দীপাঞ্জনা শর্মা
করোনা অতিমারি পর্ব প্রায় কাটিয়ে আসার পরে সমস্ত রকম সামাজিক উৎসবে বাঙালির সানন্দ যোগদান চোখে পড়ার মতো ।গত পুজোর সময়েও যে কিন্তু কিন্তু ভাব ছিল ,তা এখন কেটে গিয়েছে অনেকটাই ।আর সংস্কৃতি চর্চার পৌষ মাসে উৎসব যখন হাতছানি দেয়, তা সে ব্যক্তিগত হোক বা সামাজিক ,বাঙালির পক্ষে তার ডাক উপেক্ষা করা দুষ্কর। সেই আহ্বাণ চতুর্দিকে ছড়িয়েই মালদার দুর্গাকিংকর সদনে গত ২৭ ও ২৮ শে নভেম্বর ,২০২১ এ চারটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ভিন্ন স্বাদের নাটক শীতের বেলায় উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল মালদার নাট্য প্রেমী জনতাকে। এই নাট্যোৎসবের ব্যবস্থাপনায় ছিল ‘মালদা অন্যরঙ্গ’। প্রতিদিনই দুটি করে নাটক। প্রথম দিন ‘মালদা অন্যরঙ্গ’ প্রযোজিত ‘ফ্যাতাড়ু’স’ ও ‘দিনাজপুর কৃষ্টি’ প্রযোজিত ‘পিঞ্জর ভাঙ্গা রাজহাঁস’ এবং দ্বিতীয় দিন ‘মালদা অন্যরঙ্গ’ এর দ্বিতীয় প্রযোজনা ‘অথঃ চ অনাম্নী’ ও ‘দমদম শব্দমুগ্ধ’ প্রযোজিত ‘স্যাফো চিত্রাঙ্গদা’। ঘড়ির কাঁটা ধরে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ,মাননীয় অতিথিদের অতি সংক্ষিপ্ত অথচ দায়িত্বশীল বক্তব্য সুর বেঁধেছিল গোড়াতেই ।ইংরেজবাজার পুরসভার পুরপ্রধান যখন বলেন যে ,একটা শহর শুধু সৌন্দর্যায়নে বাঁচেনা, সে বাঁচে তার সাংস্কৃতিক চর্চায়- তখন ফেটে পড়া হাততালি নয় ,বরং দর্শকদের সপ্রতিভ মুখগুলিই বলে দিচ্ছিল, আমরা কীভাবে বক্তব্যের তাৎপর্য অন্তরে গ্রহণ করতে শিখেছি।
চারটি নাটকের কোনোটিরই প্রত্যক্ষ বিষয় মহামারী বা লকডাউন ছিলোনা, কিন্তু সবক’টির মধ্যেই সিস্টেম -আবদ্ধ সমাজে থেকেও শাশ্বত বিদ্রোহী সত্তার জাগরণ স্পষ্ট ছিলো।ফ্যাতাড়ু’স এ নবারুণ ভট্টাচার্যের মদন, ডি .এস, পুরন্দর ,বদি, দণ্ডবায়সেরা তাদের ‘অসহ্য’ ‘অমার্জিত’ প্রশ্নগুলি নিয়ে হাজির হয়েছে। নবারুণ যখন ফ্যাতাড়ু লিখেছিলেন সেই সময়কার রাজনৈতিক পটভূমি আজ একশো আশি ডিগ্রি পরিবর্তিত, তবু প্রতিবাদ আর লড়াইয়ের ভাষা পাল্টালো না ,পাল্টায় না ।বাঙালির গর্বের মতো বাঙালির লজ্জাও ইতিহাস হলো। ‘মালদা অন্যরঙ্গ’ এর এই প্রযোজনাটি ‘চন্দ্রচূড়’ উদ্দেশ্য করে ‘শর’ ছুঁড়েছে। মঞ্চসজ্জা ভালো ,আলো নিয়ে আরেকটু যত্ন প্রয়োজন ।তরুণ অভিনেতারা প্রায় সকলেই প্রতিশ্রুতিবান ।দণ্ডবায়সের অভিনয় ভোলার মতো নয় ।প্রথম দিনের দ্বিতীয় প্রযোজনায় ‘দিনাজপুর কৃষ্টি’কে কিছুটা শ্লথ মনে হয়েছে। অশ্বঘোষের মূল নাটক ‘সুন্দরানন্দ’ থেকে মোহন রাকেশের ‘লহেরোঁ কি রাজহংস’ এর অনুবাদে ‘পিঞ্জর ভাঙা রাজহংস’ মঞ্চায়িত হলো। কপিলাবস্তুর কুমার নন্দ ও তাঁর স্ত্রী সুন্দরীর সম্পর্কের টানাপোড়েন এই নাটকের মূল। গৃহত্যাগী সিদ্ধার্থ ও যশোধরার বৈরাগ্য রাজৈশ্বর্যকে উপহাস করে বলে সুন্দরীর ধারণা ।তাই সে কামোৎসবের আয়োজন করে কুমার নন্দ সহ সমস্ত রাজপুরুষ কে দেখাতে চায় শৃঙ্গার মহিমা! কিন্তু কুমারের বুদ্ধশরণ শেষ অবধি তাকেও টেনে নেয় একই পথে ।ত্যাগের পথে ভোগের মুক্তি ঘটে। বিষয়টি প্রশ্নাতীত, কিন্তু তা চিত্রনাট্যের দৌর্বল্য ঢাকতে পারেনি ।এই নাটকের দুটি প্রাপ্তি -আবহ এবং আলো ।মঞ্চসজ্জা ও পোশাক একটু ভারি। অভিনয় ভালো লেগেছে সুন্দরী ও কৃষ্ণাঙ্গের। দ্বিতীয় দিনের প্রথম নাটক ‘অথঃ চ অনাম্নী’ এর আলোচনায় প্রথমেই বলা দরকার অসামান্য কোরিওগ্রাফির কথা ।পরাশর -মৎস্যগন্ধা মিলন দৃশ্যে দুর্দান্ত নৃত্যাভিনয় বহুকাল মনে থাকবে। বুদ্ধদেব বসুর ‘অনাম্নী অঙ্গনা’ অবলম্বনে রূপায়িত এই নাটকে কুরুবংশের এক রহস্যগাথা প্রকাশ পেয়েছে ।শান্তনুপত্নী রাজমাতা সত্যবতীর নির্দেশে বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর অম্বিকা ও অম্বালিকা বাধ্যত ও ভয়ার্ত মিলনে জন্ম দিয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডু র । সিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারী পাবার উদ্দেশ্যে সত্যবতী পুনরায় অম্বিকাকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন দ্বারা নিয়োগের জন্য আদেশ করেন। এজন্য নিজের জীবনের গূঢ়তম কথাও জানিয়ে দেন তাকে যে, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন তাঁরই গর্ভজাত! কিন্তু নারাজ অম্বিকা ছলের আশ্রয় নিয়ে দাসীকে নিযুক্ত করে এই কাজে। সেই দাসীগর্ভেই জন্মান বিদুর ।মহাভারতের সর্বোৎকৃষ্ট মানব চরিত্র বিদুর অথচ তাঁর মায়ের পরিচয় মহাকাব্যে মূল্যহীন ।সে অনাম্নী! পরিবার ও সমাজের ষড়যন্ত্রের শিকার এক চিরকালীন উপেক্ষিতা নারী। নাটকের সাদামাটা মঞ্চসজ্জা যথোপযুক্ত শুধু দীর্ঘ সংলাপে অভিনেত্রীরা আর একটু যত্ন নিলে সর্বাঙ্গ সুন্দর হতো প্রযোজনাটি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ‘মালদা অন্যরঙ্গ’ এর এই নাটকটি এবছর পশ্চিমবঙ্গ নাট্য উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়েছে ও অভিনীত হয়েছে। উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি তে নাটকটি সাফল্যের শিখরে পৌঁছোক এই কামনা করি। চতুর্থ তথা নাট্যোৎসবের শেষ নাটক ‘দমদম শব্দমুগ্ধ’ প্রযোজিত ‘স্যাফো চিত্রাঙ্গদা’। সমাজ অস্বীকৃত প্রেম, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য তত্ত্ব ,লিঙ্গ রাজনীতি -অনেকগুলো বিষয় উঠে এসেছে এই নাটকে।চিত্রনাট্য ,অভিনয় ও সাবলীলতা বুঝিয়ে দেয় প্রযোজনাটি সাবালক। চিত্রাঙ্গদা ও স্যাফো যথাক্রমে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দুই নারী চরিত্র, সাহিত্য ক্ষেত্রে যাঁরা অমর। প্রথমজন পৌরাণিক ,দ্বিতীয়জন ঐতিহাসিক। বর্তমানের কল্পনায় তাঁরা আধুনিকা, পরস্পরের প্রেমে মগ্না। কিন্তু প্রকৃতি তথা সমাজ-অস্বীকৃত এই প্রেম রাষ্ট্র তথা পুরুষ সমাজ দ্বারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি স্বনামে ,রূপকে আজকের বস্তুবিশ্বে মূর্তিমান প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নাটকের ভাবনা ও নির্মাণ কে টুপি তোলা কুর্নিশ।
দুদিনের উৎসবের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ভালোলাগার রেশটুকু সংস্কৃতিপ্রেমী মনকে ভরিয়ে রেখেছে। তিন কন্যার উদ্বোধনী নৃত্যের সৌকর্য সম্পূর্ণতা পেয়েছে অনুষ্ঠান শেষের মার্জিত সমাপ্তিতে। ‘মালদা অন্যরঙ্গ’ এর কর্ণধার সৌমেন ভৌমিক নাটক কে অস্ত্র করে নতুন ছেলে মেয়েদের দিয়ে থিয়েটার ও সমাজের প্রতি দায়িত্বের নতুন দিক দর্শিয়েছেন। সবশেষে বলা যায় ,শহরবাসী তথা নাট্যপ্রেমী জনতার মনে নতুন আশার আলো জ্বলে উঠলো এই নাট্যোৎসবের মাধ্যমে।