সাত
গোবরডাঙ্গা নক্সায় আমার সিরিয়াস নাট্যচর্চা বা বলা যায় তৎকালীন গ্রুপ থিয়েটার চর্চার শুরু গত শতকের নয়ের দশকে। নাট্যচর্চাকে সর্বক্ষণের সাথী করে পথ চলার এক অনন্য পরিবেশ তৈরি হয়েছিল সে সময়। গোবরডাঙ্গা রেলস্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলে নক্সার মহলা কক্ষ ছিল যেটি বর্তমানে ‘খেলাঘর’ নামে পরিচিত। প্রতিদিন আমাদের সান্ধ্য নাট্যআসর বা অনুশীলন চলতো এই টালির ছাউনি দেওয়া ঘরে। যে ঘরের একপাশে একটি ফালি অংশে ছিল সংযুক্ত অফিসঘর ও গোডাউন। আর বাকি বড় অংশটি ছিল মহলার জন্য। মহলার শুরুতে বা বিরতিতে আমাদের সম্মিলিত আড্ডার জায়গা ছিল রেললাইন পারের মুক্ত প্রকৃতি। যা এক অনাবিল আনন্দ দান করতো। আর সেই সাথে রেলপারের বাসিন্দাদের ও রেল কোয়ার্টারের বসবাসকারীদের সাথে এক অন্য ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল নাট্যচর্চার সুবাদে।
যখন কোন নাট্য প্রদর্শনের জন্য আমরা প্রস্তুতি নিতাম তখন নাটকের যাবতীয় সরঞ্জাম ওই ঘর থেকে নিয়ে এক মিনিটে পৌঁছে যেতাম গোবরডাঙ্গা প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ধরার জন্য। তারপর শুরু হতো অন্য এক লড়াই। সংস্কৃতির সাথে অন্যত্র বসবাস সারাটা দিন। এই কাজগুলি করতে গিয়ে বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হতো যা প্রতিটি নাট্যদলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তো আমাদের মধ্যেও অনেকের মত আমারও কখনো কখনো দায়িত্ব পরতো রেলস্টেশন সংলগ্ন মহলা কক্ষ থেকে দু-তিনজন সদস্যর সাথে সেদিনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রেল স্টেশনে নিয়ে আসার। সেদিন ঘটলো এক কান্ড।
আমিও আমার সহ সদস্য, দুজনের উপর দায়িত্ব ছিল শো-এর যাবতীয় মালপত্র সহ বাক্স ও সেট নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে যাওয়ার। সেভাবেই আমরা সময় হাতে নিয়ে অন্যান্য দিনের মতো পৌঁছে যাই মহলকক্ষের সামনে। দুজন দুজনকে জিজ্ঞাসা করি ঘরের মূল দরজার চাবির কথা। দুজনের কেউই সেদিন যে কোনো কারণেই হোক চাবিটি আনতে ভুলে যাই। চাবিটি যেখানে আছে সেখানে যাওয়া বা সেখানে গিয়ে চাবি আনতে গেলে হয়তোবা নির্ধারিত ট্রেন ধরার কোন সুযোগ থাকবে না। এমনটা ভাবতে থাকি ও দ্রুত পরিকল্পনা করতে থাকি, কেননা এই দায়িত্বহীন কাজটি নিয়ম ভাঙার সমতূল্য ও শাস্তিযোগ্য। হঠাৎ করেই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে আমার সাথে থাকা তরুণ, চঞ্চল, সদাব্যস্ত চরিত্রের সদস্যটি মহলা কক্ষের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ বেয়ে টালির চালে উঠে যায়। একটি বা দুটি টালি সন্তর্পণে খুলে ফেলে। সেই ফাঁক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে কক্ষের জানলার একটি ঝাঁপ খোলে (ঝাঁপগুলি ভিতর থেকে শিকল দেওয়া থাকতো কিন্তু গ্রীল ছিল না)। দ্রুত মালপত্র বাইরে বের করা হলো। সেই সদস্য ভাইটি পুনরায় ভিতর থেকে ঝাঁপ বন্ধ করে ওই ফাঁক দিয়ে চূড়ান্ত শারীরিক কসরতের মাধ্যমে নিজেকে গলিয়ে টালি দুটিকে নিজ নিজ স্থানে স্থাপন করে। এবং আমরা পরি-মরি করে সমস্ত মালপত্র নিয়ে স্টেশনে পৌঁছই। যদিও সামান্য সময়ের এদিক ওদিক হয়েছিল তথাপি আমরা সেদিন নির্দিষ্ট ট্রেন ধরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হই।
পরবর্তীতে ঘটনাটি জানাজানি হলে আলোচনা-সমালোচনা, হালকা-পাতলা রসিকতাও চলেছিল। তবে ওই যে বল্লাম থিয়েটারে স্কুল-কলেজ বা ইউনিভার্সিটি, এ সবই আমাদের এমনতর নাট্যদল যা আপনা আপনিই নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার পাঠ দিয়ে দেয়। আর আমরা হয়তো ধীরে ধীরে শিক্ষানবিশ থেকে শিক্ষিত হয়ে উঠতে থাকি।