মাঝে মাঝে বেঁচে থাকাটাকেই একটা দুর্ঘটনা বলে মনে হয়, তাই বেঁচে থাকাটাকে প্রাণপনে উদযাপন করতে বেশ ভাল লাগে, উপভোগ্য হয়ে ওঠে। চারপাশের নানা রঙের নানা গন্ধের সবকিছুকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি আষ্টেপিষ্ঠে,সার্থক করে তুলতে চাই আমাদের বেঁচে থাকাকে। একজন সামান্য নাট্যকর্মীর জীবনে নাট্য;নাট্যের প্রতিটি স্তর বা কর্ম সেই সার্থকতাকে বহন করে আনে,এক সঙ্গে অনেক বেঁচে থাকাকে সত্য করে তোলে। এই সহজ সত্য যে অনুভব করে সেই আঁকড়ে ধরে নাট্যযাপনের আপাত কঠিন পথকে।রাজা ঘোরামী, আমাদের রাজার ভিতরে গড়ে উঠেছিল সেই অনুভবের ইমারত। আমরা যারা রাজার নাট্যযাত্রার প্রবেশ পথের পাশে দাঁড়িয়ে তার নাট্যযাপনের সঙ্গী হয়েছি তারা নির্দিধ্বায় স্বীকার করতে পারি সেই সত্য। রাজা সম্পূর্ন নিমজ্জিত হয়েছিল নাট্যে।চাকরীর চাপ সামলে সারাক্ষণ ডুবে থাকতো নাটক নিয়ে।এক সময়ের বেপরোয়া তরুন নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে হয়ে উঠেছিল একজন আদ্যপ্রান্ত নাট্যকর্মী।লক ডাউনের মধ্যে ঘরে বসে নিজেকে অন্যভাবে আবিস্কারের খেলায় মেতে উঠেছিল ও। নিজের মতো করে আবৃত্তি করে পাঠাতো কত কবিতা! ইউটিউবে পোষ্ট করতো ইচ্ছা হলে। চাকরীসুত্রে ও কালিনগরে আসার পর ওকে যখন প্রথম দেখি তখন নিতান্ত সময় কাটাতে বা খানিকটা শখে নাটক করতে চায়। কথা শুনে বুঝতে পারি ও যাত্রা করলেও তার আগে কোনো থিয়েটার করেনি।এমনকি থিয়েটার দেখারও তেমন অভিজ্ঞতা ওর ছিলনা । সে অবস্থা থেকে আজকের থিয়েটারে ডুবে যাওয়া রাজার যাত্রাপথ দেখলে বুঝতে পারি থিয়েটারের নিজস্ব শক্তির জোর।ওর প্রথম নাট্যসংযুক্তি প্রখ্যাত নাট্য নির্দেশক কমল চট্টোপাধ্যায়ের নির্দশনায় সুন্দরবন নাট্যোৎসব কমিটির প্রযোজনা ‘হটাৎ যদি’ নাটকে। সে বছরই কালিনগর ঐকতানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘পুনর্জন্ম’ এবং ‘চিচিবাবার দুই সোদর’ নাটকে অভিনয় এবং আস্তে আস্তে কালিনগর ঐকতানের একজন হয়ে ওঠা।পরের বছর ঐকতানের ‘জন্মদিন’ এর সঙ্গে সঙ্গে নাট্যোৎসব কমিটির প্রযোজনায় নির্দেশক মনীশ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় ‘খনন’ নাটকে অভিনয়।এসব করতে করতেই নাটকের প্রতি আগ্রহ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে ওঠে ওর মধ্যে।নিজেকে প্রস্তুত করতে একেরপর এক নাট্য কর্মশালায় যোগ দিতে থাকে।যোগ দেয় বাদু জনসংস্কৃতির একটি প্রযোজনা ভিত্তিক কর্মশালায়। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নাট্য নির্দেশক সঞ্জয় গাঙ্গুলীর হাত ধরে অন্য ধারার থিয়েটার চর্চা, অগস্ত বোয়ালের ফোরাম থিয়েটারের সঙ্গে পরিচয় ঘটে রাজার।জনসংস্কৃতি প্রযোজিত ইব সেনের ‘ডলস হাউস’ অবলম্বনে খেলাঘর নাটকে-এ অভিনেতা হিসেবে মনোনীত হয় রাজা,পরে জনসংস্কৃতির অনেকগুলি প্রযোজনায় অংশগ্রহণ করে।এসময়েই ও সংস্পর্শে আসে প্রখ্যাত নাট্য নির্মাতা অয়ন জোয়ারদারের। অয়নদার স্পর্শে অভিনেতা রাজার অন্য উত্তোরণ লক্ষ্য করা যায়। সে সময়ই কালিকাপুর বাংলা প্রসেনিয়াম দলে অভিনেতা হিসেবে কাজ করে। হাতিবাগান স্পর্শের ও পরে বনগাঁ ধুলাউড়ানিয়ার ‘এবং একলব্য’ নাটকে রাজাকে নতুন রূপে আবিস্কার করি।এই সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে ঐকতানের প্রতিটি প্রযোজনার মুখ্য চরিত্রের রূপকার হয়ে ওঠে রাজা। ‘গহ্বর’, ‘তথাপি’ নাটক দুটির চরিত্রায়াণ কুড়িয়ে নেয় বহুমানুষের প্রসংশা। ঐকতানের ‘দ্রিঘাংচু’ নিয়ে গ্রাম পরিক্রমা কর্মসূচির প্রধান বাহক হয়ে ওঠে রাজা। সুন্দরবনের অনেক গ্রামে আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে ওইই দৌড়ে গেছে। দৌড়চ্ছিল ‘সে ও বিকর্ণ’ নিয়ে,পঞ্চাশটি শো হতে আর মাত্র দুটি শো বাকি ছিল।এ নাটকটিকে, বিকর্ণকে কি সাংঘাতিক ভালবাসায় আঁকড়ে ধরেছিল লিখে বোঝানো মুশকিল।সে ও বিকর্ণের বিবস্বানের সঙ্গে ওর যেন একটা আত্মিক যোগ তৈরী হয়ে গিয়েছিল। কথা দিয়েছিলাম সে ও বিকর্ণের পঞ্চাশতম শো এর উদযাপনের। সে কথা অপুর্ণই থেকে গেল। আমাদের নবতম প্রযোজনা ‘স্পর্শের বাইরে’ গত এক বছর ধরে নানা কারণে বারবার আটকে যাওয়ার কারণ নাটকটি ছেড়ে দিয়ে অন্য নাটক নিয়ে যতবার কাজ করতে চেয়েছি রাজাই রাজী হয়নি। বারবার বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে দাদা।ও সোনারপুর চলে যাওয়ার পর চরম সাংগঠনিক সমস্যার মধ্যে পড়ি আমরা, বারবার হতাশ হই। আর রাজা বারবার সাহস যোগায় কাজে নেমে পড়ি। শেষ পর্যন্ত প্রস্তুতও করে ফেলি।কি গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে যে স্পর্শের বাইরের রিয়াজুলের সংলাপগুলিকে উচ্চারণ করতো ও! আফশোষ একটাই সেই বিশ্বাসী উচ্চারণকে ও মানুষের দরবারে নিয়ে দাঁড়াতে পারলো না।সব প্রস্তুতির পর আমার শারিরীক কারণেই প্রথম দুটি শো বাতিল করতে হয় তাই এ না পারার আফশোষ কোনোদিনই মুছতে পারবো না। নেমে এলো এই নির্মম আঘাত,স্পর্শের বাইরেই চলে গেলো আমাদের রাজা। ছোট আকারে যে উৎসবটি আমরা করি তার অনেক গুরু দায়িত্ব হাসিমুখে সামলে দিতো ও। উৎসব না করার মতো অবস্থাতেই পৌঁছে গিয়েছিলাম আমরা,ছোটোরা (যারা রাজাকে ঘিরে থাকতো ) তারাই বলছে ‘রাজাদার জন্যই উৎসব করতে হবে’ আমরা মেনে নিয়েছি। থিয়েটার থেকে প্রায় অবসর নেওয়া সঞ্জীব এগিয়ে এসেছে রাজার ফেলে যাওয়া চরিত্রটির রূপায়ণে।এক অদ্ভুত আবেগ নিয়ে দিন কাটাচ্ছি আমরা। কোনো শোকসভা নয় আমরা কয়েকজন মিলে বসলেই রাজা কখন যেন ঢুকে পড়ছে আমাদের মধ্যে।শুধু ঐকতানের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এমনটা হচ্ছে এমন নয়।আমার গ্রাম কালিনগর যেখানে ও চাকরি করতে এসেছিল সেই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের খুব মন খারাপ,কারণ ওর মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা, সবসময়ের হাসি মুখ, অন্যের বিপদে দৌড়ে যাওয়া। এমনই বোধহয় হয়, যা ভালো তার স্থায়িত্ব বোধহয় খুব কম।থিয়েটারের বাইরে পারিবারিক একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম। ওর পরিবারের সেই মানুষগুলোর কথা ভাবলে নিজের কষ্ট যন্ত্রণাকে তুচ্ছ মনে হচ্ছে। বৃদ্ধ মা বাবা,ওর স্ত্রী আর পাঁচ বছরের ছোট মেয়েটার মুখোমুখি দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চয় করছি । নিজস্ব কাজে,বিশেষ করে থিয়েটারের কাজে ডুবে যেতে যেতে বারবার ও এসে পড়বে আমার চিন্তায়। ওর পিড়াপিড়িতে আবার একটা একক নাটক তৈরীর প্র্স্তুতিতে হাত দিয়েছিলাম, এরকম অনেক লেখার পেছনে ও থাকতো, এখন থেকে নিজেকেই ভাবতে হবে।ওকে ভেবে আর কোনো চরিত্রের জন্ম দেবো না আমি সেটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। সেই কষ্ট নিয়েই পথ চলতে হবে,রাজার প্রিয় বিষয় নাটকই আমাকে সে শিক্ষা দিয়েছে।আমরা অনেকে মিলে ঠিক করেছি তোমাকে স্পর্শের বাইরে যেতে দেবো না।তোমার স্পর্শকে বাঁচিয়ে রাখবো, তাহলেই জয় হবে থিয়েটারের যা তুমি মনে প্রাণে চেয়েছো ।