শ্রীনগরের থিয়েটার

আশিস গোস্বামী 

এই বয়সে বেড়াতে যাওয়া মানে কতগুলি জায়গা ঘুরে এলাম, সেটা আর হয় না। সেখানকার মানুষজন, গান বাজনা-নাটক, খাওয়া- দাওয়া, পোষাক এই সবটা জানতে ইচ্ছে করে। বিশেষত নাটক। বেড়াতে যাবো আর সেখানকার থিয়েটারের সাথে কথা বলবো না, সেটা ভাবতেও পারিনা। কাশ্মীরে যাবার আগেই বন্ধু ভবানী বশীর ইয়াসিরকে বলে রেখেছিলাম, থিয়েটার হল আর থিয়েটারের লোকজনের সাথে আড্ডা দেবার ব্যবস্থা যেন থাকে। বশীর কিন্তু আমাদের কাছে খুব পরিচিত মানুষ। কলকাতায় দল নিয়ে অভিনয় করে গেছেন। তবে বাংলা থিয়েটারে খুব চেনা নন। ওঁর দলের নাম ‘একতা’ Ensemble Kashmir Theatre Akademi, মূলত শ্রীনগর কেন্দ্রীক দলগুলির মধ্যে বেশ বড় দল। আমরা দূর থেকে লে- লাদাখ- জম্মু- শ্রীনগর নিয়ে কাশ্মীর থিয়েটার বলি। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে ভৌগলিক অবস্থানটা এমন যে সকলেই বেশ আলাদা আলাদা অবস্থান রেখে চলতে বাধ্য। শুধু জম্মু আর শ্রীনগরের দূরত্ব প্রায় তিনশ কিলোমিটার। এখনো যোগাযোগ মূলত সড়ক পথে দিল্লি থেকে জম্মু যাতায়াত যত সহজ, শ্রীনগর ততটা নয়। মুল ভারতীয় ভুখন্ডের থেকে দূরত্বের ফলে জম্মুর থিয়েটারের তুলনায় শ্রীনগর থিয়েটার অনেকটা পিছিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। গোটা চার-পাঁচেক দল কাজ করে, আর এই একতা গ্রুপ চলে দাপট নিয়ে। কয়েকটি দল আছে বলে জেনেছি যে, তারা এক ধর্মীয় হয়েও আলাদা গোষ্ঠীগত ভাবে দল চালনা করেন। যেমন, ‘গোরজি মঞ্চ’ বা ‘ডোগরি মঞ্চ’ ইত্যাদি। যদিও এ বিষয়ে নিজে খুব জেনে উঠতে পারিনি। লোক মুখে যতটা জানতে পেরেছি, তাই বলছি।

শ্রীনগরে একটি মাত্র থিয়েটার হল। সেই ১৯৬১-তে রবীন্দ্র শতবর্ষে সারা ভারত জুড়ে যত রবীন্দ্র ভবন হয়েছে তারমধ্যে একটি এই ‘টেগোর’হল। শুরুতে সিনেমা থিয়েটার দুটোই দেখানো হতো এখানে। মনে রাখতে হবে শ্রীনগরে কোনো সিনেমা হল এখনো নেই। ছোট শপিং মলে ১৯৯৮- এর আগে দু-একটি সিনেমা হল ছিল শোনা যায়, তারপর সব বন্ধ। কাশ্মীরের অন্ধকার সময় বলতে যা বুঝি আমরা সেটা ১৯৯৮ থেকে ২০১৪ সাল। তখন টেগোর হল ছিল সেনা বাহিনীর আস্তানা। কোনো সাংস্কৃতিক কাজ হওয়া সম্ভব ছিল না। হতোও না। ২০১৪-র পর কিছুটা শিথিল হয় পরিবেশ, কাজ শুরু হলেও তেমন করে আজও কাজ হয় না। ২৪৬ জন বসার আয়োজন সহ একেবারে গুছনো একটা হল দেখে খুব খারাপ লাগলো, নিয়মিত কাজ হয় না বলে। প্রচুর আলো লাগানো, সাউন্ড সিস্টেম খুব ভালো, মঞ্চটা বেশ ভালো অথচ একটা হল নিয়মিত চলার মত কাজের দল নেই। শুনলাম ১৯৯৮-তে শেষবারের মত একটা উৎসব হয়েছে শ্রীনগরে, তারপর আর হয় নি। যারা নিয়মিত কাজ করতে চান তারা মূলত জম্মু বা দিল্লিকেই বেছে নেন। বিশেষত দিল্লি, কারণ অন্ধকার সময় তো জম্মুতেও ছিল। তাই কাশ্মীর থিয়েটারের যাদের চিনি আমরা তারা প্রায় সকলেই জম্মুর মানুষ।
একমাত্র ভবানী বশীর- যে অনেক আহ্বান ত্যাগ করে শ্রীনগরকেই নিজের কাজের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়ে কাজ করে চলেছেন। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে পাশ করে শ্রীনগরের থিয়েটার নিয়ে বেঁচে থাকার পন করেছে সে। অনেক হতাশা নিয়ে লড়ে যাচ্ছে সে। আর হতাশ হবার যথেষ্ঠ কারণ তো বিদ্যমান। এ বড় অদ্ভূত স্থান বলে মনে হয়েছে আমার। এখানে কোনো গানের স্কুল- নাচের স্কুল নেই, শিশুদের- যুবকদের সময় কাটানোর কোন পরিসর নেই। দশ গজ দূরে দূরে মোতায়েন সেনাবাহিনী, রাস্তায় অনবরত চেকিং- এসব এড়িয়ে সংস্কৃতির বিকাশ হবে কি করে? ভূস্বর্গের তলায় তলায় তো মানুষের এই অন্ধকার আর হতাশা লুকিয়ে আছে। ভ্রমণের নেশায় সেসব আমাদের নজরে আসে কতটুকু?

১৪ বৈশাখ ১৪২৯

One thought on “শ্রীনগরের থিয়েটার

  1. খুব ভালো ব্যাখ্যা আমরা পড়লাম লেখকের এই লেখায়। দেশ, সময়, সংস্কৃতি ও ওই অঞ্চলের থিয়েটারের অবস্থান বোঝা গেল।
    তবে কেমন থিয়েটার হয় তা জানতে পারলে আরও ভালো লাগতো।

Comments are closed.