থিয়েটারের আঙিনায় কিছু কথা

তুষার ভট্টাচার্য

পর্ব- ৬

|| পোকা ||

কিছু মানুষের মাথায় এক ধরণের পোকা থাকে। মানুষ বিপদে পড়লে ওই ‘মাথায় পোকাওলা মানুষগুলো’র মাথার পোকাটা নড়ে ওঠে। নড়ে উঠলেই তারা আর এদিক সেদিক কিছু ভাবে না। ছোটে, প্রাণপণ ছোটে। খাওয়াদাওয়া, ঘুম, বিপদ-আপদকে ধুসস বলে উড়িয়ে সোজ্জা ওই বিপদে পড়া মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

দেখতেই তো পাচ্ছেন চারদিকে, রাত নেই — দিন নেই মোটর সাইকেল-টো টো- অটো- কাঁধে অক্সিজেন সিলিণ্ডার, খাবার, ওষুধ, ত্রিপল, পেশেন্ট… নিয়ে কিছু মানুষ পাহাড় থেকে সুন্দরবন ছুটেই যাচ্ছে। এই সব মানুষদের মাথায় ওই বিশেষ পোকারা বাস করে। এরা যুগে যুগে ছিল, আছে, থাকবে। আমার খুব গর্ব হয়, যখন দেখি আমাদের থিয়েটারেরও অনেক মানুষের মাথায় এই বিশেষ পোকারা বাস করে।

এক ভয়াবহ রোগে আমরা এবং পৃথিবীর সবাই আতঙ্কিত। এ আমরা সবাই দেখছি, শুনছি, পড়ছি, নানা মতামত দিচ্ছি। বাড়ির বাইরে যেতে পারছি না, কিছু করতে পারছি না। প্রায় সবকিছু বন্ধ।

গরীব মানুষের অবস্থা খুব খারাপ। সীমিত সাধ্যের মধ্যে অনেক মানুষ, মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, এটাই আশার কথা, ভরসার কথা। আমরা সবাই আশা করছি এই দুর্যোগ কেটে যাবে। আবার ভালো সময় ফিরে আসবে।

‘থিয়েটারের আঙিনায়’ লেখার সময়ে মন চলে গেল অনেকটা পেছনে। সেও ছিল বড় মারাত্মক সময়, খারাপ সময়, দুঃসময়।

১৮৯৮ সাল, মার্চ মাস। কলকাতায় দেখা দিল মারাত্মক প্লেগ। সেই রোগ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ল যে মানুষজন কলকাতা ছেড়ে পালাতে লাগলেন।

সাহিত্য সম্পাদক, সমালোচক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখলেন – কলকাতায় ভীষণ মড়ক। যে বাড়িতে প্লেগ ঢুকছে সে বাড়ি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। বাপ ছেলেকে, স্বামী বৌকে, ছেলে মা-বাবাকে ছেড়ে পালাচ্ছে। প্লেগের মড়া কেউ পোড়াতে চাইছে না। এমনকি আত্মীয় হলেও পোড়াতে যেতে চাইছে না… ইত্যাদি।

এই যখন অবস্থা, তখন কলকাতার থিয়েটারের কী হাল? সবকিছুর সঙ্গেই কেমন করে যেন থিয়েটারের একটা যোগ থেকেই যায়। এখানেও আছে। ওই যে সবাই বলেন নাটক সমাজের দর্পণ।

মে মাস নাগাদ যখন প্লেগের প্রকোপ খুব বেড়ে গেল তখন স্টার থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেল। প্লেগের ভয়ে গিরিশবাবু কলকাতা ছেড়ে রামপুর-বোয়ালিয়ায় চলে গেলেন। অমরেন্দ্রনাথ দত্ত কিন্তু থিয়েটার চালিয়ে যেতে লাগলেন।

অমরেন্দ্র থিয়েটার চালালেন মানে? একদম রে রে করে চালাচ্ছিলেন। একটু আগে থেকে বলি। ২৫ ডিসেম্বর, ১৮৯৭ তে ‘কাজের খতম’, ৮ জানুয়ারি- ১৮৯৮ তে ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’, ৮ মার্চ -১৮৯৮ দোলের দিন ‘দোললীলা’, সঙ্গে আলিবাবা তো আছেই। এতকিছুর পরে ৪ এপ্রিল রবিবার আলিবাবার সঙ্গে এই প্রথম থিয়েটারে হীরালাল সেনের সঙ্গে মিলে ‘বায়োস্কোপ’ দেখানো হল। তখন সিনেমা বলা হতো না। বায়োস্কোপ — সে তো আলাদা মিডিয়াম — তার শুটিং, অভিনেতা, আরও কত কী… বুঝুন সেই সময়ে কী পরিমাণ ব্যস্ততা ছিল তাঁর।

এই এত ব্যস্ততার মাঝে থিয়েটার, বায়োস্কোপের পাশাপাশি তিনি প্রাণের মায়া ত্যাগ করে প্লেগ রোগীদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন, টাকা দিয়ে সাহায্য করতে লাগলেন, মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। অনেককে প্রতিপালনের ভার নিলেন। আপামর মানুষ তাঁকে ‘গরীবের মা বাপ’ বললেন। তাঁর এইসব কাজ দেখে তখনকার বিখ্যাত কাগজ ‘নায়ক’ লিখলেন, “হৃদয়ের তুলনায় অমরেন্দ্রনাথ অপরাজেয়, বুঝি বা অদ্বিতীয়”।

এ তো কেলেঙ্কারি! থিয়েটার করছিস, কর না বাপু। নাচ-গান, নতুন নাটক, অন্যদের থেকে বেশি টিকিট কী করে বিক্রি হবে সেসব নিয়ে ভাব। তা নয়, মানুষের উপকার করতে লেগে পড়লেন মানুষটা। ইনি ওই মাথায় বিশেষ পোকাওলা মানুষ। আসলে মানুষটা ছিলেনই এমন। জমিদার বাড়ীর ছেলে। অন্য সব ইয়ে-টিয়ে তাঁর ছিল বৈকি। সঙ্গে মানুষের প্রতি ভালোবাসাও ছিল।

তা নাহলে দেখুন না, থিয়েটার করে বেরিয়ে ফুটপাতে একজনকে দেখলেন শীতে কাঁপছে, শাল খুলে দিয়ে দিলেন। এটা ওই লোক দেখানো দান নয়, অন্তর থেকেই দান। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাইনে-বোনাস বাড়িয়ে দিলেন। দর্শকদের বই উপহার দিতে শুরু করলেন। আরে, ব্যবসাটা কর। তা নয়, ব্যবসাও করব এসবও করব। এরকম কাজ করায় ছিল ওঁর খুব আনন্দ।

সুরেশবাবু আরো বললেন – “আত্মীয় লোক প্লেগ হইলে ভয়ে আত্মীয়ের সেবা করিতেছে না ; প্লেগের মড়া হইলে অন্য লোক দূরের কথা আত্মীয় লোকে আত্মীয়ের দাহ করিতেছে না। এইরূপ যখন অবস্থা, সেই সময়ে অমরেন্দ্রনাথ অর্থ সাহায্যও করিয়াছেন, তদ্ব্যতীত নিজের থিয়েটারের অভিনেতাদের লইয়া প্লেগে মরা বহু মড়া ঘাড়ে করিয়া তাহাদের সৎকার করিয়াছেন। অল্পদিন গত হইল যখন দামোদরের ভীষণ বানে বর্দ্ধমান জেলা ডুবিয়া যায়… অমরেন্দ্রনাথ নিজের মোটরে চড়িয়া, চিড়া মুড়কীর বস্তা ও কাপড়ের বস্তা লইয়া বন্যাপীড়িত ব্যক্তিগণকে সাহায্য করিয়াছেন”।

এই দেখুন, আবার। মানুষটা বন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। থিয়েটারের লোকগুলোই বোধহয় এমন হয়। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। বেশ করে। তাই না? বলুন? আরে বুনো মোষ তাড়াবার তো লোক চাই। তাদের না তাড়ালে তো বুনো মোষ ঘরে ঢুকে পড়বে।

বন্যায় সাহায্য করার কথায় মনে আসছে আর একজনের নাম – রাজবালা। ১৯২০ সালের বন্যায় ইন্দুবালার মা রাজবালার ক্যাপ্টেনশিপে মেয়েদের নাটকের দল নাটক করে, টিকিট বিক্রির টাকা এবং আরো অনেক কিছু নিয়ে কীভাবে বন্যাপীড়িত মানুষের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তার কথাও বলব। তবে আজ নয়। অনেকটাই বলব। আজ বললে আজকের বলাটা অনেক বড় হয়ে যাবে। থাক না, অন্যদিন বলি?

‘নায়ক’ কাগজের সম্পাদক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ও অমরেন্দ্রনাথের এই মহান ভূমিকার কথা লিখলেন। সঙ্গে আরো এক ঘটনার কথাও লিখলেন। পাঁচকড়িবাবু ও অমরেন্দ্রনাথ টমটম করে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। শীতকাল। ছাতুবাবুর বাজারের কাছে এক বৃদ্ধার কান্নার আওয়াজ শুনে টমটম থামিয়ে অমরেন্দ্র নেমে পড়লেন। বৃদ্ধার ছেলে প্লেগে মারা গেছে। শ্মশানে নিয়ে যাবার কেউ নেই। অমরেন্দ্র ক্লাসিক থিয়েটার থেকে লোক ডেকে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সৎকার করিয়ে ভোর সাড়ে চারটেয় বাড়ি ফিরলেন।

এরকম আরো অনেক ঘটনা এই মহান অভিনেতার জীবনে ছড়িয়ে আছে। শুধুই থিয়েটার, থিয়েটারের উন্নতি নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন না তিনি। এই ঘটনাগুলোই তার প্রমাণ।
এই মানুষ সম্পর্কে যত জানতে পারা যায়, তত অবাক হতে হয়।

আর এই মানুষগুলোর উত্তরসূরী তো আমরাই। দেখতেই তো পাচ্ছেন আমফান, কোভিড, যশ, দুঃস্থ শিল্পী… সবার পাশে ‘থিয়েটারের মানুষ’রা সাধ্যমত ঠিক দাঁড়িয়ে পড়ছে। আজকে বলে নয়। চিরকাল দাঁড়িয়েছে, আজকেও দাঁড়াচ্ছে, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবে। দেখলেন তো অমরেন্দ্রনাথকে। ‘থিয়েটারের মানুষ’ মানে শুধু যাঁরা থিয়েটার করেন তাদের কথাই বলছি না। যাঁরা থিয়েটার দেখেন, থিয়েটার ভালোবাসেন, থিয়েটারের মানুষদের ভালোবাসেন – আমি সেই সব মানুষদের কথাই বলছি। জানি, সাধ্য কম। তাতে কি? সাধ তো আছেরে বাবা।

ওঁর সম্পর্কে কেউ লিখে গেছেনঃ

“মহামারী মৃত্যুরোলে নগরী মুখর –
করে’ছ রোগের সেবা, নির্ভীক অন্তর!
পলাইছে নরনারী
মৃতদেহ সারি সারি –
দেখেছি শ্মশান ঘাটে, সৎকারে তৎপর!
শীতার্ত অনাথের হেরি’ করুণায় গলে’,
অঙ্গবাস মুক্ত করি’ তাহারে যে দিলে
তাই তব শয্যা পাশে,
তারাও কেঁদেছে বসে’,
‘অশ্রুগঙ্গোদকে’ তুমি অমরায় গেলে! ”

ঋণঃ রঙ্গালয়ে অমরেন্দ্রনাথ – রমাপতি দত্ত।