নদিয়ার বেথুয়াডহরী, ধুবুলিয়া, কৃষ্ণনগরে দীর্ঘদিন থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শুভ্রা রায়। থিয়েটার নিয়ে অনেক লড়াই, মাঠে ময়দানে মঞ্চে থিয়েটার, বিভিন্ন দলে নানা নাটকে অভিনয় ইত্যাদির সঙ্গে জড়িয়ে থাকাটাই শুভ্রার জীবনের পরম আনন্দ। থিয়েটার নিয়ে চলার পথে অনেক আনন্দ, সুনামের পাশাপাশি সুখ দু:খের নানা অভিজ্ঞতা, অভিমান জমা আছে তাঁর জীবনে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই থিয়েটার ছাড়েননি অভিনেত্রী শুভ্রা রায়।
আসলে ছোটবেলা থেকেই থিয়েটারে যুক্ত হওয়া। তখন বালিকাবেলা। ১৯৮০ র পরবর্তীকালে যখন বেথুয়াডহরী কিণ্ডারগার্ডেন শিশু বিদ্যামন্দিরের ছাত্রী, তখনই জুতা আবিষ্কার, মুচির বৌ নাটকে অভিনয়। কিন্তু সেটাই শেষ নয়, বরং শুরু বলা যায়। তারপর বিভিন্ন দলে বিভিন্ন নাটকে অভিনয়। শুধু অভিনয় নয়— শুভ্রা কখনো সংগঠক, কখনো পরিচালক, কখনো দলের প্রয়োজনে নাটককার। পাশাপাশি সুযোগ পেলেই বিভিন্ন প্রশিক্ষকের সান্নিধ্যলাভে নাটক শেখা।
সেই ছোটবেলাতেই কিণ্ডারগার্ডেন স্কুলের সীমানা পেরিয়ে ১৯৮৬-১৯৮৮ নাগাদ ধুবুলিয়া ঐকতানে রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে “ছুটি” নাটকে ফটিক, “ডাকঘর” নাটকে অমল।যখন সপ্তম অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তখন মেয়েদের নিয়ে চিত্রাঙ্গদা,শাপমোচন নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ। ততদিনে ধুবুলিয়া শরৎপল্লীর মেয়েদের নিয়ে অগ্রদূত নামে দল তৈরি করে ফেলেছিলেন শুভ্রা। পরবর্তীতে ঐকতান দলে নানা নাটকে অভিনয় করতে করতে পরিপূর্ণ অভিনেত্রী হয়ে ওঠা। সেথুয়া, মধুরেণ, গুলশন, দুই বোন, রঙ্গে চাঁপার বাস প্রভৃতি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নাটকে অভিনয়ের সূত্রে দর্শকের প্রশংসা আদায় করে নেয়। পরিচালক হিসাবে পেলেন তুহিন দে, স্বপন পাল, ভাস্কর সেনগুপ্তকে। বাদল সরকারের “ভুল রাস্তা” নাটকে একক অভিনয়ে রীতিমত চমকে দিয়েছিলেন শুভ্রা। জেলার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর শিরোপাও জুটেছিল অভিনয়ের জন্য।
এভাবেই পৌঁছে যাওয়া কলেজ জীবনে। কিন্তু নাটক তখনও জড়িয়ে জীবনে। কৃষ্ণনগর থিয়েটার অঙ্গনে যুক্ত হয়ে ভাত কুড়াই, মোরগা জবাই, রঙ্গে চাঁপার বাস প্রভৃতি নাটকে অভিনয়। নাট্য আকাদেমির অনুদানে তুহিন দে’র পরিচালনায় সুকুমারী দত্তের “অপূর্ব সতী” নাটকে অভিনয়ের সুযোগ। কলকাতার মধুসূদন মঞ্চেও এ নাটক অভিনীত হয়েছিল। এই তুহিন দে’র পরিচালনাতেই কৃষ্ণনগর পরম্পরা দলে “কিনু কাহারের থ্যাটার” নাটকে অভিনয়। এ নাটকে মিউজিক কম্পোজ করেছিলেন শুভেন্দু মাইতি।
পরবর্তীতে কৃষ্ণনগর সিঞ্চন নাট্যদলে যোগ। সুশান্তকুমার হালদারের পরিচালনায় সমুদ্র মন্থন, বিনির্মিত বৃত্তে নাটকে অভিনয়। অভিনয়ের সূত্রেই অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্রে কাজ করার স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। ২০১৯ সালে কৃষ্ণনগর সংশোধনাগারে “রক্তকরবী” নাটকে চন্দ্রা চরিত্রে অভিনয়। কৃষ্ণনগর সিঞ্চনে অভিনয়ের কালে নেপালের ইটাহারী নাট্য উৎসবে সমুদ্রমন্থন ও বাংলাদেশের রাজশাহীতে বিনির্মিত বৃত্তে নাটকে অভিনয়। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সূত্রে বিভিন্ন পথনাটকে অভিনয় করেছেন। ২০২০ এর অগাস্টে কৃষ্ণনগরে মেয়েদের নিয়েই গড়ে তুলেছেন “জীবনের ঐকতান” নাট্যদল। এই দলে থিয়েটারের সমস্ত কাজ মেয়েরাই করে।নিজের লেখা একটু আগুন দে এবং ড্রাগ কিলস লাইফ প্রভৃতি সচেতনতামূলক নাটক বহুবার অভিনীত হয়েছে কৃষ্ণনগরে। সুন্দরবন, শান্তিপুরেও হয়েছে। মিডিয়ার বাচ্চা নাটকটিও শুভ্রার একটি উল্লেখযোগ্য নাটক। আবৃত্তি, নৃত্য, শ্রুতিনাটকের জগতেও শুভ্রার স্বচ্ছন্দ বিচরণ। ব্যারাকপুর মিলিটারি হসপিটালে ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেয়েছেন।
থিয়েটারের পাশাপাশি শুভ্রা একজন ভাল সংগঠক। মেয়েদের এবং শিশুদের নিয়ে কৃষ্ণনগরে নানারকম কাজ করে চলেছেন।নেপথ্য শিল্পীদের সম্বর্ধনা, মহিলাদের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। বেশ বড় করে নারী দিবস উদযাপন করেন । মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে সরকারী সহযোগিতায় স্বাক্ষরতা নিয়ে নাটক করেছেন।
নাট্যব্যক্তিত্ব অশোক মুখোপাধ্যায়, মুরারী রায়চোধুরী, তীর্থঙ্কর চন্দ, কৌশিক চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ নাট্যপ্রশিক্ষকের কাছে থিয়েটারের পাঠ নেবার সুযোগ হয়েছে শুভ্রার। সুবোধচন্দ্র রায় ও অর্চনা রায়ের মেয়ে শুভ্রা ছোটবেলা থেকেই এসব কাজে মা-বাবার কাছে যেমন প্রেরণা পেয়েছেন, তেমনি থিয়েটারের কাজেও। বহু মানুষের কাছেও পেয়েছেন প্রশংসা ও প্রেরণা। স্বামী, মেয়ে নিয়ে ঘোর সংসারী হয়েও স্কুল শিক্ষিকা শুভ্রা রায় থিয়েটারের জগৎ, সংস্কৃতির জগতে বিচরণ করছেন দাপটের সঙ্গে। থিয়েটারের কাজে গড়ে তুলছেন মহিলাদের ও নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের।