থিয়েটারকে সারা অঙ্গে মেখে নিয়ে আনন্দেই আছে সংগীতা | বিজয়কুমার দাস | পর্ব – ৪৫

থিয়েটার অনেকেই করে, কিন্তু থিয়েটারকে আপন করে নিয়ে তাকে সারা অঙ্গে মেখে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে যারা, তারাই তো থিয়েটারের ঘরের মানুষ। থিয়েটার নিছক একটা শখ মেটানো নয়, দর্শকের হাততালির মোহ নয় – থিয়েটার একটা যাপন, একটা চর্চা – এই ভাবনা নিয়ে যারা থিয়েটার করে, থিয়েটার তাদেরকে কাছে টেনে নেয়। অশোকনগরের মেয়ে সংগীতা চক্রবর্তী সম্পর্কে এ কথা বোধহয় নির্দ্বিধায় বলা যায়। এখন তো অভিনেতা, নির্দেশক এবং অশোকনগর নাট্যমুখের কর্ণধার অভি চক্রবর্তীর ঘরণি হিসাবে একটা পরিচিতি আছেই। কিন্তু যখন সে উমাপ্রসন্ন সরকার আর রীনা সরকারের কন্যা হিসাবে সংগীতা সরকার ছিল তখন থেকেই সে থিয়েটারের পথে পা রেখেছে। আর পাঁচজনের মতই কবিতা চর্চা, নাচের চর্চা নিয়ে অশোকনগরেই কেটেছে মেয়েবেলা। সুদীপ রায়ের কাছে কত্থক নাচ শিখেছে। পাশাপাশি ক্রিয়েটিভ ড্যান্স এবং উদয়শঙ্করের নৃত্যশৈলীও আয়ত্ত করে নিয়েছিল। দিদি শাশ্বতী সরকারের মুখে ও মায়ের কাছে রবীন্দ্রনাথের পূজারিণী, দেবতার গ্রাস কবিতা শুনতে শুনতে কবিতার প্রতিও একটা আগ্রহ জন্মেছিল। এসবই যেন তার থিয়েটারে আসার প্রস্তুতি পর্ব।

ছোটবেলা থেকেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা বলা, মুখের অভিব্যক্তি প্রকাশ করা তার অভ্যাস ছিল। পরে পাড়ার থিয়েটারে “কচিপাতার কান্না” নাটকে সংগীতার প্রথম থিয়েটারের মঞ্চে নামা। পাশাপাশি পড়াশুনো তো ছিলই। হাইস্কুলের সীমানা পেরিয়ে বাণীপুর মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্ব নিয়ে স্নাতক। এরপর নেতাজী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যাল ওয়ার্ক নিয়ে স্নাতকোত্তর। নিছক ডিগ্রী নয়, এই শিক্ষার গুণেই পরবর্তীতে সমাজের নানা স্তরে আজও কাজ করে চলেছে সংগীতা। আর সেক্ষেত্রে তার হাতিয়ার কিন্তু থিয়েটারই।

অশোকনগরের ছেলে অভি চক্রবর্তী তখন স্থানীয় ক্লাবে শ্রুতিনাটক করত। সংগীতাও ভিড়েছিল সেই দলে। তখন সংগীতা একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। পরে ২০০০ সালে অভি, সংগীতা , অসীম দাস এবং আরো দুজন মিলে অশোকনগর নাট্যমুখ দল তৈরি করে। এই দলে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর গল্প অবলম্বনে উদয়নীল ভট্টাচার্যের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় “প্রভু ভৃত্য সংবাদ ” এ তার প্রথম অভিনয়। সংগীতা ভৃত্যের ভূমিকায়। ২০০৯ সালে অভির সঙ্গে ঘর বাঁধা। অন্য অর্থে থিয়েটারের সঙ্গেই ঘর বাঁধা। স্বামী, সন্তান, সংসার আর থিয়েটার – এই হল সংগীতার জীবনবৃত্ত। অভিনয়ের পাশাপাশি সংগঠনের কাজে সামাল দেওয়া, সংসার সামলানো, দলের নতুন প্রজন্মকে আবৃত্তি, নৃত্যে ও অভিনয়ে পারদর্শী করে তোলা ইত্যাদি নানা কাজে কাটে তার প্রতিটা দিনরাত্রি। রীতিমত সে এখন দক্ষ অভিনেত্রী হয়ে উঠেছে।

নাট্যমুখের সাম্প্রতিক প্রযোজনা মোহিত চট্টোপাধ্যায় রচিত এবং অভি চক্রবর্তী নির্দেশনায় “মি:রাইট ” নাটকে তন্দ্রা চরিত্রে সংগীতা অনবদ্য ও গভীরতায় সমৃদ্ধ অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছে। এছাড়া নাট্যমুখ প্রযোজিত রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ, মুক্তধারা, রাজা, রক্তকরবী নাটক অবলম্বনে “মারের সাগর পাড়ি দেব ” নাটক নির্মাণে কুশলতা প্রমাণ করেছে। আর শুদ্ধস্বত্ত্ব ঘোষের লেখা মহাভারতের বিশেষ নারী চরিত্র অবলম্বনে “গান্ধারী” নাটকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করে সকলকে চমকে দিয়েছে। ভারত বিখ্যাত নাট্য নির্দেশক সত্যব্রত রাউত কে সংগীতাই রাজি করিয়েছে বাংলায় এসে এই নাট্যে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য। এর পাশাপাশি থিয়েটারকে সর্বস্তরে নিয়ে যাওয়ার মন্ত্রে কাজে নেমে উপার্জনও করছে। স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের নাচ, গান, অভিনয়ে পারদর্শী করে থিয়েটারের নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলছে। অশোকনগরের বর্তমান বিধায়ক সংস্কৃতিপ্রেমী নারায়ণ গোস্বামী তাকে এই কাজে প্রেরণা জুগিয়েছেন। স্কুলে স্কুলে গিয়ে থিয়েটারের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ছাত্র ছাত্রীদের। সারা অশোকনগরকে থিয়েটারের সূত্রে গেঁথে ফেলেছে সংগীতা। ওর নির্দেশিত প্রথম নাটক সত্যজিৎ রায়ের গল্প অবলম্বনে অভি চক্রবর্তীর নাট্যরূপ নিয়ে “সুজনের গল্প”। দলের ছোটদের নিয়ে প্রথম কাজে নিজের একমাত্র মেয়ে অমর্ষিকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিয়েছিল। এবং সেই নাট্য দর্শক হৃদয়ে প্রশংসা পেয়েছিল।

সংগীতা এখন দলের সভাপতি তাই স্বভাবতই অশোকনগর নাট্যমুখের সব কাজেই হাত লাগাতে হয় তাকে । এছাড়া ‘অমল আলো’ নাট্যাঙ্গনের কাজ তো আছেই। অভিনীত অন্যান্য চরিত্রদের মধ্যে সংগীতার কাছে অবশ্য “নেমেসিস” নাটকের ক্রিস্তিল চরিত্রটা খুব প্রিয়। পথশিশুদের নাটক শেখানোর পাশাপাশি ৫-১৮ বছরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে রেপার্টারি চালানোর কাজও চালিয়ে যাচ্ছে। অশোকনগর আদর্শ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে মেয়েদের নিয়ে “ভগিনী নিবেদিতা” নাটক করিয়েছে। নিজে শিলাদিত্য, বেউলো, বাসবদত্তা, দিবারাত্রির গদ্য, কাগজের নৌকো, অপারেশন ২০১০, বোল, গর্ভবতী বর্তমান, রাতবিরেতের রক্তপিশাচ, আমি অনুকূলদা আর ওরা, কুহকিনী বীররাত্রি প্রভৃতি নাটকে নানারকম চরিত্রে অভিনয় করেছে। প্রতিটা মুহূর্ত তার কাছে থিয়েটার যাপনের মুহূর্ত। উদ্ভাবনী শক্তির এক উৎস যেন সংগীতা। ২০১৩ তে অশোকনগর ব্রাত্যজন এ “তিতলি ” নাট্যে নির্দেশনা দিয়ে একটি বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সম্প্রতি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’ কে মঞ্চে আনছেন দলের কচিকাঁচাদের নিয়ে। এটি একটি বড় কাজ মনে করছে সংগীতা কারণ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড়শো বছর জন্মজয়ন্তী সামনেই।

থিয়েটার তার কাছে এখন নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসের মত। থিয়েটার করে, নির্দেশনা দেয়, থিয়েটার শেখায় – এ ভাবেই প্রতি মুহূর্তে থিয়েটার গায়ে মেখে অশোকনগর নাট্যমুখের সংগীতা প্রতিদিন যেন নতুন আনন্দে বাঁচে, বেঁচে থাকে, বেঁচে থাকতে চায়।

3 thoughts on “থিয়েটারকে সারা অঙ্গে মেখে নিয়ে আনন্দেই আছে সংগীতা | বিজয়কুমার দাস | পর্ব – ৪৫

  1. এভাবেই কাজের গতি তরান্বিত থাকুক।
    অনেক ভালোবাসা।

Comments are closed.