১৮৩৯ সালে ইংল্যান্ডের রিচার্ড প্ল্যান্টাজেনেট টেম্পল নুগেন্ট ব্রেইজেস চ্যান্ডোস গ্রেনভিল, বেমক্কা পূর্বপুরুষের প্রচুর সম্পত্তি পেয়ে গেলেন। অনভ্যাসের ফোঁটা কপালে চড়চড়। ফলে প্রথমেই তিনি তাঁর বাকিংহামের বাড়িতে নয়খানা ফ্ল্যাশ দেওয়া টয়লেট বসালেন। ইংল্যান্ডে সেই প্রথম। দেখে সবার চোখ কিংবা অন্য কিছু টাটালো কি না জানা নেই তবে এই রকম আজেবাজে খরচা করে কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে এত ধারকর্জ হয়ে গেল, যে পাওনাদারদের তাগাদার ভয়ে ১৮৪৮ এ এই লম্বা নামের মানুষটি ফ্রান্সে পালিয়ে বাঁচলেন। লন্ডনের বিখ্যাত নিলামদার ক্রিস্টি এন্ড ম্যাসন বরাত পেল তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নিলাম করার। এই সম্পত্তির মধ্যেই ছিল ছবিটা। কালো গোল এক তৈলচিত্র। লম্বায় বাইশ ইঞ্চি। চওড়ায় আঠেরো। ৩৫৫ গিনিতে এলেসমেয়ারের জমিদার এঁকে কিনে নিলেন। তখনকার দিনে মূল্যটা নেহাত কম না। ছবিটা দেখেই বোঝা যায়, মূল ছবিতে বেশ কয়েকবার রঙ বোলানো হয়েছে। ফলে ডিটেলিং মারা গেছে অনেকটাই। তবু যা অবশিষ্ট আছে, তাতে এক টাকমত বছর চল্লিশের প্রৌঢ়কে দেখতে পাই। ছুঁচলো দাড়ি, বাঁ কানে সোনার দুল ঝুলছে, হাবেভাবে একটু গুন্ডাগুন্ডা । সোজা কথা এই লোককে বাড়িতে নেমতন্ন করে খাওয়াতে যে কেউ দু’বার ভাববেন।
কোথাও লেখা নেই ইনি কে? তবু মারা যাবার আগে এই ছবিটাই লর্ড এলেসমেয়ার ন্যাশনাল পোর্টেট গ্যালারিতে দান করে গেলেন। তাঁরাও অতি যত্নে ছবিটা নিজেদের সংগ্রহে রেখে দিলেন। কারণ একটাই। সবাই বলে এটা নাকি শেক্সপীয়ারের পোর্টেট। আর তা যদি হয়, তবে জীবিত অবস্থায় শেক্সপীয়ারের একমাত্র ছবি।
কিন্তু তাকি? একটু খেয়াল করে দেখলেই ছবির ভদ্রলোককে ইতালীয়ান বা ইহুদী মনে হয়। ইংরেজ না। ভদ্রলোকের পোষাক বা ঝুলে থাকা সাদা জামার কলার ১৫৯০ থেকে ১৬১০ অবধি দারুণ জনপ্রিয় ছিল, ঠিক যে সময় শেক্সপীয়ার একের পর এক হিট নাটক উপহার দিচ্ছেন গ্লোব বা রোজ থিয়েটারে। সে সময় তিনি নিজের ছবি আঁকাতেই পারেন। কানে সোনার দুল দেখে তাঁর বোহেমিয়ান স্বভাব পরিস্ফুট। সে যে পয়সাওয়ালা তাঁর আর এক প্রমাণ, তাঁর পোষাকের রঙ। কালো। সেযুগে নেহাত বড়লোক না হলে কেউ কালো পোষাক পরার ফুটানি দেখাতে পারত না। কালো পোষাকে প্রচুর রঙ লাগে, আর কালো রঙ বেজায় দামি ছিল সেকালে। রাজাগজা বা অভিজাত ছাড়া তাই কেউ কালো পোষাক কেনার কথা ভাবতেই পারত না। কিন্তু ছবির এই ভদ্রলোক ভেবেছেন। শুধু ভাবেননি, কিনে, পরে, পোজ-ও দিয়েছেন। ব্যাস! এইটুকুই। ইনি কি সত্যিই শেক্সপীয়ার? জানি না। গোটাটাই লোকমুখে ছড়ানো রটনা। যদি শেক্সপীয়ার না হন, ইনি তবে কে? তাও আমাদের জানা নেই।
তাহলে শেক্সপীয়ার দেখতে কেমন ছিলেন?
অপশন বেশি নেই। এটাকে বাদ দিলে মাত্র দুটি। ১৬২৩ সালে প্রথমবার শেক্সপীয়ারের নাটকগুলো একত্র করে বিখ্যাত সেই ফার্স্ট ফোলিও প্রকাশ পায়। সেই বইয়ের ফ্রন্টিসপিসে শেক্সপীয়ারের যে তামার পাতে খোদাই করা ছবিটা ছিল, সেটাই নানা হাত ঘুরে, নানা ভাবে আমাদের কাছে এসেছে। উইলিয়াম শেক্সপীয়ার বলতে আমাদের চোখে যে ছবিটা ভাসে, সেটা এটাই। মার্টিন দ্রোশটের খোদাই করা এই জনপ্রিয় ছবিটি খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, এটা নেহাত মধ্যমানের এক কাজ। গোটা ছবিটাই ভুলে ভরা। ঠোঁটের অবস্থান ঠিক নেই, একটা চোখ অন্যটার চেয়ে বড়, একদিকের চুল অন্যদিকের তুলনায় লম্বা, মাথাটা বেলুনের মত, যেন সোজা কাঁধের উপরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেখে আগের ছবির মানুষটার সঙ্গে মেলানই যাচ্ছে না। এই লোকের কনফিডেন্স লেভেল বেশ কম, চোরচোর ভাব, চোখ দেখলেই মনে হয় এখুনি যেন শ্যামল মিত্র এই চোখ দেখে গেয়ে উঠবেন —
“ভীরু ভীরু চোখে চেয়ে চলে গেলে
দিলে ছোট ছোট স্মৃতি মনে”…
নাটকে যে শেক্সপীয়ারকে দেখি, সেই উদাত্ত মানুষ একেবারেই ছবিতে অনুপস্থিত। দ্রোশটের পক্ষে একটা কথা বলাই যায়। যে সময় এই ছবির কাজ তিনি করছেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি, হাতও তেমন পোক্ত না। তবুও তিনিই কি করে এই ছবির বরাত পেলেন? কারণ একটাই। একমাত্র তাঁর কাছেই রোলিং প্রেস ছিল। তামার পাতের খোদাই করতে যা অপরিহার্য। দ্রোশট নিজে কোনদিন শেক্সপীয়ারকে চাক্ষুষ দেখেন নি। এই ছবি যখন আঁকা হচ্ছে ততদিনে শেক্সপীয়ার মারা গেছেন বছর সাতেক। গোটাটাই তাঁর বন্ধুদের মুখে বর্ণনা শুনে আঁকা। কিন্তু সেটাও কি সঠিক হয়েছিল?
ফার্স্ট ফোলিও যার উদ্যোগ ছাড়া প্রকাশ পেত না, তিনি কবি বেন জনসন। ফোলিওতে এই ছবির সঙ্গে তাঁর লেখা ছোট্ট এক কবিতাও দেখতে পাই। কি লেখা ছিল তাতে?
XI. — ON THE PORTRAIT OF SHAKESPEARE.
(TO THE READER)
This figure that thou here seest put,
It was for gentle SHAKSPEARE cut,
Wherein the graver had a strife
With nature, to out-do the life :
O could he but have drawn his wit
As well in brass, as he has hithit,
His face ; the print would then surpass
All that was ever writ in brass :
But since he cannot, reader, look
Not on his picture, but his book.
এত প্রশংসাভরা লাইনগুলোর মুশকিল একটাই। বেন জনসন পরে নিজেই স্বীকার করেছেন, ছবি না দেখেই তিনি এই সার্টিফিকেটটা লিখেছিলেন। দ্রোশটের উপরে একটু বেশিই ভরসা করে।
বেন জনসন আফসোস করতে থাকুন, আমরা বরং আমাদের হাতের শেষ তুরুপের তাসটির দিকে চোখ ফেরাই। শেক্সপীয়ারের জন্মস্থান স্ট্যাফোর্ড অন অ্যাভন চার্চে প্রায় লাইফ সাইজ শেক্সপীয়ারের এক মূর্তি আছে। এই চার্চেই শেক্সপীয়ারকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। যিনি এই মূর্তি বানিয়েছিলেন তাঁর নাম গিরার্ট জ্যান্সেন, ১৬২৩ সালে তিনি এই মূর্তি বানান। এবং এই মূর্তি বানাতে যে ছবির দরকার পরে সেটা উনি কোথা থেকে পেয়েছিলেন? ঠিক ধরেছেন। দ্রোশটের করা খোদাই ছবি থেকে।
শেক্সপীয়ারের ভক্ত আর পণ্ডিতরা পাগল হয়ে গেলেন। এও সম্ভব! একটা লোক দিনের পর দিন লন্ডনের থিয়েটারে রাজত্ব করে গেল, তাঁর একটা ছবি অবধি নেই! এদিকে বহু নাম না জানা মানুষজন ওয়েল পেইন্টে দাঁত কেলাচ্চে। গবেষকদের যা স্বভাব, যা পান তাঁর মধ্যেই শেক্সপীয়ারকে খুঁজতে লাগলেন। মজার ব্যাপার তাঁদের মডেল ছিল কিন্তু ওই তিনটেই। তাঁরা সেই সামান্য পুঁজি নিয়েই নানা শিল্পকর্মে শেক্সপীয়ারের ভূত দেখতে শুরু করলেন।
কয়েকটার কথা বলা যাক। ফ্লেমিশ শিল্পী কার্ল ভন ম্যান্ডারের এক বিখ্যাত ছবি আছে। নাম চেজ প্লেয়ারস। তাতে ছুঁচলো দাড়ি ভদ্রলোক নাকি আদতে শেক্সপীয়ার। ঠিক যেমন ১৫৮৮ সালে কোন অজানা শিল্পীর আঁকা গ্র্যাফটন পরিবারের দখলে থাকা এক তৈলচিত্রের তরুণকে নিশ্চিতভাবে শেক্সপীয়ার বলেন কেউ কেউ। ১৫৮৮ সালে নিকোলাস হিলার্ডের আঁকা, এক অজানা হাত ধরে থাকা ভদ্রলোককে তো শেক্সপীয়ার প্রমাণ করেই ছেড়েছিলেন লেসলি হটসন। ১৯৭৭ সালে একটা বই-ই লিখে ফেলেছিলেন এই থিওরি নিয়ে। বইয়ের নাম শেক্সপীয়ার বাই হিলার্ড। অনেকে বিশ্বাস করেও ফেলেছিল। শেষে যখন জানা গেল, এই ছবি আসলে সাফোকের জমিদার লর্ড হাওয়ার্ডের, তখন কেলেঙ্কারির একশেষ। এই লিস্টির শেষ নেই।
শেষটা বলে শেষ করি। ১৫৯৭ সালে লেখা জন গেরার্দের বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ্যার বই “হার্বাল” এর টাইটেল পেজে, বেশ কয়েকজন মানুষের ছবি আছে। ২০১৫ সালের মে মাসে কান্ট্রি লাইফ পত্রিকা দাবি করেছে এদের একজন নাকি শেক্সপীয়ার নিজে। গেরার্ড এই বই যখন লিখছেন তখন শেক্সপীয়ারের দারুণ রমরমা। কিন্তু তা বলে বোটানির বইতে শেক্সপীয়ার? ইয়ে বাত কুছ হজম নেহি হুয়ি!
তাহলে মরালটা কি খাড়াইল? তাঁর আগের পরের হাজার হাজার মানুষ কেমন দেখতে ছিল তা নিশ্চিতভাবে জানা গেলেও শেক্সপীয়ারের এমন একটাও ছবি আজ অবধি খুঁজে পাওয়া গেল না, যা দেখে আমরা বলতে পারি, ভদ্রলোক এই রকম দেখতে ছিলেন!
ফলে কেউ যদি শুরুর প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেই বসে, তবে একটাই উত্তর হবে।
“জানি না”।
এলিজাবেথীয় থিয়েটার নিয়ে এমন সুস্বাদু ফর্মে কৌশিক ইতিহাসকে হাজির করছেন যা নাট্যের ছাত্রছাত্রীদের খুবই কাজে লাগবে।
👌👌👌