শীতলার দয়া | দীপা ব্রহ্ম, পর্ব – ২২

সেদিনটা আর পাঁচটা দিনের মতোই। তবে বিশেষভাবে বলতে গেলে সে দিনটা ছিল মহরম। সম্ভবত ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮, নদীর ধারে সীমান্ত শহর টাকির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম। একটি নাটক দেখাই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু যখন টাকিতে ইছামতীর তীরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার জন্য একটা লজে পৌঁছলাম, মনটা কেমন যেন আনচান করতে লাগল। বেরিয়ে পড়লাম যেন বাধ্য হয়েই। সোজা নদীকে পাশে নিয়ে যে রাস্তা গেছে সেই বাংলাদেশ সীমান্তে। টাকি এমনই এক মফস্বল শহর, যার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতীর ওপারেই রয়েছে বাংলাদেশ। নদীকেও মাঝখান থেকে ভাগ করে নিয়েছে দুই দেশ। পতাকা দিয়ে সীমানা নির্দিষ্ট করা হয়েছে জলের মধ্যেই। ভারি সব অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা।

এপারের নৌকাগুলোতে ভারতের পতাকা। এ যেন একটা হৃদয়ের মধ্যে দুটো ভাগ। কি আর করা যায়, ইতিহাসকে অমান্য করে কার সাধ্যি। হাজার হোক শাসকের বিধান। চলছি, চলছি, কোথায় যে চলছি জানি না। পাশে নদী আমার সাথী। শীতল জল, শীতল হাওয়া। একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। হঠাৎ চোখে পড়ল একদল প্রবীণার প্রাঞ্জল আড্ডা। বৈকালিক প্রফুল্লতায় মত্ত তাঁরা, জীবন থেকে খানিক খাবলে নেওয়া সময়কে সম্বল করে নিজেদের অভিন্নতার আদানপ্রদানে ব্যস্ত তাঁরা। নেই কোনো খেদ, নেই কোনো খাদ সে আড্ডায়। ভিড়ে গেলাম। কথায় কথায় জানলাম, তাঁদের অনেকেই নদীর ওপারে থাকতেন। এপারে বিবাহসূত্রে বসবাস। তখন অবিশ্যি অবিভক্ত ভারত তথা পূর্ববাংলা ছিল। আবার জাতীয়তাবাদের খোঁচাটা একবার বিঁধল। সেইসব মানুষগুলোর সংস্কৃতি, চাওয়া-পাওয়া দিনযাপন নিয়ে জিজ্ঞেস করতে বেরিয়ে এলো বেশ কিছু কথা বা আমার মাটির মুখের অন্যতম একটি মুখ। অভিজ্ঞতার বলিরেখা স্পষ্ট তাঁর মুখে। এখন আর নিজের জন্য ছাড়া ভাববার কিছু নেই তাঁর।

বিকেলের মায়ায় আড়মোড়া খেতে বসেছেন নদীর পাশের রাস্তায়। শরীরের ও বয়সের সব ক্লান্তি দূরে রেখে স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বললেন আমার সঙ্গে। নাম জ্যোৎস্না মন্ডল। প্রায় কুড়ি বছর থেকে শীতলাদেবীর ভজনায় শীতলা পালা করে চলেছেন। এই পালা শিখেছেন বাংলাদেশে। গুরুমা মালঞ্চ দেবী। এখন জ্যোৎস্না মন্ডল ৮০ বছরে পৌঁছেছেন। আজকের বাংলাদেশে নদীর ঠিক ওপারটায় ছিল তাঁর বাপের ঘর। বিয়ে হলো কালীপদ মন্ডলের সঙ্গে। নদীর এপারে। তখন থেকেই এপারে মানে এদেশে তাঁর বাস। তাঁর সেই সুরেলা কণ্ঠে শুনলাম মা শীতলার বন্দনা, তাঁর জয়গাথা। কত কত জায়গার ডাক পেয়েছেন শীতলা পালা করার জন্য। জ্যোৎস্না মন্ডল শীতলা পালার মূল গায়েন, বাকিরা দোহারি। প্রায় ৪ ঘণ্টা এ পালা চলে। দুপুর থেকে বিকেল একটানা। শীতলার ঘট সামনে রেখে বন্দনা হয়। অনুষ্ঠান শেষে ঘটের মঙ্গল জল উপস্থিত মানুষজন মাথায় ঠেকান। মূলত ফাল্গুন মাসে বসন্তকালে এ পালার বন্দনা
বেশি হয়। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। শরীরে ফোঁড়া, পাঁচড়া, খোস, হাজা, দাদ, বসন্ত যাতে না হয় সেজন্য শীতলা দেবীর পুজো পাঠ হয়। অনেক আগে বা প্রত্যন্ত গ্রামে এখনো বসন্ত হলে বলা হয় ‘মায়ের দয়া’ হয়েছে। মাকে তুষ্ট করতেই গ্রামের মানুষজন শীতলা দেবীর পুজো করেন। শরীর মন শীতল রাখা, পরিচ্ছন্ন রাখার এ এক মানবিক প্রকরণ।

শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, শীতলা দেবীর ভজনা উত্তর ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল ইত্যাদি অঞ্চলেও হয়ে থাকে। এও এক সুরাসুরের গল্প। এ অসুর জ্বরের অসুর। কাত্যায়ন কন্যা কাত্যায়নী। দুর্গারই অপর নাম। জ্বরাসুর সব দিকে নানা অসুখ ছড়ায়। কাত্যায়নী রূপে মা শীতলার সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়। মা শীতলা এ ধরা থেকে সব অসুখ, রোগ-ভোগ বিতাড়ন করেন। তাই তাঁর হস্তে ঝাটা লক্ষণীয়। তাঁর কোমরে থাকে ঘট। জল-পরিপূর্ণতাকে প্রকাশ করে ওই ঘট। জল ঢেলে জ্বর সারানোর বা জ্বরের বিদায়ের ধারণা এমনইভাবে এসেছে।

নানা জায়গায় শীতলা মায়ের স্থায়ী থান আছে। যেখানে সারা বছর ধরেই পুজো হয়। অনেক আগে শীতলা দেবীর কোনো মূর্তি ছিল না। দেবী ভয়ঙ্করী। বসন্ত রোগ হলে রোগীর মাথায় টাকা ছুইয়ে প্রতিদিন ঘটে রেখে দেওয়া হয়। রোগ সারলে ওই অর্থ একত্রিত করে মা শীতলার পুজো দেওয়া হয়।

জ্যোৎস্না মন্ডল এই বয়সে এসে ভাবিত তাঁর অবর্তমানে কে এই পালা গান করবে। নতুন মুখ কেউ সেভাবে এগিয়ে আসছে না। সেই সঙ্গে তাঁর বিশ্বাস দেব-দেবীর কৃপাতেই তাঁর এ পালার সঙ্গে সংযুক্তি। ফলে দেবীকে ধারণ করা সহজ কথা নয়। সে অভাবও আছে। এতটাই বয়সের ভার নিয়ে যে মানুষটা সন্ধে নামার সময় অন্যের সাহায্যে ভর করে বাড়ি ফিরতে চাইছিলেন, বার-বার সেই মানুষটাই কীভাবে এখনো শীতলাদেবীর আরাধনায় দূর-দূরান্তে ছুটে যান, এটাই অদ্ভূত। মানুষের মঙ্গলময়তা কামনার ভার তাঁর বয়সের ভারকে পরাজিত করেছে। এটাই বিশ্বাসের জোর, মাটি মাতার জোর। সন্ধ্যের স্নান আলোর পর জ্যোৎস্নার সেই মুখই আমাকে আজও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কখন এক আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে যেন— মাঝখানে শুধু নিঃশব্দে বয়ে যায় নদী, নদীর নাম ইছামতী।

3 thoughts on “শীতলার দয়া | দীপা ব্রহ্ম, পর্ব – ২২

  1. চিরাচরিত প্রথায় শীতলা গান বাংলার প্রত্যন্তরে শোনা যায়। গবেষণা মূলক লেখাগুলি লেখকের বড় মূল্যবান।

    1. অসাধারণ। অনেক ধন্যবাদ অভি।

  2. এতো নীয়মিত এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ দিদি।

Comments are closed.