সেকালে পত্রপত্রিকা রাখা হত। শরৎকুমার সাহিত্যের লুব্ধ পাঠক না হলেও অরসিক ছিলেন না। মননচর্চার পরিবেশ ছিল তাঁর সংসারে।
এবার আমরা এক অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা বলতে চাই। এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় শম্ভু মিত্র বলে ফেললেন— মাত্র ৭ বছর বয়সেই ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটি পড়ে ফেলেছেন তিনি! শ্রোতারা বিস্মিত, হতচকিত, চমকিত। যখন যুক্তাক্ষর শেখার বয়সও নয়— সেই সময় নিখিলেশ-বিমলা-সন্দীপের ত্রিকোণ প্রেমের জটিল উপন্যাসটা পড়ে ফেলা! পত্রিকায় মাঝে মাঝে দু-একটা মেধাবী শিশুদের সংবাদ দেখি, আমাদের শম্ভুও কি তাই?
এ ঘটনা বিশ্বাস করা কঠিন। আমরা ছাপার অক্ষরে পেয়েছি। শাঁওলী কোনও প্রতিবাদও জানাননি। সুতরাং ঘটনা সত্যিই হবে হয়তো! ব্যাপারটা বেশ আজগুবি কিন্তু। ৭ বছরের শিশু ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস পড়েছে এ সংবাদ রবীন্দ্রনাথ শুনলে কী খুশীই না হতেন!
এইরকমই আরও অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা লিখেছেন শাঁওলী। তার সাড়ে তিন বছর বয়সের স্মৃতিকথা। চারটে রাস্তা পেরিয়ে দোকানে পৌঁছে যাওয়া— পার্কসার্কাস অঞ্চলে। মেয়েকে সাবলম্বী করার ট্রেনিং দিয়েছেন এই শম্ভুবাবু, এইসব বৃত্তান্ত যথেষ্ট রোমহর্ষক। গাছটা কীরকম ফল দেবে তার উজ্জ্বল প্রমাণ। শিশুরাই তো জাতির ভবিষ্যৎ। দেশের মেরুদণ্ড! তো সেই সচকিত শ্রোতাদের অবিশ্বাসী চোখদুটিকে আরও বিস্ফারিত করেছিলেন সেদিন শম্ভুবাবু; একেবারে জীবনের শেষদিকে প্রশ্ন করেছিলেন শ্রোতাকে: সন্দীপ কেন ফুল রাখে ঘটিতে? সে তো ইচ্ছে করলেই ফুলদানিতে রাখতে পারত, যেমন সবাই রাখে?
এইরকম জটিল আর গভীর তাঁর অনুসন্ধান। একটা প্রশ্ন করলে দশটা প্রশ্ন দিয়ে বিব্রত করার প্রবণতা। আপনার দশচক্র খুব ভাল লেগেছে। কেন ভাল লেগেছে? আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। কেন? আপনি আমার প্রিয়তম নাট্যশিল্পী— আপনাকে প্রণাম করতে চাই। কেন, কেন আমি প্রিয়তম? প্রিয়তমকে কেন প্রণাম করবেন আপনি? আর কতটুকু জেনেছেন? কেন দেখা করবেন? কেন?
অনেকেই এটাকে অহংকার মনে করতে পারেন। আসলে এইরকমই অজস্র ‘কে ‘ জুড়ে জুড়ে মানবমনের আর জীবনের যাবতীয় অনুভবের স্তর বুঝবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ‘নাটক রক্তকরবী’ বইটা পড়লে তা বোঝা যায়। সমস্ত কিছুর গভীর শেকড়ে চলে যেতে চাইতেন তিনি খুব শিশুকাল থেকেই। আমরা জানি ওইরকম বিশ্লেষণ আর তীব্র অনুসন্ধান পর্ব চলেছে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। বিশ্বের যাবতীয় বিষয়… পিরামিডে মিশরীয় শিল্প-সভ্যতা… বৌদ্ধ ধর্ম… চিকিৎসাবিজ্ঞান সব কিছু জানতে হবে। সব কিছু।
রবীন্দ্রনাথ ধারাবাহিকভাবে লিখছিলেন ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস ১৯১৫-১৬ সালে, ‘সবুজপত্র’-তে। স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এক নারীকে কেন্দ্র করে রচিত হচ্ছে দুইজন পুরুষের হৃদয়ঘটিত সংঘাত… মুদ্রিত হয়ে চলেছে ব্যক্তিগত জীবনতৃষ্ণার সঙ্গে স্বদেশপ্রেমের আকুতি… ঠিক এই রচনাকর্মের মধ্যপথে জন্মালেন আমাদের শম্ভু মিত্র। ৭ বছর বয়সেই পড়ে ফেললেন কিন্তু বহুরূপী যখন ‘ঘরে-বাইরে’ প্রযোজনা করবে তখন তিনি এতে অংশ নেবেন না। নেপথ্যে নয়— প্রকাশ্যে তো নয়ই। মাত্র ৫৬ বছর বয়সেই অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত। নির্দেশনা, আর নয়। বিমলা সাজবেন তাঁর মেয়ে, নাট্যরূপ নির্দেশনায় তাঁর স্ত্রী, তিনি শুধু পরামর্শ দেবেন, বোঝাবেন— ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটা কীরকম। আসলে, ব্যক্তিগত জীবনেও, তাঁর ঘরে-বাইরে তখন চূড়ান্ত সংকট। অথচ কবিদের অক্ষয়যৌবন। ৫৪ বছর বয়সেও সন্দীপের টানটান সংলাপ লিখছেন রবীন্দ্রনাথ।
আর ওই ঘটি এবং ফুলদানির বিশ্লেষণ? সত্যজিৎ রায় যেমন প্রতিটি দৃশ্য তুলবার আগে বংশী চন্দ্রগুপ্তকে সেটের ডিটেলস নিয়ে টেনশনে ফেলতেন, যেমন সতর্ক ছিলেন সন্দীপের দাঁতে সিগারেটের প্যাকেট নিয়েও তেমনই মঞ্চস্থাপত্য এবং আহার্যের বিষয়ে, প্রতিটি বস্তুর প্রতি গভীর জিজ্ঞাসা নিয়ে নির্দেশনার কাজ করেছেন তিনি। এরকম অজস্র স্মরণীয় উদাহরণ আছে।
‘ঘরে বাইরে’ নাটকটা দেখেছি। ফুলগুলি কীরকম পাত্রে দিল সেটা নজরে পড়েনি।
যাইহোক, ‘কিছু মাস্টারমশাইদের ভাল লাগার দরুণ তার পরের বছর (১৯২৮-২৯) প্রাইজ ডিষ্ট্রিবিউশন সেরিমনিতে আমাকে একটা ইংরেজী গদ্য পড়তে হয়। সেটারও নাম মনে নেই। তবে যদ্দুর মনে আছে সামনে শুরুর লাইনে ছিল, My name is Solomon Snowham, I eat, drink and sleep. মানে একটা লোক, সে এছাড়া আর কিছু করতে ভালোবাসেনা, আর এই খেতে-দেতে, ঘুমুতেই তার সারাদিন কেটে যায়। এরই কাহিনি সে বর্ণনা করে। এটা আমায় শিখিয়েছিলেন কে.ডি. ঘোষ। তখন ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের প্রফেসর ছিলেন।… তা সেটারও বোধহয় একটু সুখ্যাতি-টুখ্যাতি হয়েছিল।’
সুখ্যাতির কারণটাও মনে আছে তাঁর। সেদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার সেন (?) এবং স্কুলের প্রিন্সিপাল মি. গ্রিফিথস, ইনি ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজেরও প্রিন্সিপাল তখন। ব্যারিস্টার সেন একটু মজা করে তাঁর বক্তৃতায় জুড়েছিলেন: মি. গ্রিফিথস আমাদের ওই Solomon Snowham-এর মত নয় যে খালি খায় আর ঘুমায় ইত্যাদি। এইটুকু বলাতেই শম্ভু মিত্র ‘প্রমিনেন্স’ পেয়ে গেলেন। ক্লাসের বন্ধুরা বুঝে নিল, মঞ্চে উঠে নার্ভাস হবার মত নয় সে। এবার শুরু হচ্ছে অভিনয়-অভিনয় খেলা।
‘আমাদের ক্লাসের ছেলেরা সকলে মিলে ঠিক করেছিলুম যে আমরা নিজেরা একটা অভিনয় করবো।… দ্বিজেন্দ্রলালের (রায়ের) একটা নাটক ঠিক করে… আমরা নিজেরাই তার মহলা টহলা দিচ্ছি, অমুক করছি— হেড মাস্টার মশাই একদিন বললেন, এসব কী হচ্ছে? না না, এসব করা হবেনা, বলে বন্ধ করে দিলেন। আমাদের খুব ক্ষোভ হল।’
বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের ক্লাস এইটের ২৪-২৫ জন ছাত্র মিলে নাট্যাভিনয়ের মহলা শুরু করেছে। ডি. এল. রায়ের ‘রাণাপ্রতাপ’। স্টারে এ নাটকের প্রথম অভিনয় ২২.০৭.১৯০৫, তারপর মিনার্ভায় ২৯.০৭.১৯০৫ থেকে। আর রাজরোষে এ নাটক নিষিদ্ধ হয়েছিল ১০.০৬.১৯১০ সালে।
স্কুলের প্রিন্সিপাল সাহেব মানুষ। নিষিদ্ধ নাটকের অভিনয় তিনি কীভাবে করবার অনুমতি দিতে পারবেন। তাছাড়া অল্পবয়সী ছেলের পক্ষে এমন জটিল রাজনৈতিক বিষয় ক্ষতিকর। এত কিছু না বলে, হেডমাস্টারমশাই পড়ালেখার ক্ষতির কথাই বলেছিলেন সেদিন। তাতেই কী ভয়ংকর ক্ষোভ। এই নাট্য নির্বাচনও কি খুদে সৈনিকের? সে কি ‘ঘরে বাইরে’ পড়ার মতই গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকগুলি পড়ছিল? না কি অন্য কোনও সূত্রে আবিষ্কার করেছিল ‘রাণাপ্রতাপ’ নাটকটার তাৎপর্য?
‘…আমরা থিয়েটার করতে পারলুম না, অভিনয়টা করতে পারলুম না, তার ফল কিছু ভাল হ’ল না। আমাদের মাথায় আরো অন্য রকম সব বদ্বুদ্ধি ঢুকতে লাগল। একদিন আমরা সারা ক্লাশ ফ্যান্সি ড্রেস পড়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম।’
সেদিন ছিল সোমবার। স্কুলের অ্যাসেম্বলি হলে সব ছাত্রদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট ঈশ্বরের প্রার্থনা করার কথা। ব্রিটিশ স্কুলের মিশনারি রীতি… নরেন্দ্রপুরে এখনও এটা চালু। প্রার্থনার পর যে যার ক্লাসে যাবে। ফ্যান্সি ড্রেস পরা একদল ছেলে গুরুগম্ভীর ব্যবহার করছে, আচার আচরণ চরিত্রানুযায়ী— অর্থাৎ ‘রাণাপ্রতাপ’-এর পথনাটক। অভিনয় শুরু হয়ে গেছে। স্কুলের ছেলেরা সবাই হাসছে আর চিৎকার করছে। সে এক রইরই কাণ্ড।
ফলে হেডমাস্টারমশাই ভয়ংকর চটে গেলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, সমস্ত বাঁদর ছেলেগুলোকে স্কুল থেকে বার করে দেবেন। বললেন, কিন্তু দিতে পারলেন না। ছেলেগুলো যতই দুষ্টু হোক, লেখাপড়ায় মন্দ নয়। ক্ষমা করে দিলেন সেবারের মত।
কিন্তু রাণাপ্রতাপের প্রতিরোধস্পৃহা ভয়ংকর। প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। একটার পর একটা চক্রান্ত আর আক্রমণ! হেডমাস্টারমশাইকে জব্দ করতেই হবে। তাঁকে বুঝিয়ে দিতে হবে অভিনয় না করতে দিয়ে কী মারাত্মক ভুল করেছিলেন তিনি। বলাবাহুল্য, দলের নেতা শম্ভু। অভিনয়ের অদম্য ইচ্ছায় ক্রমশ মেতে উঠেছে ছেলেটা।
‘তখন স্কুলে প্রতি বছর ১২ ডিসেম্বর দরবার ডে পালিত হ’ত। সেদিন স্কুলে বাৎসরিক স্পোর্টস। সবাই সেই নিয়ে ব্যস্ত। খেলাধুলো চলছে। বেশ একটা উৎসবের পরিবেশ।
দরবার ডে স্পোর্টসে আমরা মোটেই উৎসাহিত নই। যখন ওইসব হচ্ছে আমরা কেউ কেউ গিয়ে যে হলে সব কমলালেবু রাখা ছিল, সেই ঘরের ভেন্টিলেটার খুলে, তার মধ্যে দিয়ে গলে, কমলালেবু চুরি করে এনে সবাই খেলাম। এইরকম যত ইস্কুলে কলা গাছ ছিল, তার মোঁচা হয়েছে কি কলার কাঁধি হয়েছে, রাত্তির বেলা কেটে নেওয়া হলো। এইরকম সব বদ্বুদ্ধি তখন আমাদের মাথায় চলত আর কি! আমার মনে হয় ওই জন্যে— মানে ওই সোজা পথটা পাওয়া গেল না… ওই তাতেই বোধহয় সব বিগড়ে টিগড়ে গেল।’