সত্যজিৎ রায়: অপরাজিত | সুব্রত কাঞ্জিলাল

কমলেশ্বর মুখার্জী বেশ কয়েক বছর আগে মেঘে ঢাকা তারা নামের একটা সিনেমা তৈরি করেছিলেন। ওই ছবিতে তিনি ঋত্বিক ঘটককে এই সময়ের দর্শকের কাছে তাঁর মত করে হাজির করেছিলেন।

অনিক দত্ত এবার ‘অপরাজিত’ নামে তাঁর মত করে একটা সিনেমা নির্মাণ করলেন। দুটো ছবি নিয়ে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল। এবার হইচইয়ের পর্ব একটু বেশি। প্রথমেই বলে রাখি আমি অপরাজিত এখনো দেখে উঠতে পারিনি। মেঘে ঢাকা তারা দেখেছিলাম। সত্যজিৎ রায় এবং ঋত্বিক ঘটক দুজনেই বাঙালি শিক্ষিত দর্শকের কাছে সম্ভ্রম এবং আবেগের জায়গায় অবস্থান করেন। যাঁরা হইচই করছেন তাদের 90% এই দুই দিকপাল শিল্পীর সবকটা ছবি দেখে ফেলেছেন এটা বলা যাবে না। এই দুজন চলচ্চিত্রকারের সমাজ জিজ্ঞাসা, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান এবং ভূমিকার দিক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যে কি এ বিষয়ে সম্যক ধারণা কতটুকু সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ রয়েছে।
বাঙালিকে হুজুগ প্রবণ জাতি বলা হয়। ভোট সর্বস্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে বাঙালি যেমন উন্মাদ হয়ে ওঠে, একইভাবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যজিৎবাবুদের ব্যাপারেও যুক্তিহীন, শিল্পবোধ বিবর্জিত হালকা উত্তেজনায় মেতে ওঠে। অন্যদিকে সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে এক ধরনের সেন্টিমেন্ট বয়ে বেড়ায়। যেমন অনীক দত্তের অপরাজিত ছবিটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে যে ধরনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, সেটা বেশ মজার। অনেকেই অপরাজিত নিয়ে ভিডিও বানিয়ে ফেলছেন। এইসব ভিডিওতে সত্যজিৎবাবুর পথের পাঁচালীর প্রাসঙ্গিকতা এবং অনিক দত্তর বিষয় নির্বাচনের গুরুত্ব কোথায় আমরা জানতে পারছি না।

আমরা সেই পঞ্চাশের দশকের থেকে শুরু করে সত্তরের দশক এবং পরে আশির দশকের মাঝে সত্যজিৎ চলচ্চিত্রের দুটো পর্ব প্রত্যক্ষ করেছি। অধ্যাপক, সিনেমা বিশেষজ্ঞদের একটা অংশ সত্যজিৎ এর পথের পাঁচালী, অপরাজিত, চারুলতা, কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে যতটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, এবং ঘোষণা করেছেন , এই ছবিগুলো প্রকৃত অর্থে সত্যজিৎ এর মেজর কাজ। সত্তরের দশকে এসে সত্যজিৎ কৃত প্রতিদ্বন্দ্বী, জন অরণ্য, সীমাবদ্ধ, শতরঞ্জ কি খিলাড়ি, সদ্গতি, ঘরে বাইরে ছবিগুলো নিয়ে ওইসব সত্যজিৎ ভক্তরা বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। শেষের দিকে শাখা প্রশাখা, গণশত্রু, আগন্তুক ছবিগুলো যে সত্যজিৎ প্রতিভার পক্ষে বেমানান এমন উক্তি ও তারা করেছেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মত সত্যজিৎ প্রতিভা যেভাবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক বেশি সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচয় রেখেছেন এটা তারা কিছুতেই মানতে চান না। এইসব ছবিগুলোকে কোনভাবে আর্টের পর্যায় রাখা যায়না এটাই তাদের মূল বক্তব্য। হীরক রাজার দেশে সত্যজিৎ প্রতিভার কলঙ্ক এমন কথা বলতে শোনা গেছে। শিল্পী কেন রাজনীতি সচেতন হবেন, রবীন্দ্রনাথ সত্যজিৎ এর মত দিকপাল প্রতিভা দেশ ও সমাজের
রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে আঙ্গুল তুলবেন এটাই তাদের বিরক্তির কারণ।

এইসব পণ্ডিতদের আমরা সহজে চিনতে পারি। এরাই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব দিতে চাননি। উৎপল দত্তের থিয়েটার এদের কাছে মহা ত্রাস। অন্যদিকে হইচই যারা করছেন, আইনক্সে অপরাজিত দেখতে যাচ্ছে তারাও জানেন না, কেন যাচ্ছেন, কি দেখছেন, অপরিচিত দেখে কতটা সমৃদ্ধ হলেন। আমি কখনো সমস্ত দর্শককে বলতে চাই না, যে, তারা কেউ সত্যজিৎ শিল্পের প্রকৃত সমঝদার নন। আমার প্রশ্ন, অনিক দত্তর ভূতের ভবিষ্যৎ যেভাবে মানুষকে উত্তেজিত করেছিল, উদ্বেলিত করেছিল, সেটা কি মূল্যহীন? আমার প্রশ্ন তাহলে, বাংলা ছবির কেনো এই অবক্ষয়? দশকের পর দশক ধরে মুম্বাই মার্কা আফিম চলচ্চিত্রের রমরমা কেন?

চলচ্চিত্র নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করে উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর মত অনেকে থেমে গিয়েছিলেন। উৎপলেন্দু বলতেন, অঞ্জন চৌধুরী, স্বপন সাহাদের ছবি যখন box-office পায় তখন আমরা ১০০ বছর পিছিয়ে যাই। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বাংলা ছবি করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বিগত কুড়ি বছরে তাঁর অধিকাংশ ছবি এই বঙ্গে মুক্তি পেত না। ঋত্বিক ঘটকের ছবি তাঁর জীবিত কালে মাছি তাড়াত। একই রকম দশা ছিল মৃণাল সেনের।

এখন পর্যন্ত আমার চোখে তেমন কোনো আলোচনা বা গুরুত্বপূর্ণ লেখা পড়লো না যা থেকে বোঝা যায়, সত্যজিতের পথের পাঁচালী সৃষ্টির এবং অনীক দত্তর অপরাজিত ছবি নির্মাণের অন্তর্নিহিত সত্য কি? সোশ্যাল মিডিয়াতে ঝড় তৈরি করা হচ্ছে এই বলে যে, মুক্তি পাবার সঙ্গে সঙ্গে অপরাজিত ছবিটি দেড় কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। জিতু কমল কে নিয়ে টক-ঝাল মিষ্টি ফুটেজ বেরোচ্ছে। জিতু কমল এর মেকআপ নিয়ে হাজার কথা বলা হচ্ছে। অনিক দত্ত ছবি তৈরি করতে গিয়ে, সত্যজিৎ রায়ের জেরক্স কপি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। সায়ণী তৃণমূল নেত্রী হওয়া সত্বেও তাকে কাস্ট করা হয়েছে। নন্দনে এই ছবির মুক্তি পেল না। সন্দীপ রায় তাঁর বাবাকে চিনতে পেরেছেন। বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র শতাধিক সিপিএম কর্মীদের নিয়ে ছবি দেখতে যাচ্ছেন। নন্দন টু তে এই ছবির শুটিং হওয়া সত্ত্বেও, প্রদর্শনের ছাড়পত্র পাচ্ছে না। এই ছবির প্রযোজক নাকি তৃণমূল সমর্থক। কিভাবে বাণিজ্য করতে হয় সেটা তিনি ভালোই জানেন। জনৈক পুরুষ অভিনেতাকে ইন্দোর ঠাকুরন চরিত্রে নামানো হয়েছে।
বাঙালির ২৫ শে বৈশাখের পর, দোসরা মে সত্যজিৎ পুজো শুরু হয়ে যাচ্ছে। সেই পুজোয় ঋত্বিক সম্ভবত অনিক দত্ত কে নির্বাচন করা হতে পারে।
আসলে বাঙালি কাউকে গ্রহণ করে না। বাঙালির জাত্যাভিমান নেই। বাঙালি চিরকাল তার মাতৃভূমিকে লুণ্ঠিত হতে দিয়েছে। বাঙালি আত্মঘাতী জাতি। চৈতন্যদেব, রামমোহন বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ সত্যজিৎ রায় এঁদের নিয়ে বিজ্ঞাপন করে। ছবির প্রদর্শনী করে। এঁদের আদর্শ গ্রহণ করে না। বাঙালি প্রভাবিত হয়। শক হুন পাঠান মোগল কংগ্রেস মুসলিম লীগ আরএসএস তৃণমূল বাঙালিকে ভেড়ার পাল বানিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ সম্পন্ন করে। খেলার মাঠের মতো বাঙালি অনবরত জার্সি বদল করে। নানা কারণে বাঙালি নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই। বাঙালি ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান মহামেডান নিয়ে দাঙ্গা বাঁধায়। কর্পোরেট মিডিয়া খুব সহজেই বাঙালিকে কলুর বলদ এ রূপান্তর ঘটিয়ে দিতে পারে। এই কারণে বাঙালি নিজের মাতৃভূমিকে দ্বিখণ্ডিত হতে দেয়। আগামী দিনে এই বাংলা খুব সহজেই আরো অনেক খণ্ডে খণ্ডে ভাগ হয়ে যাবে। সেইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে আজকের বাঙালি ছাগলের তিন নম্বর ছানার মত ধেই-ধেই করে নাচবে।

এইতো কিছুদিন আগে কার্পেট মিডিয়া স্বপন সাহা আর সত্যজিৎ রায় কে ১ আসনে ফেলে প্রচার করেছিল মহান পরিচালক হিসেবে। বাঙালি গর্জে ওঠেনি। বিদ্যাসাগরের গলাকাটা গেলে বাঙালি প্রতিবাদ করতে পথে নামেনি। খুব সহজেই বাঙালি ঢাকঢোল নিয়ে হনুমান পূজা করতে বেরিয়ে পড়ে। বিগত ১৫ বছর ধরে বাঙালির যে চূড়ান্ত নৈতিক অধঃপতন ঘোটে গ্যাছে, সেই প্রেক্ষাপটে নির্দ্বিধায় বলা যায়, সত্যজিৎ প্রেম আসলে একটা হুজুক। কলকাতা শহরের গণ্ডি ডিঙিয়ে শহরতলি, মফস্বল শহর বা গঞ্জ এলাকাতে অনিক দত্ত তার ছবি নিয়ে যদি পৌঁছে যান, তাহলে বুঝবেন, হাড়ে হাড়ে টের পাবেন, ঋত্বিক ঘটক এই বাঙালিকে কেন শংকর মাছের চাবুক দিয়ে চাবকাতে বলেছিলেন।

অনিক দত্ত কে অনেক অভিনন্দন। সত্যজিৎ রায় আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে সিনেমা শিল্পটাকে সৃজন করতে হয়। আর আপনি একটা পুরনো কথা মনে পড়িয়ে দিলেন। বহুদিন আগে জনৈক বাঙালি কবি বলেছিলেন, আমি আঙ্গুল কাটিয়া কলম বানাই চোখের জল কালি।
সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালী সৃষ্টি করতে বসে নিজের আঙ্গুল কে বানিয়েছিলেন কলম। তাঁর নিজের চোখের জল ছিল কালি। এই ভাবেই তো সৃষ্টি হয়।

আজকের বাঙালি চলচ্চিত্রকাররা এই মৌলিক সত্যটাকে ভুলে গেছে। আজকের নাট্যশিল্পী থেকে শুরু করে অনেকেই মেরুদণ্ড বিসর্জন দিয়ে রাজার বাড়ির দাসত্ব করতে নেমেছে। সেই কারণেই আজকাল কবিতা, গান, নাটক, সিনেমা, কথা সাহিত্য সৃষ্টি হয় না।
শিল্প কর্মীরা প্রোমোটার হয়ে গেছে।

One thought on “সত্যজিৎ রায়: অপরাজিত | সুব্রত কাঞ্জিলাল

  1. খুব ভালো লিখেছেন সুব্রতদা,পাশাপাশি এরকম এক্সপেরিমেন্টেরও প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি।

Comments are closed.