ভূমিকা– আমাদের দেশে কবে নাটক শুরু হল, মূকাভিনয় নাট্যাভিনয়ের থেকে প্রাচীন কিনা, ভরত মুনি কী বলে গেছেন ইত্যাদির সাল তারিখ ইফস অ্যাণ্ড বাটস সব আপনাদের ঠোঁটস্থ, কন্ঠস্থ, আত্মস্থ।
লিয়েবেদফ্ সাহেব, বাবু থিয়েটার, বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার, ন্যাশানাল থিয়েটার, গিরিশবাবু, বিনোদিনী, শিশিরবাবু, শম্ভুবাবু হয়ে আমাদের বাংলা থিয়েটার এখন অনেকখানি রাস্তা হেঁটে ফেলেছে।
এই দীর্ঘ রাস্তা হাঁটতে গিয়ে অনেক বাঁক, চড়াই-উৎরাই, কাদা-মাটি, নদী-নালা ইত্যাদি পেরোতে হয়েছে। সামনে তো আরো অনেক রাস্তা, কত রাস্তা তা তো আমরা কেউ জানি না। এ তো আর এভারেস্টে চড়া কিংবা প্রশান্ত সাগরের তলদেশ ছোঁয়া নয় বা ম্যারাথন রেসও নয়, যে, এতটা গেলেই ওখানে পৌঁছে যাব! এ এক অজানা রাস্তা। যে রাস্তা পেরিয়ে এসেছি আমরা, সেই রাস্তায় কত কী সব ঘটে গেছে। আমাদের জন্যে আমাদের পিতৃপ্রতিম মানুষেরা অনেককিছুই লিখে গেছেন। তারমধ্যে অনেক লেখা, বই আপনারা পড়েছেন, আমিও অল্পবিস্তর পড়েছি, পড়ছি, পড়ার চেষ্টা করছি।
সব বই, সব পত্রপত্রিকা তো সবার পক্ষে পড়া সম্ভব নয়, এ আপনারা জানেন, আমিও জানি। সেই সব বই বা পত্রপত্রিকায় অগণিত মণিমুক্তো ছড়িয়ে আছে। সেসবের অনেককিছুই আপনাদের অনেকের জানা আবার অনেকের অজানা। সেইসব মণিমুক্তোর কিছু আপনাদের সঙ্গে এবার থেকে ভাগ বাটোয়ারা করব বলেই এত ধানাই পানাই করছি।
সেসব মণিমুক্তো হয়ত পর পর সময় মেনে আপনাদের সামনে আনতে পারব না। এই হয়ত বাবু থিয়েটারের একটা গল্প বললাম, পরেরটাই হয়ত অজিতেশবাবুর কোনো ঘটনা। এসব বলতে গিয়ে ভুলভাল কিছু হতেই পারে, সেসব আপনারা ক্ষমা করে দেবেনই, এ আমি জানি।
নাটকের কথা বলতে গিয়ে হয়ত অন্য কথাও এসে যেতে পারে। আসতে পারে, পুরোনো সময়ের পোষাক-আশাক, খাওয়াদাওয়া, যানবাহন ইত্যাদির কথাও। এগুলো বাদ দিয়ে তো আর নাটক হয়নি, হবেও না।
এই যেমন ধরুন, চন্দননগর থেকে বিপ্লবী কানাইলাল দত্তকে কলকাতায় নাটক দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন বিপ্লবী মতিলাল রায়। এ ১৯০০ সালের প্রথম দিকের কথা। কানাইলালের বয়স তখন ১২ বছর। তখন তো আর এখনকার মত টোটো, অটো, ট্যাক্সি, ইলেকট্রিক ট্রেন ছিলনা। আর নাটকও হতো সাত-আট ঘন্টা ধরে। তো সেই সময়ে ওঁরা চন্দননগর থেকে গেলেন কীভাবে, নাটক দেখে কখন ফিরলেন, বারো বছরের ছেলেকে বাড়ির লোক কেমনভাবে ওঁর হাতে ছেড়ে দিল – এসব জানার জন্যে তখনকার যানবাহন, সমাজব্যবস্থা এসব তো জানতে পারলে তো ভালোই হবে। তাই না? ওসব বাদ দিয়ে তো আর নাটক নয়। এখন যেমন টাটা সুমোয় যাচ্ছেন আসছেন, থাকার জায়গা উদ্যোক্তারা করে দিচ্ছেন। তখন কি এতসব ছিল? তারপর ধরুন খাওয়াদাওয়া, সেও তো একটা ফ্যাক্টর ছিল। সকালে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত রিহার্সাল হচ্ছে। অভিনেতা, কলাকুশলীরা খাচ্ছেন কী, কিসেই বা যাতায়াত করছেন – এসবও আসবে লেখায়। আপত্তি নেই তো?
তবে হ্যাঁ, এসব যে বলব, সবই কিন্তু ওইসব বই থেকে টুকেটাকে। সেসব বইয়ের নাম বলে দেব নিশ্চয়ই। তবে একদম শেষে। আপনারাও সেসব বই পড়েন, পড়েছেন। সবই বাংলা বই। সেখান থেকেই একটু এদিকওদিক, এই আর কী। আমি আবার ইংরিজি বইটই পড়তে পারিনা, অত জ্ঞানগম্যি নেই।
ভেবে দেখলাম, হ্যাঁ এরকম তো লেখা যায়, লিখতে পারবও বোধহয়। যদি কারুর ভালো লাগে, তাহলে একটু আধটু প্রশংসাও জুটে যাবে কপালে। সেটা কম নাকি! আর, প্রশংসা পেতে কার না ভালো লাগে বলুন। তবে হ্যাঁ, বকাবকি করবেন না প্লিজ। আপনারা নিজেদের অভিজ্ঞতা, নিজেদের জানাটুকু একটু লিখে দেবেন, সেটা পড়ে আমরা জানব, সমৃদ্ধ হব। মানে সোজা কথায় ‘গিভ আ্যাণ্ড টেক’। কী? কেমন হবে ব্যাপারটা?
লেখাটা একটু বড় হয়ে গেল। কিছু মনে করবেন না। একটু পড়ে নিন। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের দৌলতে রোজ অসংখ্য লেখা, ভিডিও পেয়েই থাকি আমরা। অত লেখাপড়া বা ভিডিও দেখার সময় কোথায়! আমিই বা সব পড়ি নাকি!
যাকগে, অনেক ভ্যাজর ভ্যাজর করলাম। একটা গল্প দিয়ে আজকের এই লেখাটা শেষ করি।
“এক রাজা বহু কষ্টে পাশের রাজ্যকে জয় করলেন। জয় করেই বিজয়ী রাজা বিজিত দেশের বাদ্যকরদের ধরে এনে কোতল করার হুকুম দিলেন। বাদ্যকররা অবাক। জোড় হাতে তারা বলল – মহারাজ! আমাদের কী দোষ! আমরা তো আপনার সঙ্গে লড়াই করিনি। রাজা বললেন – “তোমরাই আমার বড় শত্রু। যুদ্ধকালে বাদ্য বাজিয়ে তোমরা তোমাদের দেশের সৈন্যদলকে এমন রণোন্মত্ত করে তুলছিলে যে, দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও এদেশ জয় করতে পারিনি আমি”।
জাতীয় সংকটে নাট্যকার ও নাট্যশিল্পীরা এই বাদ্যকরের দল, দেশের জনসাধারণের সৈনিক।
পর্ব ১
‘অর্থই অনর্থের মূল’ — কে যেন বলেছিলেন? সে যিনি বলেছিলেন, বলেছিলেন… আমাদের অত কথায় কাজ নেই।
হ্যাঁ, জরুরত সে জ্যায়াদা টাকাপয়সা কারুর হাতে এলে তার খামখেয়ালের জন্ম হয়, ধরাকে সরা জ্ঞান করে, মানুষকে ছোটো করে — এ তো আমাদের জানাই আছে। দেখতেই তো পাওয়া যায় জমি হাঙরদের দুহাতে আট/দশটা সোনার আংটি, গলা- কবজিতে মোটা সোনার চেন — ছোটোখাটো সোনার দোকান! সারা শরীর, কথাবার্তা থেকে অহঙ্কার ঝরে ঝরে পড়ছে। এরা যেন সেই ব্রিটিশ আমলের জমিদারদের বংশধর। ওই জমিদাররা কিন্তু অরিজিনাল ‘জমি হাঙর’ ছিল। একটা উদাহরণ দিই। কোনো এক জমিদার কারও কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে কিছু জমি দান করল। কতটা জমি বলুন তো? এক লক্ষ বিঘে জমি। হ্যাঁ, ঠিকই পড়লেন – এক লক্ষ বিঘে! একটুও বাড়িয়ে বলছি না। তাহলে বুঝুন সেই জমিদারের কতটা জমি ছিল! এরকম আরো অনেক জমিদার সেই সময়ে ছিল।
১৭৯৫ সাল, লিয়েবেদফ্ সাহেব কলকাতায় বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করলেন। মাত্র দু রাত্রি ‘কাল্পনিক সংবদল’ এর অভিনয় হল। প্রথম রাতে একটা অঙ্ক, দ্বিতীয় রাতে তিনটে অঙ্ক। সবটা কিন্তু বাংলায় নয়। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি তিন ভাষাতেই তিনটে অঙ্কের অভিনয় হল। তারপরের ঘটনা তো সবাই জানেন।
লিয়েবেদফ্ সাহেবের অনুবাদ করা দুটো বাংলা সংলাপ, যা ‘কাল্পনিক সংবদল’ নাটকে ব্যবহার হয়েছিল এখানে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না।
১. ” ভাল ঈশ্বর অনুগ্রহ করুন,আমি করিয়া এনেছী একটি বিষয় আমার মনস্তের। সসিমুখী সন্দেহ নাস্তী আমার কথায় প্রত্যয় করিয়াছেন”।
২. “এখনকার দিনে স্ত্রিলোক সকল এমন মত্তা হইয়াছে যে কিঞ্চীত মর্দ্দা আকারের মায়্যা হয়, তাহারাই উপযুক্ত পূরূস হৈতে”।
(বানান অপরিবর্তিত)
সে যুগের পণ্ডিতরা লিয়েবেদফের বাংলা অনুবাদের তারিফ করেছিলেন।
এই ঘটনার পর নাটকের বাজার একদম ঠাণ্ডা। কারও কোনো চ্যাতব্যাত নেই। নাটক হল কী হল না, বয়েই গেল! লোকজনের ঘুম ভাঙল প্রায় ছত্রিশ বছর পর, বাবু প্রসন্ন কুমার ঠাকুর ১৮৩১ সালে শুরু করলেন ‘হিন্দু থিয়েটার’।
এর মাঝে ১৮০৮ সালে চন্দননগরে মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘লা আভোকা’ নামে মলিয়েরের লেখা নাটকের একটা বাংলা অনুবাদ। স্পেশালি চন্দননগরের এই অভিনয়ের কথা খুব একটা কেউ বলেন না। তারপর ১৮২২ সালে ‘কলিরাজার যাত্রা’ নামে একটা নাট্যাভিনয়ের কথা ঐতিহাসিকরা বলেছেন। তবে এটা যাত্রা না নাটক সেই নিয়ে নানা মত আছে। ১৮৩৩ এ নবীন বসু করলেন ‘বিদ্যাসুন্দর’। এসব গপ্পো অপ্পো অপ্পো করে পরে বলব।
বাবু প্রসন্ন কুমার — এই ‘বাবু’ এল কোথা থেকে! ১৭৯৩ সাল, দেশীয় জমিদারদের সুবিধা দেবার এবং নিজেদের প্রচুর সুবিধা মানে লুঠতরাজ চালাবার জন্যে লর্ড কর্ণওয়ালিস সৃষ্টি করলেন ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। এই বন্দোবস্তর ফলেই শুরু হল ‘বাবু কালচার’। ইংরেজদের সঙ্গে নানা ব্যবসা করে বাবুদের হাতে তখন অনেক টাকা। কলকাতার এই ‘বাবু’দের সামাজিক মান-মর্যাদার মাপকাঠি ছিল টাকা। সেই টাকা এসেছিল ইংরেজদের লুঠপাটের সঙ্গী হিসেবে। এইভাবেই তারা গরীবদের শােষণ করে কলকাতায় গড়ে তুলেছিল প্রাচুর্যের পাহাড়। এই কালাে টাকার মালিকদের পরিচয় ছিল ইংরেজদের দেওয়ান, বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, সরকার… ইত্যাদি নামে। আরাে ছিল কোম্পানির উকিল ও জমিদারির সেরেস্তাদার। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল বিশ্বাসঘাতক, ইংরেজদের দালাল। এসব আপনাদের অজানা নয়। ইংরেজরা তাদের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলত ‘ব্ল্যাক জেমিনদার’। এঁদের মধ্যে ঠাকুর পরিবারও আছেন কিন্তু! দুর্নীতির নানা পথে কালো টাকা এসেছিল এই ‘বাবু’দের ঘরে।
অত টাকা দিয়ে কী করবে তারা? শখ আহ্লাদ, বুলবুলির নাচ, টিকিটিকির নাচ, পায়রা ওড়ানো, রক্ষিতা, মদ, বাঈজী নাচ, বেড়ালের বিয়ে, মা-বাপের শ্রাদ্ধ ইত্যাদিতে তখন পয়সা ফর ফর করে উড়ছে। এসব পয়সা তো তারা আর কষ্ট করে উপার্জন করেনি! এদেরই শখ হল ‘থ্যাটার’ করবে। বাবুদের মোসাহেবরা তাদের বাবুদের যেসব পরামর্শ দিত, তারমধ্যে একটা ছিল যাত্রা দেখার কথা। যাত্রা করলে তো স্ট্যাটাস থাকবে না বাবুদের! ইংরিজি থিয়েটার দেখেছে যে! শুরু হল ‘বাবু থিয়েটার’। আসব সে সব কথায়।
এই বাবুরা কেমন ছিলেন তার কিছুটা তো আপনারা দেখেছেন ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে বীরকৃষ্ণ দাঁ এর মধ্যে দিয়ে। সেই যে মদের বোতল, ঘোড়ার গাড়ি, চেলাচামুণ্ডা নিয়ে গঙ্গা চানে যাবার পথে থিয়েটারের জায়গায় এসেছেন…
লিয়েবেদফ্ সাহেবের নাটকে প্রথম দিন টিকিটের দাম ছিল বক্স — আট সিক্কা টাকা, গ্যালারি — চার সিক্কা টাকা। দ্বিতীয় দিন সব টিকিটের দাম এক-এক মোহর। মানে সোনার মোহর! হাউসফুল ছিল কিন্তু! এত দাম দিয়ে কারা টিকিট কিনেছিল? গুণীজনেরা মনে করেছেন এত দাম যখন, সাহেবরাই এই নাটকের দর্শক ছিল। সাহেবদের নাটকে কিন্তু টিকিটের দাম আরও বেশি। ওই সময়ে কলকাতায় একমাত্র থিয়েটার ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’ ( ১৭৭৫ – ১৮০৮) এর একটা বিজ্ঞপ্তি ( ১৩ মে, ১৭৯৫) টিকিটের দাম বলছে — বক্স ষোলো সিক্কা টাকা, ওপরের বক্স বারো সিক্কা টাকা, গ্যালারি আট সিক্কা টাকা।
১৮৭২ এ সাধারণ রঙ্গালয় তৈরি হল। শুরুর সময়ে ন্যাশানাল থিয়েটারে টিকিটের দাম ছিল দু’টাকা, এক টাকা, আট আনা। পরে আরো দাম বাড়ে। ভিড় বেশি হলে টিকিট ব্ল্যাক হতো। চার টাকার টিকিট আট টাকাতেও পাওয়া যেত না। এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য জানিয়ে রাখি, ১৮৫০ সালে ভারতবাসীর মাথাপিছু দৈনিক আয় ছিল দু আনা। ১৮৮২ তে সেটা দাঁড়াল দেড় আনায়। সেই ব্রিটিশ আমলে ভারতের সবথেকে সমৃদ্ধিশালী এই বাংলাদেশের অধিবাসীদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল পনেরো টাকা তিন আনা।
তাহলে বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই, ওই সব নাটকের দর্শক কারা ছিলেন!
নাটকে যে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হতো, তার গল্প তো আলাদা। সুতরাং ‘টাকা’ একটা ব্যাপার! নাটক করতে গেলে তো টাকা লাগবেই। ফোকটে তো আর নাটক হবে না বাপু!
তাহলে একটু দেখে নেবেন নাকি এই টাকা-পয়সার কাণ্ডকারখানা? দেখা তো দরকার। দুম করে তো আর আমাদের হাতে এই কাগজের নোট, কয়েন এসে পড়েনি!
একটা সময় ছিল যখন মানুষে মানুষে খুব যোগাযোগ ছিল। পৃথিবীতে বিনিময় প্রথা চালু ছিল। তামাক, নুন, ধান-চাল, চুনাপাথর, গরু-ছাগল, শামুক ইত্যাদি এমনকি মানুষও ছিল বিনিময় মাধ্যম। তারপর একটা সময় এল, যখন ‘কড়ি’ হল বিনিময়ের মাধ্যম। এখনও আমরা বলি ‘টাকাকড়ি’।
মুদ্রা আসার পর এই ব্যবস্থা ভেঙে গেল। ভারত ছাড়াও বিভিন্ন দেশের প্রশাসকরা নিজেদের ছবি দেওয়া মুদ্রা বানাতেন। এর অনেক পরে এল টাকা।
খ্রিস্ট জন্মাবার ৩৫০০ বছর আগে এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়াতে কড়ি ব্যবহার হতো। প্রাচীন আমেরিকার আদিবাসীরা শামুক খোল দিয়ে বিনিময় করতেন।
বিনিময়ের মাধ্যমগুলোয় হালকা করে একটু চোখ বুলিয়ে নিলে কেমন হয়?
নুন — এ এক সাংঘাতিক ব্যাপার! নুন একসময়ে সোনার মত দামী ছিল। ব্রিটিশরা, কলকাতার বাবুরা কি কম নুনের ব্যবসা করেছে নাকি! আজকেও হাওড়া স্টেশনের কাছে সল্টগোলা (হেরিটেজ প্রপার্টি) রয়েছে, বিরাট জায়গা, বিশাল বিশাল গোডাউন । এখানেই বসতেন সল্ট কমিশনার। এখন সেখানে জঙ্গল, সাপ শিয়ালের আড্ডা। প্রায় ২১ একর জায়গা , ২৪৪ টা ঢাউস গোডাউন (এক একটা গোডাউন খান দেড়েক ফুটবল মাঠের মতো) নিয়ে এই সল্ট গোলা ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল ১৮৩৫ সালে। প্রায় দেড় লাখ টন নুন এখানে মজুত থাকত। বেশ কয়েকবার এই জায়গা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সবাই এটা দেখতে পাবেন না, এটা এখন রেলপুলিশের অধীনে। গুগলে গিয়ে কিছুটা পরিচয় পাবেন এই জায়গার। জায়গাটার কথা বললাম এই জন্যে, এখান থেকে বাবুদের কামানো টাকা থিয়েটারে লেগেছিল। হাওড়া স্টেশনে ঢোকার আগে একটা রেলওয়ে কেবিনের গায়ে এই সেদিনও লেখা দেখা যেত — Salt Gollah. কোন বুদ্ধিমান সেই লেখায় রঙ করে দিয়েছে! ওই পরিত্যক্ত হেরিটেজ প্রপার্টি সল্টগোলা থেকে কত জায়গায় যে ব্রিটিশরা নুন পাঠাত, কত কোটি কোটি টাকা যে তারা কামিয়েছে…! বলার কথা এই যে, এরসঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই ‘বাবু’রা। নুন ছিল বিনিময়ের মাধ্যম। এর বদলে দাস ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনত ব্যবসায়ীরা। পাথুরে নুনের যে চাঁই আবিসিনিয়াতে ব্যবহার হতো, তার নাম ছিল ‘অ্যামোলস’। ইথিওপিয়াতে এই বিংশ শতাব্দীতেও নুন দিয়ে ব্যবসা চলেছে। এই যে আমাদের ‘স্যালারি’ — এই কথা এসেছে লাতিন ‘স্যালারিয়াম’ থেকে। এর অর্থ ‘সল্ট মানি’। রোমে উঁচু পদের মানুষদের মাইনে হতো নুন দিয়ে।
‘চা’ — আজ থেকে কয়েকশো বছর আগেও চিন, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, তিব্বতে চা দিয়ে কেনাবেচা চলত।
‘তামাক’ – এও ছিল কেনাবেচার মাধ্যম। সপ্তদশ শতাব্দীতে তামাকের মূল্য ছিল সোনার মত।
‘ধাতু’ এসে গেল। লেনদেনের ইতিহাসে পশু, নুন, চা, তামাক এসবের যতই দাম থাকুক, কোনোটাই বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ধাতুকে বেছে নিল তাদের টাকা তৈরিতে। সে টাকা দেখতেও হতো নানা রকম। ধাতুর মুদ্রা কখনও কড়ির মত, কখনও বা ছুরি/কোদালের মত হতো।
তুরস্কের লিডিয়াতে প্রথম এসেছিল ইলেকট্রাম ধাতুর মুদ্রা। সোনা আর রূপো দিয়ে তৈরি এই ইলেকট্রাম। আসলে লিডিয়াতে সোনা, রূপো ছিল প্রচুর। এই মুদ্রার মাত্র একপাশেই ডিজাইন থাকত।
মনে করা হয়, খ্রিস্টের জন্মের আনুমানিক সাতশো বছর আগে প্রথম কয়েন তৈরি হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় একই সঙ্গে মুদ্রা তৈরি শুরু হয়েছিল বলে কারা যে প্রথম মুদ্রা বানিয়েছিল, সেটা বলা যায় না। তবে ঐতিহাসিকরা বলেন লিডিয়াতেই প্রথম মুদ্রা দেখা গিয়েছিল।
চিনারা যেমন প্রথম কাগজ তৈরি করেছিল তেমনি মুদ্রা তৈরিতেও তাদের দান অপরিসীম। কাগজের টাকা তাদেরই অবদান। একাদশ শতকে ‘সং সভ্যতা’র সময়ে এই টাকার চল শুরু হয়। ইউরোপের লোকেরা এর একশো বছর বাদে কাগজের নোট চালু করে। ডাচ বণিক জোহান পামস্ট্রোক ১৬৬২ সালে ইউরোপে প্রথম ব্যাঙ্ক নোট চালু করেন। ওদের ভাষায় এই নোটের নাম হল ‘ক্রেডিট পেপারস’। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নেপোলিয়ন কাগজের নোট বের করলেন।
আমাদের দেশেও ধাতুমুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়েছিল খ্রিস্টের জন্মের ৭০০ বছর আগেই। রূপো আর তামা দিয়ে সেসব মুদ্রা তৈরি হতো। কুষাণরাজারা গ্রিক মুদ্রার অনুকরণে নিজেদের মুদ্রা বানিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে ছোটো রাজারাও নিজেদের মুদ্রা বানাতে শুরু করলেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সোনা, রূপোর মুদ্রা পাওয়া গেছে। মধ্যযুগে ভারতে এলেন মুসলমান শাসক। দিল্লির সুলতানদের মুদ্রা, তুঘলকের মুদ্রা ছিল আলাদা।
১৭১৭ সালে ব্রিটিশরা সম্রাট ফারুখশিয়রের অনুমতিতে বোম্বে টাঁকশাল থেকে মুঘল মুদ্রা তৈরি হল। সেই সময়ে তারা যে সোনার মুদ্রা তৈরি করত তার নাম ক্যারোলিনা, রূপোর মুদ্রা অ্যাংলিনা, তামার মুদ্রা কপারুণ আর টিনের মুদ্রার নাম ছিল টিনি।
১৮৩৫ সালে ব্রিটিশরা সারা দেশে এক মুদ্রা চালু করল। সেই মুদ্রায় ছিল চতুর্থ উইলিয়মের ছবি।
১৮৬২-তে রাণী ভিক্টোরিয়ার ছবি দিয়ে এল নতুন মুদ্রা।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে সারা পৃথিবীতে এল রূপোর সঙ্কট। এর ফলে ভারতে এল কাগজের নোট। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রাজা ষষ্ঠ জর্জের ছবি দিয়ে পাঁচ টাকার নোট ছাপল।
১৯৪৭ এ স্বাধীনতার পর এলো আমাদের নিজেদের নোট। তারপর অনেকবার নোটের চেহারা বদলে গেছে। সেসব অন্য কথা।
ধান ভানতে গিয়ে কি শিবের গীত গাইলাম? খুব বোর হলেন নাকি? বোর হলে বলবেন কিন্তু, ‘খুলে আম’ বলবেন।
টাকা পয়সা ছাড়া তো আর থিয়েটার করা যায় না! তাই একটু শিবের গান গেয়েই নিলাম।
ক্রমশ
বেশ লাগছে পড়তে।
বাঃ খুব ভালো