থিয়েটারের সব কাজে আগ্রহ শ্রেয়সীর – বিজয়কুমার দাস

থিয়েটার একটা সমবেত প্রয়াস। একা একা থিয়েটার হয় না। প্রয়োজন হয় একটা দলগত শক্তি। সাধারণত অভিনয় করার জন্য থিয়েটারে যতজন আসে, থিয়েটারের অন্য কাজ করার আগ্রহ নিয়ে কিন্তু ততজন আসে না। বনগাঁ থিয়েটার ফোরাম এইরকম একটা লক্ষ্যকে নিয়ে কাজ করে, যাতে সবাই সবটা দেখতে পারে। সীমান্ত এলাকা বনগাঁর মেয়ে শ্রেয়সী সেইরকম ইচ্ছাকে সামনে রেখেই থিয়েটারে এসেছে। অথচ শ্রেয়সীর অভিনয় অভিজ্ঞতা শুরু হয়েছিল যাত্রা মঞ্চে। শ্রেয়সীর ছোটবেলায় যাত্রাগানের চল ছিল। বিভিন্ন গ্রাম শহরে কলকাতার দলের যাত্রাগান হতো।পাশাপাশি গ্রামেগঞ্জে গড়ে উঠেছিল যাত্রাদল।নানা পার্বণে উৎসবে তখন যাত্রাগান হতো।

শ্রেয়সীর বাবা শম্ভু পাল যাত্রামঞ্চের দাপুটে অভিনেতা ছিলেন। শক্তি সঙ্ঘ যুব নাট্য সংস্থা নানা যাত্রাপালা করত। ছোটবেলায় বাবার যাত্রাভিনয় দেখতে দেখতে অভিনয়ের প্রতি একটা আকর্ষণ তৈরি হয়। ঘুমের ঘোরে কানের কাছে বাজত যাত্রার কনসার্ট। নানা চরিত্রে বাবার অভিনয় শ্রেয়সী দেখেছে যাত্রাপালায়। বাবার হাত ধরেই যাত্রার রিহার্সাল দেখতে যেত। রিহার্সাল দেখতে দেখতে অভিনয়ের ইচ্ছেটা আরো প্রবল হয়ে উঠেছিল। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে সেই যাত্রাদলেই একটি শিশু চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ ঘটে গেল তার। সেই চরিত্রে যাত্রার আসরে মঞ্চেও নেমেছিল এবং সেটাই শ্রেয়সীর প্রথম অভিনয়। পরে অবশ্য বড় হয়ে ওঠা এবং পড়াশোনার কারণে তেমন নিবিড় সম্পর্ক রাখা যায়নি অভিনয়ের সঙ্গে। তাছাড়া যাত্রা অনেকটা অবলুপ্ত শিল্প হয়ে গেল একসময়। কিন্তু অভিনয়ের ইচ্ছেটা থেকে গিয়েছিল।

এমন সময় খবর পায়, বনগাঁতেই থিয়েটার ফোরাম নামে একটা দল থিয়েটারের কাজকর্ম করছে। ফেসবুকে সেই দলের নানা নাট্য উদ্যোগের খবর পায়। নিজেই আগ্রহী হয়ে থিয়েটারের দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল শ্রেয়সী। শুধু অভিনয় নয়, দলের নানা কাজকর্মেও যুক্ত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এভাবেই সে যুক্ত হয়ে যায় থিয়েটার ফোরামের বনগাঁ শাখার সঙ্গে। কিন্তু দলের পরিচালক সত্যজিৎ তাকে প্রথমদিকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দিতে ভরসা করেনি। কিন্তু রিহার্সাল দেখতে রোজই হাজির হতো। অবশেষে সুযোগ এল। একটি চরিত্রে নির্ধারিত শিল্পীর পরিবর্তে সুযোগ পেল শ্রেয়সী।

শ্রেয়সীর লেখাপড়া,বেড়ে ওঠা সবই বনগাঁ শহরেই। আনন্দমার্গ প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুমুদিনী উচ্চ বিদ্যালয়, দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়ের জীবন অতিক্রম করে শ্রেয়সী পাল একজন অভিনেত্রী এবং সব সময়ের থিয়েটারকর্মী হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার পাঠ নিচ্ছে। একসময় কলঙ্কিনী বধূ, একটি পয়সা, মীরার বঁধুয়া যাত্রাপালায় অভিনয় করার ফলে অভিনয়ের প্রতি যে টান তৈরি হয়েছিল সেই টানেই সে থিয়েটারে এসেছে।অবশ্য স্কুলেও বার দুয়েক নাটকের মঞ্চে নামার সুযোগ ঘটেছে। কিন্তু থিয়েটারে সে নিজেকে একজন শিক্ষার্থী বলে মনে করে।দলের সব প্রযোজনাতেই অভিনয় করতে হবে এমন বায়না তার নেই। সে হতে চায় দলের একজন নির্ভরযোগ্য থিয়েটারকর্মীও।

থিয়েটার ফোরামের “বদলে দিন” নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তার থিয়েটার জীবন শুরু।নিজের দল ছাড়া অন্য দলে অভিনয়ের আগ্রহও নেই তেমন। দলের বেশ কয়েকটি প্রযোজনার সঙ্গে সে যুক্ত। বিভিন্ন রকমের চরিত্রে মঞ্চে নামতে চায় সে আগামীতে। মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক মেলবন্ধন, যোগাযোগের একটা শক্তিশালী মাধ্যম বলে সে মনে করে থিয়েটারকে। দলের নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড, প্রকাশনার কাজে সে সহায়ক শক্তি হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই।কোভিড পরিস্থিতিতে নিজের দল থেকে একটানা ১২৫ দিন ধরে বনগাঁ রেলওয়ে স্টেশনে যে থিয়েটারের হেঁসেল চালানো হয়েছে তার পুরোভাগে থাকার সুযোগ হয়েছিল তার। পুজোয় দরিদ্রদের পোশাক বিতরণ, ১০০ শিল্পী পরিবারকে মাসে দুবার অত্যাবশকীয় পণ্য তুলে দেওয়া, থিয়েটার ফেস্টিভেলের নানা কাজেও সে দায়বদ্ধ কর্মী। থিয়েটার নিয়ে কোন কর্মশালা, প্রশিক্ষণের সুযোগ হয়নি। শ্রেয়সী মনে করে থিয়েটার করতে করতেই অভিনেতা বা অভিনেত্রী হয়ে ওঠা যায়। প্রশিক্ষণ যা কিছু তা নিজের দলেই। তবে আগামীতে থিয়েটারের খুঁটিনাটি শেখার সুযোগ পেলে প্রশিক্ষণ বা কর্মশালায় যোগ দেওয়ার ইচ্ছা আছে।

করোনা পরিস্থিতিতে থিয়েটার কিছুটা থমকে দাঁড়ালেও শ্রেয়সী মনে করে, এই পরিস্থিতিতেই থিয়েটার কিন্তু বিকল্প পথ খুঁজে নিয়েছে। তৈরি হয়েছে নানা থিয়েটার স্পেস।থিয়েটারের মানুষজন বিপন্ন নাট্যকর্মী, নেপথ্যকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এটা পজিটিভ দিক থিয়েটারে।

থিয়েটারকে ভালবেসে থিয়েটারে এসেছে শ্রেয়সী। তাই রুটি রুজির মাধ্যম নয়, থিয়েটার তার কাছে ভালবাসার মাধ্যম।অভিনীত চরিত্রের মধ্যে সব চরিত্রকেই সে প্রিয় চরিত্র মনে করে। বিশেষ কোন চরিত্রকে নয়। একজন মেকাপ আর্টিস্ট হিসাবেও সে দায়িত্ব পালন করে থাকে। এছাড়াও নৃত্যশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তার দলে কোন স্ক্রিপ্ট ছাড়াই খানিকটা খেলার মাধ্যমে থিয়েটার নির্মাণ করা হয়। নাটকের সংলাপ, গল্প, চরিত্রের নির্মাণ সব এই পদ্ধতিতেই হয়। যাতে নিজের অনেকটা ভূমিকা থাকে। একটা সৃজনশীল মন গড়ে ওঠে। তাই থিয়েটার তার কাছে সৃজনশীল হয়ে ওঠার একটা মাধ্যমও।বদলে দিন, লকডাউনে একটি মেয়ে প্রভৃতি নাটকে এভাবে অভিনয় করে সে পেয়েছে। শুধু অভিনেত্রী নয়, একজন পুরো থিয়েটারকর্মী হয়ে ওঠার পাঠ এভাবেই নিচ্ছে বনগাঁর শ্রেয়সী পাল।

2 thoughts on “থিয়েটারের সব কাজে আগ্রহ শ্রেয়সীর – বিজয়কুমার দাস

  1. এখানে দুটি তথ্য সম্পূর্ণ ভাবে ভুল আছে । সত্যজিৎ দাস নামটা সত্য জিৎ হবে । দাস টাইটেলে এই দলে কেউ নেই ।
    আর নাটকের নাম ‘দলে দিন’ নয় ‘বদলে দিন’ হবে ।

    গত কয়েক দিন ধরে বেশ কয়েকবার জানানো হয়েছে । কিন্তু তা বদলানো হয়নি । অনুরোধ রইল এটা ঠিক করে দিন ।

    অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদেরকে ।

Comments are closed.