স্মৃতির পাতা থেকে | যাত্রাপালা | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমাদের সময়কার কিছু পূর্বে ধনী-ঘরে ছিল শখের যাত্রার চলন। মিহি গলাওয়ালা ছেলেদের বাছাই করে নিয়ে দল বাঁধার ঘুম ছিল। আমার মেজকাকা ছিলেন এইরকম একটি দলের দলপতি। পালা রচনা করবার শক্তি ছিল তাঁর, ছেলেদের তৈরি করে তোলবার উৎসাহ ছিল। ধর্মীদের ঘরপোষা এই যেমন শখের যাত্রা তেমনি ব্যবসাপারী যাত্রা নিয়েও বাংলাদেশের ছিল ভারী নেশা। এ পাড়ায় ও পাড়ায়, এক-একজন নামকরা অধিকারীর অধীনে যাত্রার দল গজিয়ে উঠত। দলকর্তা অধিকারীরা সবাই যে জাতে বড়ো কিংবা লেখাপড়ায় এমন কিছু নয়। তারা নাম করেছে আপন ক্ষমতায়। আমাদের বাড়ীতে যাত্রাগান হয়েছে মাঝে মাঝে। কিন্তু রাস্তা নেই, ছিলুম ছেলেমানুষ। আমি দেখতে পেয়েছি তার গোড়াকার জোগাড়যন্তর। বারান্দা জুড়ে বসে গেছে দলবল, চারি দিকে উঠছে তামাকের ধোঁয়া। ছেলেগুলো লম্বা চুলওয়ালা, চোখে কালি পড়া, অল্প বয়সে তাদের মুখ গিয়েছে পেকে। পান খেয়ে খেয়ে ঠোঁট গিয়েছে কালো হয়ে। সাজগোজের আসবাব আছে রঙ-করা টিনের বাক্সোয়। দেউড়ির দরজা খোলা, উঠোনে পিল পিল করে ঢুকে পড়েছে লোকের ভিড়। চারদিকে টগবগ আওয়াজ উঠছে, ছাপিয়ে পড়ছে গলি পেরিয়ে চিৎপুরের রাস্তায়। রাত্রি হবে ন’টা। পায়রার পিঠের উপর বাজপাখির মতো হঠাৎ এসে পড়ে শ্যাম, কড়া কড়া শক্ত হাতের মুঠি দিয়ে আমার কনুই ধরে বলে, ‘মা ডাকছে শোবে চলো। লোকের সামনে এই টানাহেঁচড়ায় মাথা হেঁট হয়ে যেত, হার মেনে চলে যেতুম শোবার ঘরে। বাইরে চলছে হাঁকডাক, বাইরে জ্বলছে ঝাড়লণ্ঠন। আমার ঘরে সাড়াশব্দ নেই। পিলসুজের উপর টিম টিম করছে পিতলের প্রদীপ। ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে নাচের তাল সমে এসে ঠেকতেই ঝমাঝম্ করতাল।

সব-তাতে মানা করাটাই বড়োদের ধর্ম। কিন্তু একবার কি কারণে তাঁদের মন নরম হয়েছিল, হুকুম বেরল, ছেলেরাও যাত্রা শুনতে পাবে। ছিল নলদময়ন্তীর পালা। আরম্ভ হবার আগে রাত এগারোটা পর্যন্ত বিছানায় ছিলুম ঘুমিয়ে। বার বার ভরসা দেওয়া হল, সময় হলেই আমাদের জাগিয়ে দেবে। উপরওয়ালাদের দস্তুর জানি, কথা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না, কেননা তারা বড়ো আমরা ছোটো।

সে রাত্রে নারাজ দেহটাকে বিছানায় টেনে নিয়ে গেলুম। তার একটা কারণ, মা বললেন তিনি স্বয়ং আমাকে জাগিয়ে দেবেন। আর একটা কারণ, নটার পরে নিজেকে জাগিয়ে রাখতে বেশ একটু ঠেলাঠেলির দরকার হত। এক সময়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে আমাকে নিয়ে আসা হল বাইরে। চোখে ধাঁধা লেগে গেল। একতলায় দোতলায় রঙিন ঝাড়-লণ্ঠন থেকে ঝিলিমিলি আলো ঠিকরে পড়ছে চারদিকে, সাদা বিছানার চাদরে উঠানটা চোখে ঠেকছে। এক দিকে বসে আছেন বাড়ীর কর্তারা আর যাঁদের ডেকে আনা হয়েছে। বাকি জায়গাটা যার খুশি যেখান থেকে এসে ভরাট করেছে। থিয়েটরে এসেছিলেন পেটে সোনার চেনঝোলানো নামজাদার দল, আর এই যাত্রার আসরে বড়োয় ছোটোয় ঘেঁষাঘেঁষি। তাদের বেশির ভাগ মানুষই, ভদ্দরলোকেরা যাদের বলে বাজে লোক। তেমনি আবার পালা গানটা লেখা হয়েছে এমন সব লিখিয়ে দিয়ে যারা হাত পাকিয়েছে খাগড়া-কলমে, যারা ইংরেজি কপিবুকের নকল করেনি। এর সুর, এর নাচ, এর সব গল্প বাংলাদেশের হাট ঘাট মাঠের পয়দা করা এর ভাষা পন্ডিতমশায় দেন নি পালিশ করে।

সভায় যখন দাদাদের কাছে এসে বসলুম, রুমালে কিছু কিছু টাকা বেঁধে আমাদের হাতে দিয়ে দিলেন। বাহবা দেওয়ার ঠিক জায়গাটাতে ঐ টাকা ছুঁড়ে দেওয়া ছিল রীতি। এতে যাত্রা ওয়ালার ছিল উপরি পাওনা, আর গৃহস্থের ছিল খোশনাম।

শহরে আজকাল আমোদ চলে নদীর স্রোতের মতো। মাঝে মাঝে তার ফাঁক নেই। রোজই যেখানে-সেখানে যখন-তখন সিনেমা, যেখুশি ঢুকে পড়ছে সামান্য খরচে। সেকালে যাত্রাগান ছিল যেন শুকনো গাঙে কোশ দু-কোশ অন্তর বালি খুঁড়ে জল তোলা। ঘন্টা কয়েক তার মেয়াদ, পথের লোক হঠাৎ এসে পড়ে, আঁজলা ভরে তেষ্টা নেয় মিটিয়ে।

2 thoughts on “স্মৃতির পাতা থেকে | যাত্রাপালা | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  1. দারুণ, ভাবা যায় না, ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ এর দেখা সত্যিই ছবির মতো।

Comments are closed.