নববর্ষ আসে যায়। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে তারিখ সাজান ক্লান্ত সিসিফাস। দূর থেকে থিয়েটারের বিবিধ হ্যাংলামো দ্যাখেন, থিয়েটারের যুগভেদে চরিত্র বদল দেখে গুমরে ওঠেন ভিতরে ভিতরে। হাসেন। হাসতে হাসতেই পাথর তোলেন। গড়িয়ে যায় নোনা জল গাল বেয়ে। আবার পাথর তোলেন।
আজকাল আর কেউ আসেনা বিশেষ এখানে। একে রুক্ষ নির্জনতম স্থান, তারপর এই মহামারী শেষে যে যার ঘরেই নাট্য তৈরি ও প্রদর্শনে রত। সবাই নাকি স্পেস করেছেন! বাইরে বেরোয় না তাই কেউ। অন্য পেশার লোকজন সেইসব স্পেসের ছবি তুলে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি টবি তুলে বিখ্যাত হয়ে গ্যাছেন ইতিমধ্যে।
এতোসব ঘটে যাওয়া কান্ডের মাঝে তবু আজ একজন এসেছেন। অনেক দূর থেকেই এসেছেন।
সিসিফাস দেখলেন, ঝকঝকে ছেলেটির, গলা বড় মিনমিনে। কথা আটকে আটকে বলেন। মাঝে মাঝেই গালে কীসব মাখছেন, জিজ্ঞেস করলে জানালেন সূর্যের হাত থেকে বাঁচার উপায়। ছেলেটি তাকে প্রশ্ন করেন-
-অনেক তো বয়েস হল, এখনো এসব আপনি করেন কেন?
– তাহলে কে করবে? (শ্রমের উচ্ছ্বাসের মধ্যেও বিরক্ত খানিক বৃদ্ধ সিসিফাস বলে ওঠেন)
– কেন গোটা ভুবন জুড়ে আপনার শিষ্যরা নাট্যের জন্য সমর্পিত, তারা কেউ নেই?
– (পাথরটাকে মাথার উপর তুলে, সামান্য প্রোফাইলে তাকান সিসিফাস, তাকে ঈষৎ ক্লান্ত লাগলেও বড় বেশি একগুয়ে এবং সংকল্প-প্রবণ লাগে, একমনে বলেন) শিষ্য বলে কিছু হয় নাকি এখন আর? শুধু নাট্যে কেন? ওই ধরাধামে ইস্কুল কলেজ না কীসব আছে শুনি। তার প্রধানরাও তো দেখি আজ ঘেরাও হন, কাল উড়ে আসা বাসন- কোসন সামলাতে টেবিলের তলায় লুকিয়ে পড়েন- শিষ্যরাই তো করেন এসব শুনি? আপনি কে ভাই? এই ধরাধামে থাকেন না? মাঝ দুপুরে এসব শিষ্য টিষ্য বলে সময় নষ্ট করছেন?
– না না, ইস্কুল কলেজ ওসব অনেক বড় ব্যাপার স্যার! ও পাট আমি চুকিয়ে ফেলেছি কবেই। আমি থিয়েটার করি। মাঝেমধ্যে খানিক পর্দায় কাজকর্মও করি- কিন্তু আমি খুব অস্থির হয়ে আছি। আমি আরেকটু শিখতে চাই?
– শিখবেন? মানে কি শিখবেন?
– আমি তালিম নেব আপনার কাছে। পৃথিবীতে গিয়ে বলব, আমার নাট্যগুরুর নাম সিসিফাস। দেখি শালা কোন প্রোডাকশান হাউস আটকায়? স্যার আপনি সার্টিফিকেট দ্যান তো?
– কিসের?
– এই যে শেখার?
– মানে বোঝেনই তো এতোটা ইনভেস্টমেন্ট? প্রপার আউটপুট না এলে-
-পর্দায় যারা কাজ করেন তারা তো সব জানেন ভাই। সারাক্ষণ ওটা নিয়েই নিজেদের মধ্যে কথা বলেন, দেখেছি তারা কোথায় গিয়ে কাদের সঙ্গে দ্যাখা হল সেসব ইনিয়ে বিনিয়ে বলেন, আত্মতৃপ্তির চচ্চড়ি রান্না করেন। দলের বাকিরা সেই চচ্চড়ি চেটেপুটে খান- এখানে শেখার কোনো ব্যাপার নেই ভাই। আপনি আসুন।
– কিন্তু আমার গলা শোনা যায় নি, শেষ থিয়েটারের অভিনয়ে। এক্সপ্রেশানও নাকি প্রপার হয়নি। আলো নিতে গিয়ে অন্যকে ছায়ায় ঢেকে ফেলেছি আমি। ডিরেক্টর স্যার আমাকে খিস্তি করে বার করে দিয়েছেন। মহলা থেকে। আমি সাতদিনে চোদ্দোটা শুট ক্যান্সেল করে আপনার কাছে এসেছি স্যার, শেখার জন্য। এই আমার সব সার্টিফিকেট, আমি গোটা সাতেক পুরস্কারও পেয়েছি।
– (সমস্ত পাথরের মধ্যে অবিন্যস্ত পায়চারি করতে করতে বারবেলার তীক্ষ্ণ সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন বৃদ্ধ। ধীরে ধীরে দুটো পাথর ঠুকতে ঠুকতে বলেন)
– ওই পর্দায় আপনার গলা শোনা যায়?
– আলবাৎ যায় স্যার। ছোট ছোট ডায়ালগ পাই, কলার মাইক্রোফোন মানে ল্যাপেল থাকে আর কি! ফ্রেস ভয়েস। অসুবিধে হলে রিটেক হয়- ওখানে আমি স্টার স্যার…
– স্টার মানে?
– (লজ্জিত হয়ে) মানে স্যার, ইয়ে মানে আমার খুব নাম ডাক…ওখানে…
– ও আচ্ছা আচ্ছা। বেশ। তা এখন আপনি এক কাজ করুন-
– বলুন স্যার বলুন।
– মানে আপনি এখন ‘এই আমার খুব নাম ডাক ওখানে’, এটা নীচের সা থেকে উপরের সা অব্দি সুরে সুরে বলুন। পাহাড়ের গায়ে আমি যেন এর প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। আমি খানিক আগুন ধরিয়ে দিচ্ছি, দেখবেন এই আগুনের শিখা যেন না নড়ে। চলুন শুরু করি- (আগুন ধরানোর সম্ব্ল জড়ো করেন বৃদ্ধ)
– মানে? এই ফুটন্ত রোদে আমি এখন এইসব করব? এর নাম শিক্ষা? এই জন্যই তুই একা পাথর সরিয়ে যাবি আজীবন। কেউ সঙ্গে আসবেনারে অসহ্য উন্মাদ।
– আহা আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? গলা তৈরি করতে হবে আমাদের। আসুন আসুন। (চকমকিতে জ্বালা আগুনে বৃদ্ধের মুখের জৌলুস ঠিকরে বেরোচ্ছে)
-এইজন্যই শালা আজকাল কেউ নাটক করতে আসেনা। খানিক শিখতে চাইলাম, বুঝতে চাইলাম- আর এই বৃদ্ধোন্মাদ, আগুন জ্বালিয়ে চারটি সংলাপ নিয়ে তার এই নিজস্ব প্রাচীন উন্মাদাগারে আমাকে নিয়ে মাদারি খেলা দেখাতে চাইছেন। (হাঁটা লাগায়)
– কি হল? ফিরে যাচ্ছেন? যান। (অট্টহাসি, পাহাড়ে পাহাড়ে সে হাসি প্রতিধ্বনিত হয়) আপনারা যত ফিরে যাবেন, থিয়েটার ততো শুদ্ধ হবে। এই যে দেখছেন এতো পাথর, সব তুলবো- তুলবোই। এই জেদ, এই অধ্যাবসায়, এই অনন্ত কর্মলিপ্সা না থাকলে আপনি পর্দায় কাজ করুন। এখানে নয়।
সূর্য এখন অস্তগামী, এক মেদুর ছায়ায় সিসিফাস খানিক জিরিয়ে নেবেন বলে মাথা রাখেন পাথরে। আর সেই ঝকঝকে অভিনেতাকে ধাওয়া করে এক প্রাচীন অট্টহাসির প্রতিধ্বনির তীব্র সমবায়।
চলবে