আক্রান্ত রাশিয়া
২২.৬.১৯৪১
ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধে সোভিয়েট রাশিয়া সরাসরি জড়িয়ে পড়ল। সমগ্র পৃথিবীর জনগণ আর কেবলমাত্র কাগজের পুতুল নয় — বুর্জোয়াশ্রেণীর বিশ্বব্যাপী ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এবার সাধারণ মানুষ নেমে পড়বে, নেতৃত্ব দেবে রাশিয়া। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত পার্টি ইসতাহারে From peace Front to Peoples War নিবন্ধে পি. সি. যোশী ‘জনযুদ্ধ’ তত্ত্বের ব্যাখ্যায় বলছেন: ‘নিজেদের ভবিষ্যৎ তারা নিজেরা গঠন করবে, নিজেদের পথে এই যুদ্ধ জয় করে নিজেদের শৃঙ্খল মোচন করবে’।
জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিকের দল কম্যুনিষ্টদের নামে অপপ্রচার শুরু করে দিল। তাঁরা নাকি ‘জনযুদ্ধ’ নাম দিয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে! জনযুদ্ধ যে দেশপ্রেমিকদেরই যুদ্ধ, জনগণকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ এটা বোঝানো দূরুহ হয়ে উঠলো! এতো দিন ধরে স্বদেশী বীরের আত্মত্যাগ যেন নিষ্ফলে যেতে চলেছে !
জনযুদ্ধ নীতির প্রভৃত ও মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে বুর্জোয়া নেতৃত্বের জায়গায় জনগণকে প্রতিষ্ঠিত করা। জনগণ মানে মুষ্টিমেয় দেশপ্রেমিক ও কতিপয় বীর ছাত্র নয় — শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষ সবাইকে মিলিয়েই জনগণ।
এই কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের মাধ্যম হিসেবে নাচ গান আবৃত্তির সঙ্গে নাট্যকলাকে বেছে নেওয়া হল। জন্ম নিল গণনাট্য। ১৬.৫.১৯৪২ তে অরণি পত্রিকায় ‘জাপ বিরোধী জননাটিকার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। শর্তগুলি ছিল —
১. উন্মুক্ত স্থানে অভিনয়
২. সহজ ভাষা
৩. তীব্র জাপ বিরোধী বিষয়বস্তু
৪. একঘন্টা দেড় ঘন্টার অনুষ্ঠান।
২৯.১০.৪৩ এবং ৫.১১.৪৩ অরণি পত্রিকায় প্রকাশিত হ’ল ‘জবানবন্দী’ এবং ‘হোমিওপ্যাথি’। আরো আগে ‘আগুন’ । এবার নাটক প্রযোজিত হবে মানুষের জন্য, মানুষের মধ্যে। ওদিকে নিবারণ পণ্ডিত জনযুদ্ধের ছড়ায় চীনে ফ্যাসিস্ত অত্যাচারের বিবরণ দেবার পর দেশের মানুষকে সাবধান হতে বললেন… ব্রিটিশ গোলামির পরিবর্তে জনগণ জাপানের গোলাম না হয়ে ওঠে— সরকারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেরাই যেন জনরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে !
সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদীর দল ঘোষণা করলো: কম্যুনিষ্টরা সোভিয়েট রাশিয়ার গোলাম।
রবীন্দ্রনাথ ।। মৃত্যুদিন ১
২৯.৭.১৯৪১
অপারেশনের আগের দিন রবীন্দ্রনাথ জানতে চেয়েছিলেন, এটা কতোখানি কষ্ট দেবে। উত্তরে ড: জ্যোতিপ্রকাশ সরকার (ড: নীলরতন সরকারের ভ্রাতৃস্পুত্র) পরিহাস করে জানালেন— তেমন কিছু নয় মশাই। আমরা আংশিক অবশ করে নেবো, আপনি টেরই পাবেন না, অঙ্গচ্ছেদ হচ্ছে। একটা পর্দা টাঙিয়ে দেবো, যাতে আপনি ডাক্তারকে দেখতে না পান। অপারেশন চলাকালীন একটা কবিতা লিখে ফেললেও আমরা আশ্চর্য হবো না! রবীন্দ্রনাথ হেসে সম্মতি জানালেন— ঠিক আছে, যদি অপারেশন একটা কবিতা লেখার মতন কষ্টদায়ক না হয়, আমি প্রস্তুত।
৩০.৭.১৯৪১
খুব সকাল থেকেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি যেন একটা হাসপাতাল। ডাক্তার আসছে যাচ্ছে। বারান্দায় অপারেশন থিয়েটার করা হয়েছে। এসবে গুরুদেবের ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি লিখছেন শেষ কবিতা :
‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে, হে ছলনাময়ী’…
অনুলেখক রানী চন্দের কন্ঠে কবিতা শুনলেন, সংশোধন করালেন। এবার আমি নিশ্চিত। এসো ডাক্তার, দেখাও তোমার কেরামতি! পুত্রবধু প্রতিমা দেবী শান্তিনিকেতনে অসুস্থ রয়েছেন। একটা চিঠি পাঠালেন কারোর হাতে। সেটা যেন অপারেশনের আগেই তাঁকে দেয়া হয়। প্রতিমার চিঠির উত্তর লেখালেন। নিজে স্বাক্ষর করলেন ‘বাবা মশাই’— শেষবার কলম চালানো।
সেদিনই বেলা সাড়ে ১০টায় অপারেশন হলো। জীবনমৃত্যুর তীব্র টানা পোড়েনের পর রবীন্দ্রনাথ মারা গেলেন ৭.৮.১৯৪১ বেলা ১২টায়।
১৮.২.১৯৯৭
শম্ভু মিত্রের অপারেশন হয়ে যাবে। ব্লাডারে ধরা পড়বে দুটো টিউমার। তিনি প্রথমে কিছুতেই সম্মত হবেন না। অনেক বুঝিয়ে অপারেশনে রাজী করাবেন ড: শিবাজী বসু।
‘আমি তখনো তো তেমন করে টাকা কড়ি রোজগার করার চেষ্টা করিনি। জমাবারও চেষ্টা করিনি। সেই অর্থে মেয়েটার জন্য কি করেছি? তাই আমার যেটুকু জমাতে পেরেছি, যেটা ওর জন্যেই থাকুক। বেচারির শরীর ভালো থাকে না, তদুপরি আমাদের মতন বুড়ো বুড়িদের নিয়ে এক বৃদ্ধাশ্রম খুলে বসেছে। তা এখন যদি আমার জমানো টাকা থেকে খরচ করি, সেটা কি সত্যিই আমার টাকা? তার থেকে নিজের অপারেশন করাব? ও উন্মাদ হতে পারে, আমি তো নই।’
(শাঁওলীর বকলমে শম্ভু মিত্রের সংলাপ / তর্পণ / দেশ ২৮.৬.১৯৯৭)
যেদিন অপারেশন হবে, সেদিন বিকেলেই তিনি বলবেন, ফিস ফিস করে শাঁওলীকে : রবিঠাকুর কেন মরে গিয়ে ছিল, আমি বুঝতে পেরেছি! লজ্জায়! আমার থেকে হাজারগুণ বেশি সেনসিটিভ ছিলেন তো! কী করে সইবেন! তাই মরে গিয়ে ছিলেন!
শম্ভু মিত্র মারা যাবেন অপারেশনের ঠিক তিন মাস বাদে, ১৯.৫.১৯৯৭ তে।
বারবার তিনি রবীন্দ্রনাথে ফিরে গেছেন। রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে গেলে তাঁকে বন্ধু ভেবে পড়া উচিত এমন কথাও বলেছেন তিনি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শুনতে চেয়েছেন সুরঙ্গমার গান ও সংলাপ, কলিম শরাফির রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্যাসেট। বেশ স্পষ্ট বুঝিয়ে গেছেন, কী ভাবে পৌঁছে ছিলেন রবীন্দ্রনাথে। কেবল মুক্তধারা নাটকটা জমাতে পারেননি কোনোবারেই!
আমরা এখনো চেষ্টা করছি, ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিনে শম্ভু মিত্র কী ভাবে বিচলিত হয়ে ছিলেন সেই তথ্য সংগ্রহ করার। তখন তাঁর বয়স ২৬ বছর। সরাসরি কোন যোগাযোগ ঘটেছিল কি না সেই তথ্যও আমাদের জানতে হবে।
শিশিরকুমারের সঙ্গে এ বছরই তিনি অভিনয় করছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল… সেই সূত্রেও দেখা হ’তে পারে। তবে এই পর্বে তিনি আদৌ আচ্ছন্ন ছিলেন না রবীন্দ্রকাব্যে বা নাটকে। তাঁর ঝোঁক এবং আকর্ষণ ছিল যাত্রা এবং পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে। সেই ক্ষেত্রভূমিতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না। অতীন-এলার সংলাপ যখন লিখছিলেন রবিবাবু— তখন তিনি ৭৪ বছরের যুবক; শম্ভু মিত্র ২০ বছরের বৃদ্ধ।