নমস্কার। আপনারা আমাকে কেউই তেমন চেনেন না। চেনার কথাও নয়। ওই যে নিচের ছবিতে সিনেমা হল টা দেখছেন, তার সামান্য লাইটম্যান আমি। লাইটম্যান যার কেতাদুরস্ত নাম আসার। টর্চ হাতে অন্ধকার হলে সবাইকে নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে দেওয়াই আমার কাজ। সেই যে পঁচানব্বই সালে কাজে ঢুকেছিলাম, এখনও কিন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।
পঁচানব্বই সাল। যে বছর ওই সিনেমাটা এলো। উফফ কি ভিড়, কি ভিড়! নুন শো, ম্যাটিনি,ইভিনিং – সবসময় লোক উপচে পড়ছে । সেই জন্যই তো হল মালিক আমায় কাজে নিলেন । তখন তো সব কাঠের ভাঁজ করা চেয়ার। দোতলা থেকে ঝুলতে থাকা ইয়া বড়ো পাখা। পলিথিনের ঠোঙায় বাদাম, পপকর্ণ।
তো যে কথা বলছিলাম। ওই সিনেমাটার কথা। ছেলেমেয়ে দুটোকে কেমন অদ্ভুত দেখতে ছিল,না? মানে ঠিক সিনেমার হিরো, হিরোইনদের মতো না। একটু কালোপানা,রোগা, ছোটখাটো চেহারা। ঠিক যেরকম মুখ আমার-আপনাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। ট্রেনে- বাসে, হাটে-বাজারে। খুব সাধারণ,খুব পরিচিত। তবে হ্যাঁ, হাসলে ছেলেটার মুখে ভারি সুন্দর টোল পড়ে। এই ছেলে-মেয়েটার ভালোবাসার গপ্পো নিয়েই গোটা সিনেমাটা। ওই লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ির অমতে প্রেম, ছেলেটার মেয়েটার বাড়ির লোকজনের সাথে মিশে যাওয়া, এদিকে মেয়েটার বিয়ে অন্য একটা ছেলের সাথে প্রায় হবো, হবো- যেমনটা প্রায় সিনেমায় হয় আর কি। কিন্ত মানুষজনকে দেখেছি, সিনেমা দেখতে দেখতে ক্যামন পাগলের মতো হাসত, কাঁদত, চিত্কার করত। ওই যে লাস্ট সিনটা- ছেলেটার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। একটা হাত চলমান ট্রেনের হাতলে, অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েটি প্ল্যাটফর্ম ধরে ছুটছে সেই হাতটা ধরার জন্যে। গোটা সিনেমা হল চিত্কার করছে , প্রার্থনা করছে । এখনও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়।
তারপর কেটে গেছে পঁচিশটা বছর ।সেদিনের ছোকরা আমি একটু বুড়িয়ে গেছি। পায়ে অল্প ব্যাথা, একটু ঝুঁকে হাঁটি। মাঝের বছরগুলোতে কত কি বদলে গ্যালো, বলুন। আস্ত একটা প্লেন একটা বিল্ডিংয়ের ভিতর সিধিয়ে গেল। ফুটপাথের হকারগুলোকে হটিয়ে দিয়ে রাক্ষুসে সব শপিং কমপ্লেক্স তৈরি করা হলো। রাক্ষসেরা সেখানে বাজার করতে আসে। রাস্তার কুকুরদের বরাদ্দ রোদ্দুরটুকু কেড়ে নিয়ে গড়ে উঠলো হাইরাইজ। সবকিছু বদলে গ্যালো, কিন্ত আমাদের হল থেকে এই সিনেমাটা কিন্ত নামলো না।
অবাক লাগছে, বলুন? পঁচিশ বছর ধরে এক সিনেমা চলছে। আসলে আমাদের মালিক ভদ্রলোক একটু খামখেয়ালী। সেই যে একবার বলে বসলেন- যদ্দিন মানুষ হলে এসে দেখবে, তদ্দিন এই সিনেমা চলবে। ব্যাস, সেই থেকে চলছে। সত্যি বলতে কি, এখনও সাড়ে এগারো টার শো’তে বেশ কিছু লোক সিনেমাটা দেখতে আসে। ছুটিছাটা বা হপ্তাশেষে ভিড়টা আরো জমাটি হয়। শুনলে হাসবেন, এখনও টিকিটের দাম কুড়ি থেকে পঞ্চাশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে।
পঁচিশ বছর ধরে কাজ করতে করতে কত মানুষের মুখ চেনা হয়ে গ্যালো। হয়তো ছেলেমেয়েটা কলেজে পড়তে,পড়তে সিনেমাটি দেখেছিল। তারপর ভাব ভালোবাসা, বিয়ে, সংসার। একদম বাচ্চা নিয়েই আবার সিনেমা দেখতে আসে। পুরনো কথা মনে করে। ওদের দেখে চোখে জল আসে। খুব নিজের লোক মনে হয়। মনে হয়,জড়িয়ে ধরি। কাছেই কামাথিপুরি বলে একটা রেড লাইট এলাকা আছে। সেখানকার মেয়েরাও নিয়মিত সিনেমা দেখতে আসে। কেন জানি না, মাঝেমধ্যে ঢুকরে, ঢুকরে কাঁদে। হয়তো পর্দার রাজ কে দেখে নিজেদের রাজ দের কথা মনে পড়ে। যাদের ভরসার হাত ধরে এই অচেনা শহরে ওরা একদিন এসছিল, তারপর তো শুধুই কালিঝুলি, তেলচটচটে তক্তপোষ, মাকড়শার ঝুলে ভরা শিলিং ফ্যান। তবে হ্যাঁ, আমাদের এই সিনেমা হলে কটা ঘন্টা ওরা নিশ্চিন্তে সিনেমা দেখতে পারে। কেউ বিরক্ত করে না।
জানেন তো, শহরতলির লোকেরাও খুব ভিড় জমায় আমাদের এই সিনেমা হলে। একটু দূরেই মুম্বাই সেন্ট্রাল স্টেশন, বাস ডিপো। যাতায়াতের খুব সুবিধে। একটু আড়ষ্ট, অনাড়ম্বর মুখ দেখে ঠিক আমি বুঝতে পারি। খুব হইহই করে গপ্পো করতে, করতে ওরা সিনেমাটা দেখে। সিন বাই সিন ওদের মুখস্থ । হাসার সিনে আগে থেকেই হাসে, দুঃখের সিনে আগেই চোখ মোছে। বছর পাঁচেক আগে যখন একবার কথা ওঠে, এবার বোধহয় সিনেমাটা বন্ধ হবে, এরাই প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন চড়াও হয়। কিছুতেই এই সিনেমা বন্ধ করা যাবে না। ভাবুন একবার ।
ইদানিং ঘরে বসে বসে আর ভাল্লাগে না। কি যে এক ছাতার মাথা ব্যামো এলো। সব বন্ধট্ন্ধ করে বসে আছি। কদ্দিন হয়ে গেলো, ছেলেটাকে দেখিনা সর্ষে খেতে দুহাত ছড়িয়ে মেয়েটার জন্যে অপেক্ষা করতে। বা ওই যে পায়রাকে দানা খাওয়ানোর সিনটা। মনটা খারাপ হয়ে যায়। গত পঁচিশ বছর ধরে ওদেরকে আমি চিনি। যে রাতে আমার আট বছরের মেয়েটা দুদিনের জ্বরে ভুগে চলে গেলো, তারপর দিনও তো আমি গেছিলাম। একদম লাস্ট সিনে মেয়েটা যখন ওর বাবা কে বলছে- বাওজি, মুঝে জানে দিজিয়ে, আগের রাতের জমা কান্নাটা বেরিয়ে এসছিল। যাক গে, সেসব কথা। মোদ্দা কথা, হলটা খুলুক। সিনেমাটা আবার চালু হোক। রক্তাক্ত ছেলেটা আবার ট্রেনের পাদানিতে দাঁড়াক। হাতটা বাড়িয়ে দিক। মেয়েটি উদভ্রান্তের মতো ভালোবাসার দিকে ছুটে যাক।
– কবে মেয়েটি ছেলেটির হাতটা ধরতে পারবে?
– যবে এই মহামারী শেষ হবে ।
-কবে এই মহামারী শেষ হবে?
-যবে ওরা একে অপরের হাতটা ধরতে পারবে ।