অভিনয়ের ময়দানে দুরন্ত সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলে চলেছে সুমন্ত | পর্ব -৩৪ | বিজয়কুমার দাস

বাংলা থিয়েটারে একটা শক্তিশালী প্রজন্ম উঠে এসেছে। অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিষ্ঠায় এরা নিজেদের গড়ে তুলেছে নানা প্রশিক্ষণে আর অবিরত থিয়েটার চর্চায়। যে কোন চরিত্রে এই অভিনেতা অভিনেত্রীদের নিয়ে বাজি ধরতে পারেন থিয়েটার নির্মাতারা। এই প্রজন্মের এক দুরন্ত এবং শক্তিশালী অভিনেতা সুমন্ত রায়। বলা যেতেই পারে, বিভিন্ন নাট্যদলের বিভিন্ন নাটকে বিভিন্ন মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সুমন্ত রায়। অথচ তার অভিনেতা হয়ে ওঠার কোন বিশেষ প্রস্তুতিপর্ব ছিল না। আর পাঁচজনের মতই নিছক পাড়ার দাদাদের ডাকে সাড়া দিয়ে “ডাকঘর” নাটকে অমল চরিত্রে অভিনয় করেছিল ছোটবেলায়। সে তো কতজনেই করে? সবাই কি পরবর্তীতে থিয়েটারের মঞ্চ শাসনের যোগ্য হয়ে ওঠে?

বরানগরের সুনীল কুমার রায় আর মঞ্জু রায়ের পুত্র সুমন্ত যখন ষষ্ঠ – সপ্তম শ্রেণির মাঝামাঝি বয়সের নিরিখে তখনই তার “অমল” হয়ে ওঠা। বরং অভিনয়ের চেয়ে ছেলেবেলায়, কিশোরকালে আবৃত্তি আর ভাষ্যপাঠে বেশি আগ্রহী ছিল সুমন্ত। যদিও কাকা নিখিল রায় অফিসপাড়ার থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু “ডাকঘর”ই শেষ নয়, বরং শুরু বলাই ভাল। কারণ পাড়ার অশোক ভট্টাচার্যর পরিচালনায় “চাপা পড়া মানুষ ” নাটকে ঘোষক চরিত্রেও মঞ্চে নামতে হয়েছিল। কলেজ জীবনে এসেও নাটক তার পিছু ছাড়েনি। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজে প্রাক্তনী অতীশ চন্দ্রর আহ্বানে মনোজ মিত্র রচিত “টু ইন ওয়ান” নাটকে অভিনয় করতে হল সুমন্তকে। আর সচেতনভাবে মঞ্চে নামা এই অতীশ চন্দ্রের আহ্বানে ঋক নাট্যদলে “ঊরুভঙ্গম ” নাটকে অশ্বত্থামা চরিত্রের মধ্যদিয়ে গ্রুপ থিয়েটারে ঢুকে পড়া। তারপর আবার একটি ফ্রেঞ্চ নাটকের রূপান্তরে ( অরূপ রুদ্র রূপান্তরিত) “কোথা যাও জেরিন?” নাটকে অভিনয়। ঋক নাট্যদলের হয়েই গিরিশ মঞ্চে অভিনয় করার সুযোগ এলো। সুমন্ত হয়তো অনুভব করতে লাগল মঞ্চমায়ায় জড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ। নাহলে বিজ্ঞানের স্নাতক হওয়ার পর সুমন্ত রায় রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক নিয়ে পড়তে ঢুকে পড়বে কেন?

…পাড়ার রবীন্দ্র নজরুল অনুষ্ঠান, ডাকঘর নাটকে অমল, কলেজে এবং ঋক নাট্যদলে অতীশ চন্দ্র নামের ব্যক্তি, গিরিশ মঞ্চে অভিনয় করা – এইসব তাকে টেনে নিয়ে এল রবীন্দ্র ভারতীর নাট্য বিভাগে। সেখান থেকেই নাটকে স্নাতকোত্তর। সুমন্ত পুরোপুরি অভিনেতা হয়ে আত্মপ্রকাশ করল। বাংলা থিয়েটারের মঞ্চ যেনো তার মত এক অভিনেতার জন্য প্রহর গুণছিল।

রবীন্দ্রভারতীর নাট্যশিক্ষার পাশাপাশি NSD প্রাক্তনী শান্তনু বোসের সহায়তায় মণিরথ এ প্রায় দু’সপ্তাহ ব্যাপী একটি কর্মশালায় যোগ দিয়েছিল। সেখানে গিরিশ কারনাডের “রক্তকল্যাণ” নাটকে দুটি চরিত্রে অভিনয় তার থিয়েটার জীবনের মুকুটে নতুন পালক সংযোজিত হলো। আর থিয়েটার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার উপায় রইল না সুমন্তর। ২০০৩ সালে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় আন্তর্জাতিক স্তরের বিশিষ্ট নাট্যপ্রশিক্ষকদের অধীনে এক মাসের কর্মশালায় থিয়েটারের পাঠ নিয়ে সুমন্তর মন আরো দৃঢ় হলো।

শুরু হয়ে গেল পাকাপাকি থিয়েটারের জীবন। অভিনেতা নির্দেশক কৌশিক সেনের স্বপ্নসন্ধানী নাট্যদলের হয়ে বুদ্ধদেব বসু রচিত “প্রথম পার্থ” নাটক করে এল এলাহাবাদে। যোগসূত্র সেই শান্তনু বোস। পরে এই দলের ব্রেখট অবলম্বনে সুমন মুখোপাধ্যায়ের রূপান্তরে “দুশমন নাম্বার ওয়ান” নাটকে গুডউইন, ডাকঘর নাটকে দইওয়ালা, মাল্যবান নাটকে ভাঁড়, বিদূষক নাটকে মন্ত্রী, বঙ্কুবাবুর বন্ধু নাটকে নিধু মোক্তার চরিত্রে মঞ্চে নিজের জাত চেনাল সুমন্ত। বিশিষ্ট নাট্যজন অরুণ মুখোপাধ্যায়ের চেতনা নাট্যদলে “মানুষ কিংবা কোলবালিশ” নাটকে বাঁড়ুজ্জে চরিত্রে আমন্ত্রিত অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিল।

এরপর শুরু হলো মিনার্ভা জীবন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মিনার্ভা থিয়েটার মানেই অভিনেতা অভিনেত্রী তৈরির নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। ২০১০ সালে যে ১৪ জন মিনার্ভায় যুক্ত হয়েছিল তাদের অন্যতম হলো সুমন্ত। এখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় “রাজা লিয়ার” নাটকে বিদূষক, দেবী সর্পমস্তা নাটকে কোরাস, কৌশিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত “চন্দ্রগুপ্ত” নাটকে ভিক্ষুক চরিত্রে অভিনয় করল। ভিক্ষুক চরিত্রে নিজের গলায় গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সুমন্ত। ২০১৩ সালে মিনার্ভার ঘোষণা অনুযায়ী পরীক্ষা দিয়ে নির্বাচিত হয়ে আবার “দেবী সর্পমস্তা” নাটকে ডাহুক চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা পেলো।এখানেই দেবাশিস রায়ের “কাঁকড়া”, শেখর সমাদ্দারের “পদ্মগোখরো”, আশিস চট্টোপাধ্যায়ের “হাজু মিঞার কিস্যা” নাটকে সকলের নজর কাড়ল সুমন্ত। কাঁকড়া নাটকে প্রযোজনা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব সামলে একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিল।

মিনার্ভায় থাকতে থাকতেই থিয়েটার দুনিয়ার গুপ্তকক্ষের সন্ধান মিলল। একের পর এক বিখ্যাত নাট্য পরিচালকদের অধীনে বিভিন্ন নাট্যদলে অভিনয়ের সুযোগ আসতে শুরু করেছে। ছেলেবেলার “ডাকঘর ” এর সেই অমল এর রূপকার সুমন্তর সামনে তখন নানা নাটকে নানা চরিত্রের ভিড়।

অভিনেতা, নাটককার নির্দেশক ব্রাত্য বসুর সঙ্গে “মুম্বাই নাইটস” নাটকে সূত্রধার চরিত্রে অভিনয় তার জীবনের একটা মাইলফলক।মিনার্ভা ছাড়াও ব্রাত্য বসুর কালিন্দী ব্রাত্যজন দলে “শনিবার” নাটকে অভিনয় এবং পৃথ্বীশ রাণার পরিচালনায় “ও:স্বপ্ন” নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি “মীরজাফর ” নাটকে উমিচাঁদ (এবং সহ পরিচালনা) এবং এই দলের ছোটদের নিয়ে তিন বছর ডমরু চরিত কথা (নাট্যরূপ ও পরিচালনা) সহ ভোম্বল সর্দার ( নাট্যরূপ,পরিচালনা),পাণ্ডব গোয়েন্দা (নাট্যরূপ) র কাজ তাকে অন্য আনন্দ দিয়েছিল। রাজশেখর বসু অবলম্বনে পৃথ্বীশ রাণার “গ্যাং” নাটকের নাট্যরূপ এবং সহ পরিচালনা তার নাট্যজীবনকে অন্যভাবে ঋদ্ধ করেছিল।

এমনই একের পর এক বিভিন্ন দলের বিভিন্ন নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে সুমন্ত চমকে দিল বাংলা থিয়েটারের দর্শকদের। এরপর ২০১৮ তে ব্রাত্য বসুর লেখা অশোকনগর নাট্যমুখ এর প্রযোজনা অভি চক্রবর্তীর নির্দেশনায় ” আমি অনুকূলদা আর ওরা ” নাটকের অনুকূলদা চরিত্রে সুমন্ত নাটকের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্র হয়ে উঠল।  এছাড়া বালি প্রভাত নাট্যসংস্থায় “ভূতান্বেষী”, সুদীপ সিংহর পরিচালনায় বারাসাত রমেশপল্লী প্রযোজনায় “বিনয়ের জীবন”, “দ্বিতীয় পক্ষ”, “সুখ” ,”দ্বিধা”,পার্থসারথি রাহার পরিচালনায় অশোকনগর প্রতিবিম্বর “খোকাদা” এনে দিয়েছে এবছর পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান। আরো অসংখ্য নাটকে অভিনীত চরিত্ররা মাঝেমধ্যে মঞ্চে আসে যায়। যেমন প্রান্তিক চৌধুরীর পরিচালনায় দমদম ব্রাত্যজনের “দেবদাস” (চুণীলাল) তার অভিনয় জীবনের সম্পদ। মিনার্ভার “পাঁচের পাঁচালী”র চারটে নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি য্যায়সা কা ত্যায়সা নাটক পরিচালনা, মৃচ্ছকটিক নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি সম্পাদনা, সিনোগ্রাফি, অরুণ মুখার্জীর “খড়ির গণ্ডি” নাটকে শাহজী ও কথক চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ হয় পাশাপাশি ব্রাত্য বসুর মত নির্দেশকের সঙ্গে কাজ তার অভিনয় জীবনের সুবর্ণ সঞ্চয়।

যাদবপুর মন্থন দলে হাসান আজিজুল হকের রচনা অবলম্বনে “আগুনপাখি” (নাট্যরূপ এবং নির্দেশনা) সুমন্তর জীবনে একটা ভাল লাগার কাজ। হাসান আজিজুল সাহেব নিজে এ নাটক দেখেছিলেন। অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী পৌলমী বসু।

নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি সুমন্ত যে-সব ছায়া ছবিতে কাজ করেছে সেগুলোর মধ্যে হারবার্ট, মহানগর @ অফ কলকাতা, চতুরঙ্গ এই তিনটিই সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালনায়, এরপর হ্যালো মেমসাহেব নন্দীতা- শিবপ্রসাদের পরিচালনায়, সংঘমিত্রা ব্যানার্জীর পরিচালনায় রাতপরীর রূপকথা ছবিতে সাংবাদিক চরিত্রে , ব্রাত্য বসু পরিচালিত ডিকশনারি ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি সহ পরিচালনা কাজ করেছে। প্রথম ওয়েব সিরিজে অভিনয় অনির্বাণ ভট্টাচার্য এর মন্দার এ, বল্লভপুরের রূপকথা সম্প্রতি কাজ শেষ হলো এটাও অনির্বাণ ভট্টাচার্য পরিচালিত বড়পর্দার ছবি।

১০ টি নাট্যদল নিয়ে ইন্দ্ররঙ্গ নাট্য প্রতিযোগিতায় অভিনেতা প্রসেনজিৎ বর্ধন এর সাথে সুমন্ত যুগ্মভাবে জাজেস জ্যুরি এওয়ার্ড পেয়েছিল। বাংলা থিয়েটারে নানা চরিত্রে প্রথম শ্রেণির ফুটবল দলের দুরন্ত সেন্টার ফরোয়ার্ডের মত সুমন্ত যেন থিয়েটারের অঙ্গণে তেমনই এক দুরন্ত অভিনেতা যে মঞ্চে এলেই দর্শককে তার দিকে আকৃষ্ট করতে বাধ্য করে। এভাবেই এগোচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে থিয়েটার মাঠের নজরকাড়া সেন্টার ফরোয়ার্ড সুমন্ত রায়। সেই কিশোরবেলার “ডাকঘর ” এর অমল এভাবেই অভিনয় অঙ্গনে অনিবার্য করে তুলেছে নিজেকে।

34 thoughts on “অভিনয়ের ময়দানে দুরন্ত সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলে চলেছে সুমন্ত | পর্ব -৩৪ | বিজয়কুমার দাস

  1. অজানা সুমন্তকে জানতে পারলাম বিজয়দার কলম থেকে। শুভেচ্ছা রইলো।

    1. অনেক ভালোবাসা বিজয় দা। লেখাটা পড়ে মনটা খুব ভালো হয়ে গেলো। অভিদা অসীমদা ভালোবাসা জেনো

      1. তোমার কথা বলতে পেরে আমরাও ভীষণ খুশি। ভালোবাসা জেনো।

    1. সুমন্ত রায় ভাল অভিনেতা।যেদিন অমল আলোয় সুমন্তকে নিয়ে লেখাটা বের হল, তার আগের দিনই তপন থিয়েটারে ড:সিতাংশু খাটুয়ার নির্দেশনায় গড়িয়া কৃষ্টির ” মাধুকরী”তে সুমন্তর অভিনয় দেখলাম।আগেও অন্য নাটকে দেখেছি।সত্যিই এখন থিয়েটারের ময়দানে সুমন্ত সেন্টার ফরোয়ার্ড।অভিনন্দন সুমন্ত।

  2. সুমন্ত অভিনেতা হিসেবে তো ভালই কিন্তু মানুষ হিসেবেও অত্যন্ত সরল এবং ঋজু।

  3. May I simply just say what a relief to find someone who truly understands what they are discussing on the web. You definitely understand how to bring a problem to light and make it important. More and more people ought to check this out and understand this side of your story. Its surprising you arent more popular because you definitely have the gift.

Comments are closed.