সোয়াচান পক্ষীর বাসা; শুভদীপের নিজস্ব ভাষা – অভি চক্রবর্তী

সম্প্রতি অমল আলোয় দেখলাম এ এল টি’র সোয়াচান পক্ষীর বাসা। একটা নাট্যদল দীর্ঘকাল কাজ করে গেলে তার ছায়া প্রচ্ছায়া ঘন হয়ে ওঠে। সেই ঘনায়মান ছায়া থেকে নিজস্ব কারুবাসনার রোদ্দুরের রং এবং শৌর্যকে কর্মের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা দেওয়া বড়ো দুরূহ কাজ, এ কথা স্বীকার্য সত্য।

এই গৌরচন্দ্রিকাকে খানিক তরল করলে দাঁড়ায় যে একই দলে ও গৃহে বসবাস করে প্রবীর গুহ’র মতো বিকল্প নাট্যের প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক গুরু ও পিতাকে সদর্থক মান্যতা দিয়েও তার সুযোগ‍্য সন্তান শুভদীপ গুহ ‘সোয়াচান পক্ষীর বাসা’ নির্মাণ করেছেন, তৈরি করেছেন নাট্য-তৈরির নিজস্ব আঁচ। যেখানে প্রবীর গুহর রোদ্দুর আছে , এ এল টি’র সজীব প্রবহামনতা আছে। কিন্তু শুভদীপ তাকে বইয়ে দিতে পেরেছেন নিজস্ব খাতে, আত্মগরিমার উন্মোচনের মধ্যে দিয়ে। অবশ্যই এই বইয়ে দেবার মূল কারিগর সংগীত। যার লেখা সুর গায়কী সবই শুভদীপের, ফলত এই উন্মোচনের যাবতীয় কৃতিত্ব তারই। এ কাজে তিনি স্বল্প বয়েস থেকেই শ্রম ও মেধার আশ্চর্য মিলমিশ দেখিয়ে এসেছেন। বহু নাট্যদলের নির্দেশকই তার উপর এ ব্যাপারে চোখ বুজে নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে নির্দেশক শুভদীপকে পরিভ্রমণ করে চলেছেন সংগীতকার শুভদীপ। কখনো বড় শান্ত বিকেল হয়ে, কখনো বেদনায় দীর্ণ হেমন্তকাল হয়ে, কখনো ঠিকানালুপ্ত ঝড় হয়ে, কখনো সজল মেঘ হয়ে আবার কখনো বা শীতের ঝড়াপাতা হয়ে এবং অবশ্যই পুরুলিয়ার পলাশ হয়েও। কারণ নাটকে ফুলি আছে। প্রেম আছে। আছে লাল রং। আছে বদলে দেবার স্বাভাবিক দুঃস্বপ্ন।

সোয়াচান পক্ষীর বাসার নাটককার প্রবীর গুহ, ২০১০ সালে অশোকনগর নাট্যমুখের মহলা কক্ষে এ নাটক পড়ে শুনিয়েছিলেন আমাদের। বেশ অন্যরকম লেগেছিল নিঃসন্দেহেই। তারপর নানান খাতে জল বয়ে গেছে জীবনের। এ নাটকও বার দুয়েক নাট্য হয়ে মঞ্চে ঘুরে গেছে , নেহাত মধ্যবিত্তের রোজনামচার মতোই। মাঝে শুভদীপ করে ফেলেছেন চার চারটি নাট্য। এ নাট্য পড়েই ছিল মলাটবন্দী হয়েই। আকস্মিক শুভদীপের জীবনের এক কালচে সময়, এক মস্ত শোকের কাল তাকে আবার এ নাট্যের মুখোমুখি করে তোলে। ব্যক্তিগত শোককে এই নাট্যের মধ্যে দিয়ে বইয়ে দিয়ে খানিক নিষ্ক্রমণ পেতে চেয়েছেন তিনি, জানিয়েছেন এই প্রতিবেদককে।

আক্ষরিক অর্থেই শুভদীপ এই নন-লিনিয়ার, কাহিনী শূণ্য, ঘটনাবিহীন কনসেপ্টকে বয়ে নিয়ে চল্লেন এক আন্তরিক শান্ত নাট্যিক প্রবাহে। সেখানে বেদনাবিধুর হয়ে মরচে রং এর শেষ বিকেল কার্পেট পেতে দিল, জাহাজ তৈরি হল গোটা অমল আলো জুড়ে, সামান্য পর্দায়। শুভদীপের জার্নি চলতে লাগল এক সংগীত থেকে আরেক সংগীতের দিকে। সেই যাওয়ার পথে কখনো সখনো পড়ে থাকল পান্নার অনবদ্য অঙ্গবিন্যাস বা প্রীতমের ছেঁড়া ছেঁড়া আলোর প্রতিস্পর্ধি উচ্চারণ।

আমি কে খোঁজার এই উন্মত্ত তাড়নায় এক অদ্ভুত আন্ডারটোনে অভিনয় করে গেলেন সুমন দাস ও প্রীতম চক্রবর্তী। অত্যন্ত কম সংলাপে তাদের দেখে মনে হয়,
‘এখন, তাকে কি মৃত্যু ফেলে রেখে যাবে নদীতীরে?
এখন, তাকে কি নারী পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যাবে সূর্যের কুটিরে?
এখন, সন্তান তার কতটা কাপ্তেন হবে স্বপ্নে শস্যে- জংশনের ভিড়ে

আমরা জানিনা কিছু, কেন গ্রন্থ, কেন মদ, কেন জংশনের হাটে জাগ্রত অসুখ
যৌবন মুখোশ চায়, ঘুমের লাবণ্যে তাই ভরে ওঠে আমাদের ব্যর্থ পোড়ামুখ’…

এই পোড়ামুখেই, শুভদীপ কমলা রং এর রোদ ফেলে রাখলেন। আমাদের সমাজ লেভেল করতে ভালবাসে, তেমনই শুভদীপকে মিউজিক ডিরেক্টার হিসেবে শোকেস করাই সুবিধে। তাতে অবশ্য এমনি অসুবিধের কিছু নেই। এন এস ডি থেকে ভেঙ্কটেশ ফিল্ম যাবতীয় পেশাদার সঙ্গীত ক্ষেত্রেই শুভদীপ থুড়ি বাবান অপরিহার্য নাম। কিন্তু সেই সংগীতকার খ্যাতির বাইরে বেরিয়ে, সেই আত্মপরিচয়ের সাফল্যের জোব্বাকে সযত্নে সরিয়ে রেখে, বংশ কৌলিন্যের পরম্পরার আয়েশকে ত্যাগ করে বাবান গড়ে তুললেন আক্ষরিক অর্থেই নির্দেশনার নব্য ভাষা। আত্মবয়ান।

কৃষ্ণকলি থেকে যা শুরু হয়ে আপাতত মধ্য গগনের দিকে ঢলে পড়ে স্বস্তি পেয়েছে খানিক।