‘জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যে- মাথার খুলিতে
গোপন আকাঙ্ক্ষাগুলি নিঃশব্দে বহন করি, ডোমেরও অজ্ঞাতে।
গচ্ছিত সামগ্রী যেন, খোজাদের শিলালিপি, পাঠোদ্ধারহীন,
জড় ও নিশ্চল, গায়ে ঘোড়ার মূত্রের গন্ধ, সাপ;
পাহাড়ি কুলির মতো, মূঢ়, উদাসীন,
নিঃশব্দে বহন করি শুধু এই স্থায়ী মনোভার-
ক্ষণজীবী মানুষের স্বপ্নেও ব্যবহৃত এই বোঝা, কার?’
উপরোক্ত কবিতার নাম ‘সিসিফাস’। কবি রণজিৎ দাশ। কবি সিসিফাসের মিথের অলংকার ও প্রসাধন ব্যবহার করে জন্ম ও মৃত্যুর মাঝের যে নির্ধারিত প্রহরকাল এবং সেই কালে আমাদের যে গোপন আকাঙ্ক্ষা, অবশ্যম্ভাবী অভীপ্সা, গচ্ছিত সঞ্চিত যা কিছু- যে দুর্বোধ্য শিলালিপির মতো এই অভিশপ্ত জীবনকাল যা হয়তো পড়ে ওঠা যাবেনা তার কথাই, সে মনোভাবের কথাই উচ্চারণ করতে চেয়েছেন। পাঠক হিসেবে আমার অন্তত এই মনে হয়েছে। নাট্যেও আমরা সেই দুর্বোধ্য শিলালিপির পাঠোদ্ধারেই মগ্ন থাকি। কখনো অধ্যয়নে, কখনো পরিকাঠামোয়।
আমরাও খানিক দোলাচলে থাকতে থাকতেই ‘অমল আলো’ নাট্যকেন্দ্র করে ফেলেছিলাম,সেসব নিয়ে বহু লেখা হয়ে গেছে তাই বিস্তৃত বিবরণে গেলাম না এখানে। আসলে সর্বসংহারী থিয়েটার আরো চায়, সে ভাঁড়ারের কথা না ভেবেই চায়। নিঃস্ব হয়ে তাকে দিয়ে যাবার এই আত্মসংহারী উদগ্র প্রবণতাকে আমরা যতো দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছি সে ততো নিকটে এসে বসবার জন্য নিশপিশ করেছে। চোরা হাসিতে উন্মাদ করে আমাদের আলো থুড়ি অগ্নুৎপাতের সন্মুখে এনে ফেলেছে। প্রমত্ত নিষ্ঠুরতায়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ঝাঁপিয়েছি আমরা। ফলত অমল আলোয় একশো অভিনয় হবার পাশাপাশি, কোভিডে দ্বিতীয়বার বন্ধ হবার পাশাপাশি আমরা জোর দিচ্ছিলাম অ্যাকাডেমিক্সের প্রতি, এই স্পেসকে ঘিরে বা না ঘিরে ইদানীংকালের (পোস্ট কোভিডে) বাংলা তথা বিশ্বনাট্যের চরিত্র বা চরিত্রান্তর ফিরে পড়বার দুর্গম ইচ্ছে হল আবার, আমাদের। কবির ভাষায় পাহাড়ি কুলির মত এই মনোভারই আসলে আমাদের এক একটি কাজের প্রখর পিপাসার মতো গলার কাছে খণ্ড পাথরের মতো জেগে থাকে। তাই নির্জন গ্রীস্মের একলা কাকের মতো নুড়ি ফেলে ফেলে জল তুলবার এই অদম্য প্রয়াস। মধ্যাহ্ন আলস্য বা আলতো অভিমানের কোনো প্রশ্রয় নেই আমাদের কাজবাজারে। কর্মতৎপর থাকার মধ্যেকার আনন্দ খুঁজে নেবার আরেকটি প্রকাশ এই অমল আলো জার্নাল।
কালের নিয়মেই যেমন নাট্যমুখ-নাট্যপত্র গড়ে উঠে আবার বিলীন হয়ে গেছিল এও তাই হতে পারে। কিন্তু যেটুকু করে রাখা যায় তাই বা কম কীসে? আজকাল আর তা নিয়ে চিন্তিত হইনা খুব বরং ভাবি এই শঙ্কাকালেও কতো মানুষ সঙ্গে রইলেন। আর সেই সঙ্গে থাকার স্বপ্নকে আরেকটু লালন করবার জন্যই এই জার্নালে, অশোকনগর নাট্যমুখের সদস্যরা যুক্ত থাকলেও দলীয় সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আমরা তৈরি করে নিয়েছি এসময়ের অত্যন্ত যোগ্য কিছু মানুষজনের সমন্বয়ে এক সম্পাদকমন্ডলী। আছেন তাতে খ্যাতনামা সাহিত্যিক-নাট্যজন শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ, সাহিত্যিক-অধ্যাপক অর্ণব সাহা, সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী- কৌশিক মজুমদার, সাহিত্যিক- শমীক ঘোষ এবং নাট্যকার-অধ্যাপক সৌরভ গুপ্ত। এনাদের সঙ্গে নাট্যমুখের সম্পর্ক প্রাচীন পারিবারিক এবং বহুস্তরীয়। ফলত এই অমল আলো জার্নালে এনাদের অন্তর্ভুক্তি আমাদের সম্পর্কের পলেস্তারা আরো সুদৃঢ় করল, আপাতত এটুকুই বলা যায়। দল থেকে সম্পাদনার দায়িত্বে আছেন নাট্যমুখ পত্রিকার প্রথম কিছু সংখ্যার সম্পাদক অসীম দাস ও দলেরই দীর্ঘদিনের সদস্যা অঙ্কিতা ব্যানার্জী। যার পড়াশুনাও সাংবাদিকতা নিয়েই।সামগ্রিক সজ্জা ও বিন্যাসের কাজ করেছেন তমাল মুখোপাধ্যায়। এছাড়াও একদল নতুন ছেলেমেয়ে টাইপিং, পোস্টার তৈরি ইত্যাদি নেপথ্যকর্মে মনপ্রাণ এক করে লড়েছেন। প্রুফ দেখেছেন বন্ধু শ্যামলেশ ঘোষ।
অনেকগুলি জরুরি ধারাবাহিক শুরু করা গেল যা থিয়েটারের নতুন পুরনো সকলেরই কাজে লাগবে বলে বিশ্বাস করি। প্রাথমিক লেখা নেবার ক্ষেত্রে দস্তয়ভস্কির কথাই মাথায় রাখা হল, ‘…তুমি যাই বলো না কেন, তুমি তো জানো, বাস্তবে বাছাই বলে কোনো বস্তু নেই।’ তাই বয়েস নির্বিশেষে সকলকে আহ্বান প্রয়োজনীয় লেখা জমা দিন। নাট্যদলেরা তাদের খবর পাঠান।কেননা আমরা রিলকের মতই বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, ‘আমরা আবিস্কার করেছি যে আমরা আমাদের ভূমিকা জানিনে। একটা আয়না খুঁজছি আমরা। আমাদের সাজ খুলে ফেলতে চাচ্ছি, যা কিছু আমাদের মিথ্যে সরিয়ে ফেলতে চাই, হতে চাই সত্য। কিন্তু ভুলে গেছি এমন একটা টুকরো ছদ্মবেশ, কোথাও তবুও লেগে আছে।’
আসুন অমল আলো জার্নালের মধ্যে দিয়ে আমরা ছদ্মবেশ উন্মোচনের দিকে যাই।