“বাদলধারা হল সারা, বাজে বিদায় সুর…” বোঝা যেত যখন আকাশে কেউ একশিশি সুলেখা রয়্যাল ব্লু কালি ঢেলে দিত। বিদায়ী বাদলধারায় মিশে সারা আকাশ নীল হয়ে উঠত, ছানাপোনা মেঘের দল তাদের শৈশব-শুভ্রতায় আকাশ আলো করে তুলত তখনই মনের মধ্যে বাজতে শুরু করত, ঢ্যাং ন্যাটাং, ঢ্যাং ন্যাটাং, ঠাকুর আসবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন…” মনে মনে চাপা উত্তেজনা, ঠাকুর আসুক তো আগে, তারপর নাহয় বিসর্জনের কথা ভাবা যাবে। বারোয়ারী পুজোর উদ্যোক্তারা চাঁদা নিতে এলে তাদের বিল দেখে সর্বজনীন না সার্বজনীন সেসম্বন্ধীয় আলোচনা কৈশোররের জ্ঞানভান্ডারে কিছু জ্ঞান সংযোজন করত। আমাদের পাড়ায় দুর্গাপুজো হত না, কিন্তু অন্যপাড়ায় প্যান্ডেলের বাঁশ পড়ল কিনা সে খবরাখবর বন্ধুমহলে চালাচালি হত। আমাদের মফস্বল শহরে তখনও থিম পুজোর কোনও গন্ধ ছিল না, পুজো মানে শিউলির গন্ধ আর স্থলপদ্মের সৌন্দর্য। আমাদের পাড়া ছাড়িয়ে আশেপাশের পাড়ায় বেশ কয়েকটা সার্বজনীন পুজো হত। তাতে সাদামাটা বাঁশের কাঠামোয় রঙিন কাপড়ের প্যান্ডেলই হত। তাতেই কোন সঙ্ঘ কি রঙের প্যান্ডেল করেছে সেটা আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠত। শরতের বৃষ্টির দুষ্টুমিতে কাপড়ের রঙ উঠে পাশের সাদা কাপড়ে লেগে গেলে আমরা কিছু মনে করতাম না, জানতাম এটাই স্বাভাবিক। কিছু রঙ থাকে না, ধুয়েই যায়। প্যান্ডেলে ঢোকার মুখের কাদা এড়াতে উদ্যোক্তারা ইট পেতে দিতেন, তাতে পা দিয়ে ব্যালেন্সের খেলা খেলতে খেলতে আশেপাশে অহেতুক না তাকানোর অভ্যাস করতে করতে এগিয়ে চলত আমাদের কিশোরীবেলা। তবে রাতে হবে আলো, লাল বাতি, নীল বাতি যে কত সত্যি, তা আমরা সহজ পাঠ পড়ে নয়, জীবনের সহজ পাঠেই জেনে গেছিলাম। আমাদের ছিল চন্দননগরের আলো। যে ক্লাবের যত বেশি বাজেট, তাদের তত আলো। ঢোকার মুখের পথ বরাবর আলোর খেলা, সার্কাস, ড্রাগন, ইউ এফ ও… কি নয়! আলোর ফুল লতাপাতার নকশা তো নস্যি ওসব আলোর কারসাজির কাছে। তবে সেসব আলোর আলপনাও থাকত ষষ্ঠী থেকে নবমীর চাঁদের ক্ষীণ আলোর অস্তিত্বকে ম্লানতর করে দিয়ে। লোকে বলত আগেরবছর চন্দননগরের জগদ্ধাত্রীতে যে আলো হয়েছিল পরেরবছর তা আমাদের আলো দেয়। তা দিক গে! আমাদের ছেলেবেলা সে আলোর নকশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠত। ফাংশান হত কোথাও কোথাও। ভেলপুরি, ফুচকা, আইসক্রিমের অশরীরী হাতছানি পারিবারিক শাসনের বেড়াজালকে অনায়াসে অতিক্রম করার শক্তি যোগাত।
তবে বারোয়ারী পুজো ছাড়াও আমাদের প্রাচীন শহরে ছিল বাড়ির পুজো। হুগলী শহর প্রাচীনত্বের দাবীতে কলকাতার থেকে অনেক প্রাচীন। সেই শহরের মল্লিকবাড়ি, শীলবাড়ির পুজো আমাদের টানত। মল্লিকদের ঠাকুরদালানের কাছেই ছিল সিঁড়ি বাঁধানো এক সুড়ঙ্গ। পাশের গঙ্গার সাথে যুক্ত। বাড়ির মেয়েদের গঙ্গা নাইতে যাবার পথ। যে বছর যেমন বৃষ্টি হত, সেই অনুযায়ী সুড়ঙ্গের ধাপে জল এসে খেলা করত। ঠাকুর একচালার। চালচিত্রের মাঝখানে মহাদেবের প্রথামাফিক অবস্থান। তবে অন্য পুজোর থেকে ব্যতিক্রম ধরা পড়ত মহাদেবের স্বয়ং উপস্থিতিতে। মহাদেবের কোলে দুর্গা। তিনি অভয়া। মহাদেবের কোলে বসে তিনি জগৎ সংসারকে অভয়প্রদান করছেন! সপরিবারে দুর্গার বাপের বাড়ি আসা, চার সন্তান, তাদের জনক তো সঙ্গী বটেই, সাথে দুই সখী জয়া বিজয়াও আসতেন। মল্লিক বা শীল বাড়ির ঠাকুরদালানে ঢাকী নেচে নেচে ঢাক বাজাত, বাড়ির মেয়ে বৌরা ঠাকুরদালানে পুজোর জোগাড় করতেন। অষ্টমীর অঞ্জলির সময় মল্লিকবাড়ি যেতে খুব ভালো লাগত। বাড়ির বৌরা সবাই আলতা সিঁদূরে লালে লাল হয়ে গা ভর্তি গয়না পরে নাকে ফাঁদি নথ পরে অঞ্জলি দিতেন যখন, তখন তাঁদের মুক্তোর মত মসৃণ গালে মুক্তোর টানা দেখে কৈশোর উদেবল হয়ে উঠত, “কে কার মাত্র উপমা কেবল…”
বারোয়ারী আর বাড়ির পুজো ছাড়াও আরেকটি পুজোর কথা বলতেই হয়। জেলখানার পুজো। জেলখানার সামনের মাঠে পাকা ঠাকুর দালানে হত। জেলের সব কর্মীদের পুজো। এখানে অকাল বোধনকে মনে রেখে দুর্গাপ্রতিমার সামনে তীর ধনুক হাতে নতজানু রাম লক্ষণকে দেখা যেত। আর বাইরের চাতালে ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে টুনিবাল্বের আলোয় সীতা হনুমানকে আম খাওয়াতেন। শরতে আম কোথায় পেতেন সে প্রশ্ন আমাদের আকুল করে নি কখনও। বরং সীতা বেশি সুন্দর দেখতে হয়েছে, না সরস্বতী, সে দোলাচল দুলিয়ে দিত।
আশ্বিনের ভোরগুলো হিমেল থাকত। উষ্ণতা যেন আরো কমে যেত রেডিওয় বন্যার খবর এলে। বেলা বাড়লে উঠোনে ভিক্ষা চাইতে আসত যারা তাদের দেখে ভিখারী মনে হত না। সে আমলের মধ্যবিত্ত সাধ্য অনুযায়ী আটআনা পয়সা দেওয়া হলেও মা কিছু খাবার দিতে চাইতেন। বলতেন, “পুজোর দিন বলে কথা…” ঘরে নারকেল নাড়ু, তিলের তক্তি, মোয়া, জিবেগজা থাকতই। তার থেকেই দিতেন মা। ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে জোড়াঘাটে জল মাপতে যেতাম আমরা। জোড়াঘাটে একটা থাম ছিল, ইংরাজ আমলের বানানো। সেটা কতটা ডুবছে তাই দিয়ে নাকি বোঝা যেত অন্যান্য জায়গা কতটা ডুবেছে। পাশে ভূদেব ভবন, যেখানে বসে আনন্দমঠ লিখেছিলীন বঙ্কিমচন্দ্র, নির্মোহ প্রহরায় দাঁড়িয়ে থাকত। ভাঁটার টানে সাগর পানে ভেসে যেত বড় বড় ঘাস বিছানো ধ্বসের মাটির চাঁই, ছাপা শাড়ি বা গামছা। বুকটা কেঁপে উঠত কোন অচেনা সুদূরের ক্ষতির কল্পনায়।
এসব পেরিয়ে এসে যেত বিসর্জনের পালা। বিসর্জনের দিন ঠাকুর লরিতে উঠে চলতেন গঙ্গাপানে। সামনে সামনে ভ্যানে সাজানো চন্দনগরের আলো, তাসা পার্টি বা ব্যান্ড পার্টি সামর্থ্য অনুযায়ী। গঙ্গায় প্রতিমা নামিয়ে তিনপাক ঘুরিয়ে বিসর্জন। “আসছে বছর আবার হবে” মনের মধ্যে চুঁইয়ে পরতে থাকা বেদনাবোধকে কিছুটা ভরাট করে দিত। বড় বাজেটের পুজোর ঠাকুর দুটো নৌকার মাঝখানে রাখা হত। মাঝগঙ্গায় গিয়ে দুটো নৌকা ফাঁক হয়ে যেত, ঠাকুর যাত্রা করতেন কৈলাসে। নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়া বা জলে চ্যাং মাছ ছাড়ার প্রথা দেখি নি। তবে দশমীর সকালে মা মাছ আর বড়ি তেল সিঁদূর ধান দূর্বায় বরণ করতেন। বলতেন, “শুভক্ষণ।“ আমাদের ছিল একশ আটবার দুর্গা নাম লেখার নিয়ম, বইগুলো একবার করে খুলে দেখার নিয়ম নইলে নাকি অ্যানুয়ালি (আমরা তাই বলতাম) পরীক্ষায় সমূহ সঙ্কট! সঙ্কট পরিত্রাণের উপায় হিসাবে ঠাকুরের ফুল বইএর ভাঁজে রেখে দিয়ে বল ভরসা বাড়ত। ঠাকুর বিসর্জনের পর ঢাকীরা, বিসর্জন দিতে যাওয়া ছেলে, আধবুড়োরা নাচতে নাচতে ফিরত। পায়ের দোদুল্যমানতায় বিশেষ তরলের পৈটিক অবস্থান নির্দিষ্ট করত। ঢাক বাজত, “ঠাকুর থাকল কতক্ষণ, ঠাকুর গেল বিসর্জন…” না, সেযুগে মহিলারা বিসর্জনে যেত না। মন্ডপে ঠাকুরবরণ করেই তাদের কাজ সারা। না, ভুল বললাম, আরো অনেক কাজ… রাশি রাশি নারকেল নাড়ু, গজা, ক্ষীরতক্তি বানানোর কাজ। পরদিন থেকে বাড়ি বাড়ি বিজয়া… সবার প্লেটে তুলে দিতে হবে না!
আশ্বিনের হিম পড়া সন্ধ্যায় উনুনের ধোঁয়া রান্নাঘরের ছোট জানলার শিকের ফাঁক দিয়ে পাড়া বেড়াতে বেড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ত চরাচরে। তখন একলা প্যান্ডেলে আরো একলাটি হয়ে জ্বলতে থাকত একটা মাটির প্রদীপ।… আগামী আশার আলো হয়ে…