কমল সাহা
|| কালের প্রতিমা || ১৯৪৯
ভারতের কম্যুনিস্ট আন্দোলনে বাম সংকীর্ণতার যুগ। একসঙ্গে বহু শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী গণনাট্য ছাড়লেন। ২৮.২.১৯৪৯ দমদম বিমানবন্দর আক্রান্ত। পুলিশের গুলিতে ৬ জন নিহত। ড: বিধানচন্দ্র রায়ের ঘোষণা: ‘কম্যুনিস্টদের সহযোগিতায় বৈপ্লবিক সাম্যবাদের আক্রমণ’। ২৭.৪.১৯৪৯ রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি আন্দোলনে মহিলা মিছিলে পুলিশের গুলিচালনা। মারা গেলেন লতিকা সেন, প্রতিভা গাঙ্গুলী, অমিয়া দত্ত এবং গীতা সরকার। কম্যুনিস্টদের নানাভাবে দোষারোপ করে চলেছেন নেহেরুজী। তিনি আমেরিকায় গিয়ে বিশ্বজুড়ে কম্যুনিস্টদের উৎপাত বন্ধ করার ৯ দফা কার্যসূচি লিখলেন। ২.৫.১৯৪৯ বোম্বের ১১টি কম্যুনিস্ট পত্রিকা নিষিদ্ধ। ২৭.৯.১৯৪৯ মাদ্রাজে কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। সর্দার প্যাটেলের মতে : এরা দেশের শ্রমিকশ্রেণীর বড় শত্রু।
১২.২.১৯৪৯ মহাত্মা গান্ধী-হত্যার বিচারের রায়। নাথুরাম গডসে ও নারায়ণ আপ্তের প্রাণদণ্ড। ২৩.৪.১৯৪৯ তিন লক্ষ কম্যুনিস্ট সৈন্যের ইয়াংসী অতিক্রম… চীন বিপ্লব সমাপ্তির পথে … বেজিং-এ লাল পতাকা… ১৭.৮.১৯৪৯ মাও সে তুং মারা গেলেন যক্ষ্মা রোগে। প্রতিবছর এই রোগে ভারতে মরছেন ৫ লক্ষ মানুষ! দুই বঙ্গে তীব্র সংখ্যালঘু নির্যাতন। পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু এসেছে ৮০ হাজার। পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মারা গেছে ৬ লক্ষ নর নারী! দেশবিভাগের পরিণাম!
গণনাট্য সংঘ নিয়ে মেতে উঠেছেন সলিল চৌধুরী। ‘শপথ’ কবিতা লিখলেন কাকদ্বীপের তেভাগা আন্দোলন নিয়ে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছোটগল্প ড্রেসিং টেবিল, আদাব। একাংক নাটক জনান্তিক, সংকেত, এই মাটিতে, অরুণোদয়ের পথে (রাইজিং অফ দ্যা মুন)। উৎপল দত্ত বর্তমানে স্টেটসম্যান পত্রিকার কোর্ট রিপোর্টার। শেক্সপিয়রের ইংরেজি নাটকে অভিনয় করে চলেছেন। কালচারাল গ্রুপ প্রযোজনা করেছে ঋত্বিক ঘটকের ‘জ্বালা’ নাটক।
পেশাদারী মঞ্চে এবছর অভিনীত নাটক ৯০ টি; নতুন নাটক মাত্র ১৩টি; মোট অভিনয় ১৩৭৫ রজনী। কালিকায় তারক মুখার্জীর ধর্মোৎসব ‘যুগদেবতা’ (১৮০); মিনার্ভায় কিন্নরী (৮৭), আত্মদর্শন (৮০); রংমহলে শচীন সেনগুপ্তর আবুন হাসান (৩৫); শ্রীরঙ্গমে শিশিরকুমার — পরিচয় (৫৮) এবং আলমগীর (২৯); স্টারে মহেন্দ্র গুপ্ত –
বিজয় নগর (৪৭), ছত্রপতি শিবাজী (৪৪), কালিন্দী (৩৪), গোলকুন্ডা (৩৩)।
|| পথিকের মহলা || ৪৯
নির্দেশক শম্ভু মিত্র ভয়ংকর খুঁতখুঁতে। সামান্য ভুল ত্রুটি, সামান্য বিশৃঙ্খলা সহ্য করেন না। কঠোর অনুশীলন চলছে। মহলা চলবে অনির্দিষ্টকাল। যতোদিন নাটকটা সম্পূর্ণ নিখুঁত না হয়। প্রতিটি সংলাপ, শব্দ, মুদ্রা, মুভমেন্ট, বিজনেস, পজ, পোজ নিয়ে তিনি চিন্তিত, উদ্বিগ্ন, দ্বিধাগ্রস্ত। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা যেন যুদ্ধ জয়ের প্রস্তুতি…
বৃটিশদের আইন অনুযায়ী পান্ডুলিপি জমা দেয়া হয়েছে লালবাজারে। ওঁরা অনুমোদন করলে নাটকটা হবে। প্রযোজনা খরচ অনেক, দলের প্রায় সকলেই বেকার – টাকা আসবে কোত্থেকে! Full house valuetion ধরে কালেকটরিতে ট্যাক্স জমা দিতে হবে। মঞ্চ ভাড়া, পোশাক, আলো, সেট, সঙ্গীত… কম পক্ষে পাঁচ ছ’শো টাকার বাজেট। সেকালের হিসেবে অনেক।
শ্রীরঙ্গম কিংবা রংমহল হয়তো পাওয়া যাবে না। নবান্ন করতে দিয়ে ওঁরা নিজেরাই বিপাকে পড়েছিল। নতুন ধরনের নাটক দেখে শ্যামবাজারের অভ্যস্ত দর্শক দিশেহারা – তাঁদের দাবী মেটাতে শিশির কুমার বাধ্য হয়েছিলেন এই পথিকের দুঃখীর ইমান করতে! তাছাড়া ওই সব মঞ্চের ভাড়াও প্রচুর।
সবাই বিস্তর ভাবনা চিন্তার পর সিদ্ধান্ত নিলেন শেয়ালদা রেলওয়ে ইন্সটিট্যুট মঞ্চ নেয়া হবে। ট্যাক্স এড়ানোর জন্য করা হবে ডোনেশন নিয়ে প্রাইভেট শো। টিকিট বিক্রি করা হবে না। শুরু হলো চাঁদা তোলার অভিযান। বন্ধুবান্ধবদের কার্ড গছানোর তীব্র প্রচেষ্টা। দলের সবাই ১০ টাকা চাঁদা দিলেন। দু-একজন কুড়ি টাকা।
এইসব ‘অ্যামেচার অর্বাচীনদের’ সঙ্গে দাঁড়াতে পারছিলেন না তুলসীবাবু। শম্ভু মিত্রের নির্দেশনা অত্যন্ত বিরক্তিকর — অকারণে সময়ের ক্ষতি – অহেতুক কঠোর! তাছাড়া ছেলেটি নির্দেশনার কিছুই বোঝেন না! এই বয়সে এসব দলের সঙ্গে থাকবে নিজের মান সম্মান হারানোর সম্ভাবনা! মহর্ষি কিন্তু চিনেছিলেন শম্ভু কে। হঠাৎ একদিন মহলাকক্ষে ক্ষোভ প্রকাশ করবেন নাট্যকার: ‘এইসব ধষ্টামোর মধ্যে আমি নেই।’ চলে গেলেন। দল বিপর্যস্ত। অমন সুন্দর যশমান কে করবে? আবারো শম্ভু মিত্র গেলেন মহর্ষির পরামর্শে। অনেক মিনতির পর যশমানের মান ভাঙলো। তিনি যোগ দিলেন নতুন উৎসাহে। এই সময়টার মহম্মদ ইসরাইল নিয়ে এলেন সবিতাব্রত দত্তকে। তাঁকে দেয়া হলো ডাকাতের ভূমিকা। ঋত্বিক ঘটকের খোঁজ করতে এসে কুমার রায় শুরু করে দিলেন কয়লাখনির শ্রমিকের মহলা। পথিকের মহলা চলেছিল এক বছর!
ক্রমশঃ
অত্যন্ত জরুরি লেখা।
নাট্যগবেষক কমল সাহা মহাশয়ের লেখায় অন্য রকম ম্যাজিক আছে।এ ধরণের লেখা এক প্রকার কাটাছেঁড়া খেলার মতো। সিম্ফনি হয় দারুণ।