“দেখ, দেখ,এইবার যদি কেঁপে যায় হাত!”
“উফ্, এইসব বলে না। কেন কাঁপতে যাবে হাত?দেখ না!”
“দেখ, দেখ, চুপ করে দেখ, এখন কথা বলতে নাই,” ছোড়দাদু আর ঠাকুমা আমাদের নিরস্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু
কে শোনে? আমি আর আমার খুড়তুতো বোন, মালা, নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি, বিশ্বনাথকাকুর গা ঘেঁষে। আজ মহালয়া। মা দুগ্গার চক্ষুদান হবে। জ্ঞান হবার পর থেকে এ আমাদের প্রতি বছরের অপেক্ষা।
না, নিবিড় নিষ্ঠায় দীর্ঘ লালিত অনুশীলনের অধিকার বিশ্বনাথকাকু প্রতিবাদের মত আমাদের বিমূঢ় করে তুলির একটানে এঁকে ফেলেন তিন নয়ন, অপার বিস্ময় দেখি, সে নয়ন ফুটে উঠছে, “শক্তি রূপেণ,ক্ষমা রূপেন,দয়া রূপেণ, শান্তি রূপেণ” অপরাজিতা। এও কি এক গিরিপ্রকাশের অভিজ্ঞতা? কি জানি কেন, প্রতিবার, প্রতিবার এই মুহূর্তকথায় গড়িয়ে পড়ত বেপথু অশ্রু, অজান্তেই, লাজুক হাতে সে অশ্রু মুছতে মুছতে প্রশ্ন করতাম, ” কি করে পার, বিশ্বনাথকাকু?”
“এ সবই মায়ের কৃপা, দিদিমনি!” সরল, নির্বিকার বিশ্বনাথকাকুর মুখ জুড়ে তখন আগমনীর আলো ছড়ানো হাসি। এখন একটু একটু বুঝতে পারি, ঐ হাসি আসলে ওঁর বহু জন্মের অনুশীলনের অর্জন।
আমার সৌভাগ্য, আমার জন্ম এমন একটি পরিবারে, যেখানে দুর্গাপূজা এক বার্ষিক উৎসবের চেয়েও বেশী কিছু। ঝাড়গ্রামের রজনী কুটিরের পূজার কথা বলছি। সে বাড়ির সদস্যরা সবাই অধুনা বাংলাদেশের ছিন্নমূল মানুষ। আমার ঠাকুমা, আশালতা দেবীর বাপের বাড়ি ছিল বান্ধব দৌলতপুর, ঢাকা। ১৯৪৭শে ছুটতে ছুটতে কেমন করে যেন ঝাড়গ্রাম, ঐ একটি বছরই ঘটে পুজো হয়েছিল। একটু থিতু হয়ে বসতেই ১৯৪৮ থেকে কষ্টেসৃষ্টে ঐতিহ্য অনুসারে নির্মিত হল লাল মেঝের মন্ডপ, আবার স্বমহিমায় প্রকাশিতা একচালায় “সপরিবারায়ৈ”, সেই থেকে এখনও চলছে তিনশ বছরের মিলন-যজ্ঞ। কখন যে ঠাকুমার বাপের বাড়ি ,অর্থাৎ সেনগুপ্ত বাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেল ঠাকুমার শ্বশুর বাড়ি, অর্থাৎ দাশগুপ্ত পরিবার, কোন রসায়নে অন্তস্থলে জড়িয়ে গেলেম পূজার খুঁটিনাটির সঙ্গে, মনে পড়ে না আর আজ। শুধু জানি, আমার পূজার ঠিকানা “রজনী কুটির”, বাছুরডোবা, ঝাড়গ্রাম।
আমরা তিনজন ছিলাম, একজন সম্পর্কে কাকা হলেও বয়সে মোটে একবারের বড়। সে আসত কলকাতা থেকে। তার বাবা আমার ঠাকুমার ভাই, আমার দাদু আর তার মা,আমার দিদা, এত সুন্দর ছিলেন, আমরা দাদু-দিদা কিছুতেই বলতাম না। বলতাম দাদা, বৌদি। আর একজন সম্পর্কে আমার জেঠতুতো দিদি, সে আসত জামশেদপুর থেকে। জেঠু, জানিনা,দুজনেই ছিলেন আকাশের মত উদার। বছরে এই একবার দেখা। সে যে কি আনন্দের অপেক্ষা ছিল!
আমাদের দিন শুরু হত অন্ধকার ঊষায়, তিনজনে পাথরের পাত্র নিয়ে লাল মোরামের পথ ধরে এগিয়ে যেতাম কুয়াশা বা বটপাতা থেকে শিশির ধরব বলে, সে দায়িত্ব ছিল আমাদেরই। আলো ফুটলেই তো বিপদ! তাই অন্ধকারেই পথ চেরা অভিযান! তারপর ফেরার পথে এ বাড়ি, ও বাড়ির উঠোন থেকে শিউলি কুড়িয়ে সাজি ভরে নিয়ে আসা। পিতলের পুষ্পপাত্রে হলুদ ছোপ সাদা শিউলিরাশির পাশেই ঘন নীল অপরাজিতা, রক্তিম জবা, শ্বেত কাঞ্চন, পীত করবী, তাদের পাশে শ্যামল দূর্বাগুচ্ছ, বেলপাতা, তুলসীপাতা- সে যে কি অপরূপ সমণ্বয়-সংজ্ঞা! সাজানোর পর আজও একই মুগ্ধতায় অপলক চেয়ে থাকি।
পঞ্চমীর সকাল থেকে বুক দুরু দুরু, আজ মা’কে শাড়ি পরানো, দাদুর পাশে পাশে ঠিক সময়ে আঠা, চুমকি, জরি এগিয়ে দিতে হবে। একটু অন্যমনস্ক হলেই হুঙ্কার!
যে মানুষটা রুদ্রাক্ষের মালা পরাতে পরাতে আপন মনে গেয়ে উঠতেন, “মন মাঝি, তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না”, সে কেমন করে এমন বকতে পারে? “হিসাব মেলে নাই”। দাদুর সাথে গলা মেলাতেন আমার বাবা, কিরমানি, বিলাসখানি টোড়ি, কত রাগ, কত সুর চিনেছি এই পুজোর কাজ করতে করতেই, ওঁরা গল্প করতেন, প্রবেশপত্র সংগ্রহের সামর্থ্য ছিল না তো, তাই বাইরে বসেই শুনতেন, ভীমসেন যোশী, নিখিল ব্যানার্জি,আলি আকবর, আল্লারাখা! সেসব রূপকথা শুনতাম আর ভাবতাম কবে বড় হব, কবে যাব ডোভার লেন কিংবা… ধনঞ্জয়, পান্নালালের গান গাইতে গাইতে জেঠু আবার কখন যেন বলতে শুরু করতেন, “এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়ানের জলে” , রবিঠাকুরের পাশাপাশি এমন করেই পরিচয় হয় জসীমউদ্দিন, মোহিতলালের সঙ্গে।
রাত বাড়ে, চালগুড়িতে কাপড় ভিজিয়ে ঠাকুমা হাতে খড়ি দেন শঙ্খলতা, পদ্মপাতায়, ১০৮ নৈবেদ্য কিংবা সন্ধিপূজার আল্পনায়, “রূপং দেহী” শেখা তারা পায়ের কাছে বসেই; বছর বয়সেও ঠাকুমার কন্ঠে সুরস্থান সরত না! আমার মা, শুড়াকন্যা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী, কান্দি রাজবাড়ির বিদ্যালয়ের দিদিমনি এ পরিবারে এসে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের সঙ্গেই আপন করে নিয়েছিলেন চন্ডীস্তোস্ত্র বা মহিম্নস্তোত্র, সঙ্গী করে নিয়েছিলেন আমাদেরও।
নবমীর শত্রুবলির পরে বাবা,কাকা,দাদুদের সে কি দুর্বার আড্ডা! পুজো প্রায় শেষ, তাই প্রসাদেও অনিয়ম!” দোলা,আর একখান নাড়ু দ্যাও!” ” আমারে একখান আখের টুকরা দেবা?” সেইসব স্বর এখন নন্দনকাননের আকাশে ভাসছে বুঝি!
দিন গেছে, নবপত্রিকা বা মহাস্নানের উপকরণ সাজানোতে ভুল হয় না আর বিশেষ! নিদ্রাকলসের ধান্যপূর্ণ সরায় যে কড়ি আর হরিতকী দিতেই হয়, তাও শিখে গিয়েছি, কিন্তু কেন মনে হয়, ভুলটাই ভাল ছিল!
আজ সংকল্পের আসনে বসার অধিকার অর্পিত হয়েছে, মন ভরে ওঠার কথা! ওঠে না, হু হু করা শূন্যতা গ্রাস করে যেন, কেন?
একটিই অর্জন, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের লতায়পাতায় আত্মীয়তা একই রকম প্রগাঢ়। ওরা “জলফড়িং”, “দেশী গার্ল”-এর পাশাপাশি “ত্বং নমামি,পরমেশ্বরী” ও সমান অবলীলায় রাখে অন্তাক্ষরীর আসরে। প্রতি নবমীর সন্ধ্যায় জমকালো অনুষ্ঠান করে ওরা, নিরঞ্জন যাত্রায় ওদের নাচের অনুমতি মিলেছে, ওরা ঢাকের তালে পা মেলাতে মেলাতে আমাদেরও টান দেয়। উপেক্ষার ক্ষমতাই নেই আমাদের। গাম্ভীর্য আর অনুশাসনের নির্মোক একটানে খসে পড়ে।
অনেক ঋণ, অনেক ঋণ, আমার শিশুবেলার পূজার প্রতি, এক কি কোন জন্মে পরিশোধ করা যায়? প্রতি দশমীর কনকাঞ্জলিতে এই কথা ভেবেই প্রতিবাদী হয় মন, হার মানি চিরাচরিত প্রথার কাছে।
এই যৌথতার উত্তরাধিকার জগজ্জনীর চরণকমলে সুরক্ষিত থাক, এইটুকুই প্রার্থনা।