স্কুল থিয়েটারের মঞ্চে অনেকেই অভিনয় করে। তাদের অনেকেই পরবর্তীতে আর থিয়েটারে থাকে না। কিন্তু কেউ কেউ থেকে যায়। মঞ্চমায়ায় বাঁধা পড়ে থেকে যায়। শৌভিক ঘোষ তাদেরই একজন। যখন স্কুলের মঞ্চে নাটক করতে নেমেছিল তখন নিতান্তই স্কুলের জন্য। কিন্তু নাটকটা ছিল রবীন্দ্রনাথের লেখা। তখন সে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। থিয়েটার বিষয়ক জ্ঞান বা বোধ যেমন ছিল না, তেমনই পরবর্তীতে অভিনয় নিয়েই থাকবে এমন ভাবনাও ছিল না। কিন্তু সেই শৌভিক এখন থিয়েটারের মঞ্চে রীতিমত চেনামুখ। যে মুখের দিকে নির্দেশকরা ভরসা করে তাকিয়ে থাকে। আবার সেই শৌভিক এখন শুধুই অভিনেতা নয়- নাট্যকার, নির্দেশক এবং একটি নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা, কর্ণধার।
যখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, তখন স্কুল থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের “অচলায়তন” নাটকে আচার্যদেব চরিত্রে প্রথম মঞ্চে নামা। পরবর্তীতে অভিনেতা হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ঐ “অচলায়তন” নাটকেই পঞ্চক চরিত্রে অভিনয় করেছে। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, বরং শুরু। বাড়িতে বাবা বা অন্য কেউ কখনও থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন না। ঠাকুরদা কীর্তন গাইতেন। বাবা গোপাল ঘোষ একটু আধটু বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। তবে মা কবিতা ঘোষ, ছোট পিসি টিনা চক্রবর্তী শৌভিকের বড় বেলায় থিয়েটারের নেশাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। এই প্রশ্রয়টুকু পেয়েছে বলেই থিয়েটারকে জীবনের সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার ঝুঁকি নিতে পেরেছে।
উত্তর ২৪ পরগণার নিউ ব্যারাকপুরের ছেলে শৌভিকের প্রাথমিক শিক্ষার শুরু কিশলয় বিদ্যাভবনে। তারপর কোদালিয়া আগাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি। এখানেই প্রথম মঞ্চাভিষেক। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুদাস কলেজ থেকে স্নাতক এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। এখানেও শেষ নয়। গড়িয়াহাট আই টি আই থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাঠ সম্পন্ন করে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ডিপ্লোমা ইন এলিমেন্টারি এডুকেশনের ডিগ্রিও তার পকেটে। স্কুলের ফার্স্ট বয় বলে থিয়েটারের রিহার্সালে ছাড় পেয়ে যেত। এমন মেধাবী ছাত্র থিয়েটারের মঞ্চে এসে যে অভিনয় বিষয়ে মেধার উজ্জ্বল আলো ছড়াবে সে তো জানা কথা। থিয়েটার আর লেখাপড়া দুটোই চালিয়ে গেছে সমানতালে।
থিয়েটারটা শৌভিক আয়ত্ত করেছিল বিভিন্ন নাট্যদলে থিয়েটার করতে করতে, বিশিষ্ট নাট্যশিক্ষকদের সান্নিধ্যে, নাট্য কর্মশালার প্রশিক্ষণে এবং নিজের অনবরত চর্চার মধ্যে। ২০১৮ সালে স্নাতক আর ২০২০ সালে স্নাতকোত্তর মেধাবী ছাত্রটি ইতিমধ্যেই নিজের নাট্যদল নিউ ব্যারাকপুর ‘দৃশ্যান্তন’ যেমন গড়ে নিয়েছে তেমনই বিভিন্ন নাট্যদলে সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের আসনটি অধিকার করে নিয়ে অভিনেতা হিসাবে তার জাত চিনিয়েছে। পূর্বরঙ্গ, দমদম শব্দমুগ্ধ, ছন্দনীড়, গাঁড়াপোতা শপ্তক, রঙ্গসংস্কার, মজলিশ, কুশীলব, সহজ মন ইত্যাদি নাট্যদলের বিভিন্ন প্রযোজনায় মঞ্চ মাতাচ্ছে শৌভিক। পাশাপাশি ২০১৮ সালে গড়ে তোলা নিজের নাট্যদলে (নিউ ব্যারাকপুর দৃশ্যান্তন) নানা প্রযোজনা থিয়েটার মহলে সাড়া ফেলেছে। নিজে একজন ভাল নাট্যকার। নিজের লেখা নাটক দলে নির্মাণের পাশাপাশি দলের সব কাজ দেখতে হয়। অভিনীত নাটকের সংখ্যাও কম নয়। পথিকের পথ, অচলায়তন, ছুটি, রক্তকরবী, কাবুলিওয়ালা, জন্মদাতা, ফুটবল, সওদাগরের নৌকা, অচিনপুর যাত্রা, বোধোদয়, কচিপাতার কান্না, অগ্নিগর্ভ লেনা, ঠিকানা শান্তিনিকেতন, স্যাফো চিত্রাঙ্গদা, উপল ভাদুড়ি, জিহাদ, ভোমর, জনিতৃ, নিয়ম ভাঙার খেলা, নিরাশ্রয়, যোজনগন্ধা, জগাই দাদা, সীতায়ন, স্পার্টাকাস প্রভৃতি অজস্র নাটকে নানা চরিত্রে অভিনয় করেছে। বেশ কিছু নাটকে প্রধান চরিত্রেও। যে অচলায়তন দিয়ে স্কুল জীবনে থিয়েটার করতে প্রথম মঞ্চে নেমেছিল আচার্যদেব হয়ে, পরে সেই নাটকে পঞ্চক হয়ে মঞ্চে নেমেছে পরিণত অভিনেতা শৌভিক।
অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে নিজের লেখা বেশ কিছু নাটক আছে। যেমন- জিহাদ, নিয়ম ভাঙার খেলা, পাদুকা বিভ্রাট, জনিতৃ, মানহুশ, ভোমর, বোধোদয়। এগুলোর মধ্যে জিহাদ, জনিতৃ, নিয়ম ভাঙার খেলা, ভোমর তার নিজের নাট্যদলে মঞ্চস্থ হয়েছে। তখন একাধারে সে নির্দেশক ও নাট্যকার। চপল ভাদুড়ি, ডলি বসু, রোকেয়া রায়, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, রাকেশ ঘোষ প্রমুখের সঙ্গে অভিনয়ের মুহূর্তগুলি তার জীবনের পরম পাওয়া। সুভাষ দাসের নির্দেশনায় প্রথম মঞ্চে নামা সেই কিশোর ছেলেটি যুবক হয়ে রাকেশ ঘোষ, মলয় রায় – রোকেয়া রায়, ড:দেশরাজ মীনা, রঞ্জন বোস, মোনালিসা দাস, কমল দত্ত, প্রণয় বিশ্বাসের নির্দেশনায় বিভিন্ন নাটকে মঞ্চে নেমেছে। “পথিকের পথ” নাটকে পথিক চরত্রটির প্রতি শৌভিকের একটা বিশেষ টান আছে। আন্ত: বিদ্যালয় নাট্য প্রতিযোগিতায় এই চরিত্রে অভিনয় করে শৌভিক শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিল। অনির্বাণ সেনের লেখা ‘হাতবদল’ নাটকে নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছে শৌভিক।
পড়াশুনো, থিয়েটার, বিভিন্ন মেগা সিরিয়ালে অভিনয় চলছে বর্তমানে। এই নিয়ে বেঁচে থাকা শৌভিকের প্রতিদিনকার থিয়েটারের আয় থেকে চলে যাচ্ছে। তবে করোনাকালের বিপর্যয় বুঝিয়ে দিয়েছে এ বড় অনিশ্চিত পেশা। তবু থিয়েটারকে আঁকড়ে ধরে রেখেই জীবনে বাঁচার স্বপ্ন তার। বাড়ির মানুষজনের ষোলো আনা সমর্থন তার জন্যে। গভীর রাতে নাটক করে এসে যখন দেখে বাড়িতে মা, ঠাকুমা তার জন্য খাবার তৈরি রেখেছে, বিছানা পেতে রেখেছে। তখন ভাবে, থিয়েটারের সাম্রাজ্যেই থেকে যাবে সে। তার প্রতিটি নাটকে তাকে প্রাণিত করতে দর্শকের আসনে যখন তার মা, ছোট পিসি, আত্মীয় স্বজনরা উপস্থিত থেকেছে, তখন তার মায়া বেড়েছে থিয়েটারের জন্য। ঘুমের সাগরে ডুবে গিয়েও তার কানে বাজে দর্শকের তুমুল করতালি, বন্ধুবান্ধবরা যখন তাকে তার নামের বদলে থিয়েটারের কোন চরিত্রের নামে ডাকে তখন এক স্বপ্নের সওদাগর হয়ে ওঠে শৌভিক। ঠিকানা শান্তিনিকেতন এর শান্তি মাসিমা, রক্তকরবীর মকররাজ, ছুটির ফটিক, যোজনগন্ধার বেদব্যাস, জিহাদ এর জিহাদ, ভোমর এর বদন কিংবা স্যাফো চিত্রাঙ্গদার ক্যারাক্সাস প্রভৃতি প্রিয় চরিত্রগুলো যেন সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, আমাদের ছেড়ে যেও না শৌভিক। তখন অনেকবার মনে মনে থিয়েটার ছেড়ে দিতে চাওয়া শৌভিক আবার কোন চরিত্র হয়ে মঞ্চে এসে দাঁড়ায়। তার কানে ভেসে আসে তুমুল করতালির শব্দ।… তাই থিয়েটার ছেড়ে থাকার কথা আর ভাবে না শৌভিক। অভিনয় নিয়েই সে থাকতে চায়।
থিয়েটারে আসার হয়তো কোন কথা ছিল না শৌভিকের। স্কুলে “অচলায়তন” নাটকের সেই আচার্যদেব চরিত্রের পরেই যেন থিয়েটারের প্রতি একটা মোহ তৈরি হয়েছিল। সুভাষ দাস স্কুলে আসতেন স্কুলের নাটক তৈরি করে দিতে। সেখানেই শৌভিকের থিয়েটারের প্রথম পাঠ গ্রহণের পরেও একটা ভালবাসা থেকে গিয়েছিল থিয়েটারের জন্য। তাই লেখাপড়া বজায় রেখেও থিয়েটারে যুক্ত থেকেছে। নিজে নাটক লিখতে শুরু করে কম বয়সেই। সেই নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য দলও তৈরি করেছে নিজের। একঝাঁক নতুন ছেলেমেয়েকে নিয়ে থিয়েটারের কাজ করছে শৌভিক। পাশাপাশি বিভিন্ন নাট্যদলে ফ্রীল্যান্সার হিসাবে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই থিয়েটারে মন প্রাণ সমর্পণ করে এগিয়ে চলেছে । থিয়েটার তার কাছে এখন বাঁচার রসদ।
শৌভিককে অনেক ভালোবাসা। তুই আরও এগিয়ে যা। থিয়েটারে থাকিস। অভিনয়ে থাকিস। তোকে থাকতেই হবে।
Thank you so much. I’m really feel honoured. It’s my pleasure to read it. Thank you to the entire team of Amal aalo journal & Bijay Kumar Das. Long way to go…
শৌভিক ভীষণ গুণী ছেলে, থিয়েটারে নতুন জেনারেশন এমন সব দিক থেকে শিক্ষিত হয়ে, জেনে আসছে। ট্রিটমেন্ট হচ্ছে। খুব ভালো লাগলো জেনে ওর থিয়েটারের প্রতি ভালোবাসার অনুভূতির কথা জেনে। এগিয়ে চলুক জোরকদমে।