শ্বশুরবাড়ি এসে অনেকেই আর থিয়েটার করতে পারে না। অনেক অভিনেত্রীর কাছেই বিয়ের আগের থিয়েটারের জীবন অতীতের স্মৃতি হয়ে যায়। কিন্তু দিনাজপুরের শিউলির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। বরং শ্বশুরবাড়িতে এসেই তার জোরকদমে থিয়েটার চর্চা শুরু। কলকাতা থেকে অনেক অনেক দূরে থেকেও উত্তর এবং দক্ষিণ দিনাজপুরের বেশ কিছু দল থিয়েটারচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই সব দলে শিউলি দাসের মত অনেকেই থিয়েটারের দক্ষ অভিনেত্রী হয়ে উঠেছে থিয়েটারকে ভালবেসে।
রায়গঞ্জের মেয়ে শিউলি দাসের বিয়ে হয়েছে কালিয়াগঞ্জের নন্দকুমার ঘোষের সঙ্গে। আর সেই কালিয়াগঞ্জেই শুরু শিউলির থিয়েটার জীবন। রায়গঞ্জে ছোটবেলাটা আর পাঁচজনের মতই। বাবার চাকরির সূত্রেই বিয়ের আগের জীবনটা কেটেছে রায়গঞ্জের কাছে দুর্গাপুরে । এই দুর্গাপুর বিখ্যাত ভূপালপুর রাজবাড়ির জন্য। সেই জীবনে লেখাপড়া নিয়েই আগ্রহ বেশি ছিল শিউলির। থিয়েটারে তেমনভাবে জাঁকিয়ে রাজত্ব করতে পারেনি সেই জীবনে। তবে একটা সাংস্কৃতিক চিন্তাধারাকে শিউলি ছোট থেকেই লালন করে এসেছে। বিয়ের আগের জীবন আর বিয়ের পরের জীবনের মধ্যে প্রথম পর্বের জীবনে প্রাধান্য পেয়েছে বিদ্যাচর্চা। আর দ্বিতীয় পর্বের জীবনে প্রাধান্য পেল নাট্যচর্চা। এখন সে দিনাজপুর এলাকায় সুপরিচিত অভিনেত্রী।
বাবার কর্মস্থল সূত্রে রায়গঞ্জ সন্নিহিত দুর্গাপুরেই প্রাক প্রাথমিক থেকে কলেজ শিক্ষা। তবে এই জীবনে আবৃত্তি বিতর্ক, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা ইত্যাদি প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল শিউলির। পাশাপাশি থিয়েটারের প্রতি একটা টান ছিলই। রায়গঞ্জ আর কালিয়াগঞ্জ কাছাকাছিই। খানিকটা নাটকের টানেই কালিয়াগঞ্জের ‘যাত্রিক’ নাট্যদলের মহলাকক্ষে যেত শিউলি। কখনও কখনও সেই দলের কল শোতেও গিয়েছে। এর ফলে থিয়েটার করার সুপ্ত ইচ্ছেটা তার মনের গোপনে বাসা বেঁধেছিল। আর শিউলির বিয়ে হল যে নন্দকুমার ঘোষের সঙ্গে, তিনিই যাত্রিক দলের নাট্যকার এবং অন্যতম নির্দেশক ও কর্ণধার। শিউলি মাঝে মাঝে ভাবে, তার জীবনের এই গল্পটা তো অনেকটা নাটকের মতই।
বিয়ের পর তো শিউলি যাত্রিক দলের ঘরের লোক হয়ে গেল। শ্বশুরবাড়িতেই নাটকের দলের নানা কাজকর্ম চলে। সেট তৈরি করে দলের ছেলেরা, সেখানেই নাটক পড়া হয়, নাটকের মহলাও। এসবের মধ্যে জুড়ে থাকতে ভাল লাগে শিউলির। ক্রমশ অভিনয় করার ইচ্ছেটা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠতে লাগল। ২০০৬ সাল থেকে যে যাত্রিক দলটাকে সে চেনে, সেই দলে অভিনয়ের প্রথম সুযোগ আসে ২০১১ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে “মুক্তির উপায়” নাটক লিখেছিলেন তাঁর স্বামী নন্দবাবু। সেই নাটকেই যাত্রিক দলে তার মঞ্চে নামা প্রথম। তবে রীতিমত অডিশন দিয়ে নাটকের হৈমবতী চরিত্রে নির্বাচিত হতে হয়েছিল শিউলিকে। প্রায় পাঁচ সাত জনের মধ্যে অডিশনে হৈমবতীর জন্য নির্বাচিত হয়েছিল শিউলি। আর নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার পর রীতিমত নজরকাড়া অভিনয় করে চমকে দিল দর্শকদের। অভিনেত্রী হিসাবে একটা পরিচিতি ঘটে গেল প্রথম নাটকেই। এ নাটকের অনেকগুলি আমন্ত্রিত অভিনয় হয়েছিল বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন মঞ্চে। আর সর্বত্র হৈমবতীর চরিত্রে শিউলির অভিনয় প্রশংসিত হল। দলেও গুরুত্ব বাড়ল তার। নাট্যকার নন্দকুমার ঘোষের স্ত্রী শিউলির অন্য পরিচয় হল অভিনেত্রী হিসাবে। বেশ ভাল লাগত তার। নাটকটির নির্দেশক ছিলেন দলের সিনিয়র ডিরেক্টার নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী। তিনিও খুশি হাতের কাছে একজন অভিনেত্রী পেয়ে। সেই শুরু, কিন্তু থিয়েটারের পথে তার চলা অব্যাহত রইল।
তবে থিয়েটার নিয়ে তার একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতাও আছে। দল থেকে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মূক বধির ছেলেমেয়েদের নিয়ে থিয়েটার করার। কাজটা কঠিন জেনেও খানিকটা সামাজিক দায়িত্ব হিসাবে এই কাজের মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছিল শিউলি। মূক বধিরদের নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বেশ কয়েকটি নাটক নির্মাণ করেছিল শিউলি। একটানা ৯ বছর এই কাজে যুক্ত থেকে ৭ টা নাটক নির্মাণ করেছে সে। শুধু তাই নয় , বিভিন্ন হোম এর আবাসিক ছেলেমেয়ে, স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়েও নাটকের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে । এদের কর্মশালার মাধ্যমে নাট্য প্রশিক্ষণ দেয় সে। পাশাপাশি দলের নানা প্রযোজনায় অভিনয় করে। শুধু অভিনয় নয়, আসলে দলের সমস্ত কাজের সূতিকাগৃহ তো তার শ্বশুরবাড়ির অঙ্গন। তাই দলের সব কাজেই হাত লাগাতে লাগাতে পুরোদস্তুর নাট্যকর্মী হয়ে উঠেছে। আর নিজের নাট্যচর্চাকে গভীর থেকে গভীরতম করে তোলার জন্য নাট্যব্যক্তিত্ব অঞ্জন দেব, গৌতম হালদার, অশোক প্রামাণিক, বরুণ কর, চেনা মানুষ কল্যাণবাবুর অধীনে নাটকের কর্মশালায় অংশ নিয়েছে। নাটকের পাঠ নিয়েছে। প্রযোজনাভিত্তিক কর্মশালায় যুক্ত হয়েছে। থিয়েটারের যে প্রথম পাঠ শুরু হয়েছিল শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর প্রেরণায়, তা পরিপূর্ণতা পেয়েছে এইসব কর্মশালায়। অঞ্জন দেবের সঙ্গে “জরিনা বিবির কিসসা” নাটকে অভিনয় করেছে। গৌতম হালদারের ওয়ার্কশপে জসীমুদ্দিনের “নকশীকাঁথার মাঠ ” অবলম্বনে যে প্রযোজনাভিত্তিক কর্মশালায় নাটক তৈরি করেছিলেন তাতে শিউলি সামুর মা এর চরিত্রে অভিনয় করেছিল।
জীবনের একটু পরের দিকে নাট্যচর্চা শুরু হলেও বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেছে। দলের কল শোতে অভিনয়ের পাশাপাশি দলের অনেকটাই তাকে দেখতে হয়। এইসব থিয়েটারের কাজ তার জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। তার অভিনীত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : মুক্তির উপায়, চাকভাঙা মধু, জরিনা বিবির কিসসা, জীয়নকাঠির সন্ধানে, পাপপুণ্য, বিপন্ন নীলকণ্ঠ,এক জাদুকর জুজু, সাপলুডো, ঝরা কুসুম, নকশিকাঁথার মাঠ। দূরদর্শন নাটকেও অভিনয় করেছে। বিভিন্ন নাটকে বিচিত্র সব চরিত্র। যেমন খেলা নাটকে ৮৭ বছর বয়সের বৃদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করতেও পিছপা হয়নি। তাই থিয়েটারের সঙ্গে মিতালি দিনাজপুরের অভিনেত্রী শিউলির কাছে সত্যিই যেন একটা গল্পের মত। শ্বশুরবাড়িতেই মহলা, সেখানেই তৈরি হয় নাটকের পোশাক, মঞ্চের সেট আর এসবের মধ্যে থাকতে থাকতে শিউলির মনে হয়, থিয়েটার তো তার বাড়ির উঠোনেই। আর সেই উঠোনে অভিনয়ের ‘শিউলি’ সুবাস ছড়িয়ে পড়ে সারাক্ষণ।