থিয়েটারের অঙ্গণে অভিনয়ে উজ্জ্বল প্রবীর আদিত্য

বিজয়কুমার দাস

 

দক্ষিণ ২৪ পরগণায় বড় হয়ে ওঠা প্রবীর আদিত্যর একটা অন্য জীবন আছে। যাদবপুর কার্ণেল ইনফরমেশন সিস্টেম ইন্সটিটিউট থেকে কম্পিউটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ও কম্পিউটার হার্ডওয়ার ডিপ্লোমার অধিকারী প্রবীর। সিগনাস – এনেক্স ইন্সটিটিউট অফ মিডিয়া স্টাডিজ থেকে অডিও ভিস্যুয়াল জানার্লিজমে উত্তীর্ণ। পড়ে পেট্রোলিয়াম কোম্পানীতে চাকরী। কিন্তু এহেন প্রবীর বাংলা থিয়েটারের অঙ্গণে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন অভিনয়ের গুণে।

চাকরী জীবনের পাশাপাশি থিয়েটারে আসা অভিনয়ের টানেই। ২০০২ সালে নান্দীপট নাট্যদলে যোগ দিলেন এবং সেই সময় নান্দীপট প্রযোজিত “শেষ সন্ত্রাস ” নাটকে প্রবীর আদিত্য ড: গ্যালনের সহকারী ও এয়ার চিফ মার্শালের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা পেয়েছিলেন। নির্দেশক ছিলেন বাংলা থিয়েটারের দক্ষ নির্দেশক বিভাস চক্রবর্তী। ঠিক তার পরেই চিরকিশোর ভাদুড়ির নির্দেশনায় ” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ” নাটকে বিনোদবিহারীর চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ আসে। এমন একটি চরিত্রে নিজের অভিনয় দক্ষতা প্রমাণ করলেন প্রবীর। আর ঠিক এখানেই সখ্যতা গড়ে উঠল নাট্যব্যক্তিত্ব রাজা ভট্টাচার্যর সঙ্গে। দুজনে মিলে নতুন করে থিয়েটারের দুনিয়ায় নান্দীপট থেকে বেরিয়ে এসে গড়ে তুললেন ব্ল্যাঙ্কভার্স নাট্যদল। শুধু অভিনেতা নয়, প্রবীর তখন এই দলের অন্যতম সহকারি প্রতিষ্ঠাতাও। সহশিল্পী ছিলেন দীপক মিত্র, সিদ্ধার্থ সেন, ড:শুভ্রসমুজ্জ্বল বসু, রূপক মিত্র, রুমা মিত্র প্রমুখ। ব্ল্যাঙ্কভার্স এর প্রথম প্রযোজনা “ফুড়ুৎ” নাটকেই চমকে দিয়েছিলেন থিয়েটারের দর্শকদের। প্রবীর এ নাটকে কোষাধ্যক্ষ চরিত্রে অভিনয় করেছেন শতাধিক রজনী। মুখ্য চরিত্রের অভিনেতা ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। হাচ অডিয়ন নাট্যোৎসবে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা আয়োজিত শিশু নাট্যোৎসবে, বঙ্গীয় সংস্কৃতি উৎসবে, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির ষষ্ঠ নাট্যমেলায় “ফুড়ুৎ” অভিনীত হয়েছিল।

অভিনেতা প্রবীর ঘর বেঁধেছেন অভিনেত্রী ও সুদক্ষ নৃত্যশিল্পী মামণি দাশগুপ্তর সাথে।মামণি মিনার্ভা রেপার্টারির প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। “দেবী সর্পমস্তা”র মত নাটক সহ বিভিন্ন নাটক ও নৃত্যের মঞ্চে মামণি সুপরিচিত। ব্ল্যাঙ্কভার্সের কানাইচাঁদ পালোয়ান, ভুতুম ভগবান, জুতা আবিষ্কার, The great new life, E-MC2, ইঁদুর প্রভৃতি নাটকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন এই সুদক্ষ অভিনেতা। বিভিন্ন বড় মাপের দেশি বিদেশি নাট্যোৎসবে এই নাটকগুলি অভিনীত হয়েছে। এই দলে সব নাটকের নির্দেশক ছিলেন রাজা ভট্টাচার্য।

এরপর আবার নানা দলে নানা নাটকে অভিনয়ের সুযোগ আসে । ব্ল্যাঙ্কভার্স থেকে বেরিয়ে এসে শ্যামবাজার মুখোমুখি প্রযোজিত “ফেরা ” নাটকে অভিনয় করেন পৌলমী চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় একটি দক্ষিণ ভারতীয় ও একটি বোম্বের হিরোর চরিত্রে । এই নাটকের ১২তম শো থেকে ১০১তম শো পর্যন্ত দাপিয়ে অভিনয় করেছেন। সাম্প্রতিক এই দলের প্রযোজনা “অন্ধযুগ ” নাটকেও অভিনয় করেন প্রবীর। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মত মানুষের স্নেহসান্নিধ্য লাভের পরম সুযোগ এই সূত্রে।

অশোকনগর নাট্যমুখ প্রযোজনা শ্রী অভি চক্রবর্তীর নির্দেশনায় “কন্যা তোর” নাটকে পরেশ হালদার চরিত্রে ৪০ তম শো থেকে এখনো পর্যন্ত ৭০ ছুঁই ছুঁই মঞ্চায়ন চলছে। ঐহিক সৃষ্টিসুখের উল্লাসে প্রযোজনা শ্রী অরিন্দম রায়ের নির্দেশনায় “পঞ্চকণ্যা” নাটকে বৃহন্নলার চরিত্রে, মহিষাদল শিল্পকৃতির সুরজিৎ সিনহার নির্দেশনায় “ত্যাগ” ও “সিন্দুক” নাটকে, বিজয়গড় মনপ্রাণ প্রযোজনা বিমান ব্যানার্জির নির্দেশনায় “বেলফুল”, “অভিনয়”, “জিনঘটিত”, এবং নান্দনিক প্রযোজনায় ইন্দ্রনীল মন্ডলের নির্দেশনায় “বাঘু” ও “ল্যাংড়া ধাবা”য়, কসবা অশনী তে মলয় রায়ের নির্দেশনায় “আলিবাবা”, মারু বেহাগ প্রযোজনায় জলি গুহ রায়ের নির্দেশনায় “দুর্গা ডট কম” ও “ব্যোমকেশ নাটকে ব্যোমকেশের চরিত্রে , ঢাকুরিয়া নাট্যমুখ প্রযোজনা সুজন সাহার নির্দেশনায় “জাহাঙ্গীর” নাটকে আকবরের চরিত্রে, শ্রুতি ক্রিয়েশনস প্রযোজনা সুতপা সেনগুপ্তের নির্দেশনায় “পাগলা ঘোড়া” তে শশীবাবু এর চরিত্রে, বাঁশদ্রোণী শিল্পন এর সীমিকা রায়ের নির্দেশনায় “মেয়ে ছেলে” তে উল্লেখযোগ্য কাজ প্রবীরের। এরপর গড়িয়া কৃষ্টি প্রযোজনা সিতাংশু খাটুয়ার নির্দেশনায় “তুঙ্গভদ্রার তীরে” তে, ভর্গোনাথ ভট্টাচার্যের সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে থিয়েলাভার্স প্রযোজনা ব্রাত্য বসু রচিত ও অভিনীত, শ্রী দেবাশিস দত্ত নির্দেশিত “১৭ই জুলাই” নাটকে dinesh thakkar এর চরিত্রে অভিনয় মানুষের মনে থেকে যাবে বহুদিন। সঙ্গীতশিল্পী রূপঙ্কর বাগচির কৃষ্টি পটুয়া নাট্যদলে দেবদাস ঘোষের নির্দেশনায় “২৯শে এপ্রিল”, কলাপী নাট্যমঞ্চ প্রযোজনা জ্যোতির্ময় বক্সী নির্দেশিত “গ্যালাপাগোসের পাখি ডারউইন, Theatre practitioner নাট্যদলের প্রযোজনা সৌভিক সেনগুপ্তের নির্দেশনায় “আজকের লিয়ার”, সবুজ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রযোজনায় রাজেশ দেবনাথ নির্দেশিত “অয়েদিপউস” নাটকে তাইরেসিয়াসের, কৃষ্ণনগর বার্তা থিয়েটার প্রযোজনায় স্বপন বরন আচার্যের নির্দেশনায় “ম্যাকবেথ”, সম্প্রতি টালিগঞ্জ স্বজন কজন নাট্যদলের নবতম প্রযোজনা সুজিত দত্তের নির্দেশনায় ” রসমাধুরী ” ও “যৌথ পরিবার ডট কম” তে অভিনয় চলছে।

নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি যে সকল বাংলা ধারাবাহিক ও ফিচার ফিল্মে অভিনয় করেছেন সেগুলির মধ্যে অন্যতম- ধারাবাহিক- “একমাসের সাহিত্য”, “ছয়মাসের সাহিত্য”, “সত্যমেব জয়তে” (আকাশ আট), “শ্রীময়ী”, “প্রথমা কাদম্বিনী”(স্টার জলসা), “কাগজের বৌ”, “তদন্ত চলছে”(জি বাংলা)। ফিচার ফিল্ম- “কলকাতার দৈত্য”, “আগুন পাখি”।

অভিনয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মশালা সহ থিয়েটার ম্যানেজমেন্টের কর্মশালাতেও যুক্ত হয়েছেন অভিনয়ের তাগিদেই। অনসম্বল নাট্যদলের সোহাগ দেনের কর্মশালাতেও অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে অভিনয়ের জন্য গড়ে তুলেছেন। এছাড়া ডাবিং, আবৃত্তিচর্চা, ফুটবল খেলার সঙ্গেও তার নিবিড় যোগ।

প্রবীর আদিত্য সেই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী অভিনেতা, যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও দেবশঙ্কর হালদারের মত দুই সুদক্ষ অভিনেতার সঙ্গে শতাধিক অভিনয় রজনী অতিবাহিত করেছে। প্রবীর আদিত্য তাই যথার্থই থিয়েটারের অঙ্গণে এক বিরল শ্রেণির উজ্জ্বল অভিনেতা।

24 thoughts on “থিয়েটারের অঙ্গণে অভিনয়ে উজ্জ্বল প্রবীর আদিত্য

  1. খুব ভালো লাগলো এমন এক গুণী শিল্পী আমার বন্ধু তালিকায় আছে, নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ওর আরো শ্রী বৃদ্ধি কামনা করি।

    1. তুমি আমার বন্ধু এটা ভেবে গর্বিত।
      আরও এগিয়ে যাও।
      অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো।
      ভালো থেকো।

      1. অনেক ধন্যবাদ তামজিৎ দা । ভালো থেকো , সুস্থ থেকো ।

        1. সমৃদ্ধ হলাম।আরওওও সাফল্য কামনা করি ।

    2. অসংখ্য ধন্যবাদ অমিত দা । আপনার লেখা নাটকে অভিনয় করতে পেরে আমি গর্বিত । ভালো থাকুন , সুস্থ থাকুন ।

    3. অমল আলো জার্নালের পাশে থাকবেন। নিয়মিত কমেন্ট করবেন অনুরোধ।

  2. শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।চরৈবেতি।

    1. একজন শিল্পী যখন মানুষ হিসেবে একজন ভালো মানুষ হয় তখন তার পূর্ণ সার্থকতা.. প্রবীর আদিত্য তাই.. সেখানেই সে বড় শিল্পী.. বড় আপন.. বড় আদরের

      1. আরো এগিয়ে চলো, এই কামনা করি❤️❤️

      2. অরিন্দম দা তুমি একজন গুণী এবং ভালো মানুষ । প্রণাম নিও ।

      3. ভালো লাগলো।নিয়মিত চোখ রাখার অনুরোধ রইলো।

    2. ধন্যবাদ বিজয় দা । আপনার লেখার মুন্সিয়ানা কে কুর্নিশ জানাই । ভালো থাকুন , সুস্থ থাকুন ।

      1. বিজয়দা তোমার একজন ফ্যান, জানোতো 🌷নিয়মিত পরিশ্রম করে চলেছেন বিজয়দা অমল আলো জার্নালের জন্য। প্রকৃত থিয়েটার প্রেমী।

  3. গর্বিত আমরা তোর সান্নিধ্য পেয়ে।। তোর আরও এগিয়ে চলা আমরা দেখতে চাই এবং মুগ্ধ হতে চাই। ।

    1. অনেক ভালোবাসা অভি ,ভালো থেকো ।

      1. আমি ভাল না থাকলে তোমার তো অসুবিধে!!!

  4. প্রবীরের এই অধ্যবসায়, এই লেগে থাকা মানসিকতা ইর্ষনীয় এবং শিক্ষণীয়। আমি প্রবীরের বন্ধু পরিচিতের মধ্যে একজন, এই সত্য একইসাথে আমায় আনন্দ ও গর্ব দিচ্ছে। প্রবীর তোর জয়যাত্রা অক্ষুন্ন অখণ্ড থাকুক।

  5. অনেক দিন হলো প্রবীর দা কে আমি চিনি। তিনি যেমন অসাধারণ অভিনেতা তেমনই অসাধারণ মানুষ। সকলের সাথে তার ব্যবহার কথা বলার ধরন অতুলনীয়।
    তার সাথে মামনি দাসগুপ্তের কাছে আমি ৬ বছর নাচ শিখেছি। তিনিও একজন বড় মাপের অভিনেত্রী এবং বড় মাপের নৃত্যশিল্পী। এক কথায় বলতে গেলে দুজনে অসাধারণ মানুষ।।

  6. নিজেকে এমন ভাবে আড়াল করে কত কাজ নিয়মিত করে চলেছ তুমি।দেখা হোক বারবার। ভালোবাসা।

  7. প্রবীরের সঙ্গে খুব অল্প দিনের পরিচয়। ওর সঙ্গে একটা নাটকের জন্য কিছুদিন রিহার্সাল দেওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। সঙ্গে ছিল গল্প-আড্ডা – খুব আমুদে মানুষ তো…
    এছাড়াও প্রবীর খুব সহজ-সরল এবং পরোপকারী একজন মানুষও। ভালো মানুষ না হলে কোনোকিছুই ভালোভাবে করা সম্ভব নয় বলেই আমি মনে করি।
    প্রবীর আরও ভালো ভালো কাজ করুক, আরও উন্নতি করুক, আর খুব ভালো থাকুক। ভালোবাসা রইল প্রবীর।

  8. Prabir samriddhyo holam..aro onekta path egiye cholo..tomar moto manus her sathe amar cheylemeyera avinoy koreche etai onekta paoya..bhalo theko

Comments are closed.